অক্তাবিও পাসের চোখে রবীন্দ্রনাথ: রেখা ও রঙের গায়ক

Octavio Paz & Paintings of Rabindranath Tagore: রবীন্দ্রনাথ নিজেই ঘোষণা করেছিলেন, "...একমাত্র যার জন্যে আমি গর্বিত: তা আমার ছবি।’

১৯৬২ সালে মেহিকো থেকে প্রকাশিত ‘ফের্নান্দো পেসোয়া: আন্তোলোহিয়া’ গ্রন্থের ভূমিকায় পেসোয়া সম্পর্কে লিখতে গিয়ে অক্তাবিও পাস বলেছিলেন, “কবিদের কোন জীবনচরিত নেই। তাদের কাজই জীবনচরিত।” আরেকটু নির্দিষ্ট করে তিনি পর্তুগিজ ওই কবি সম্পর্কে এও বলেছিলেন যে, “তার জীবনে বিস্ময়ের কিছু নেই, কিছুই না, কেবল কবিতাগুলো ছাড়া।” পাসের এই উক্তিরই কি এক পূর্বপুরুষ নিঃশ্বাস ফেলেছিল বহু বছর আগে রবীন্দ্রনাথের কবিতায়, ভিন্ন ছন্দে:

সেই আমি কবি, কে পারে আমারে ধরিতে
মানুষ-আকারে বদ্ধ যে-জন ঘরে,
ভূমিতে লুটায় প্রতি নিমেষের তরে,
যাহারে কাঁপায় স্তুতি-নিন্দার জ্বরে,
কবিরে পাবে না তাহার জীবন চরিতে।
                                      (উৎসর্গ)

দু'জনই ভিন্ন দুই সিঁড়ি বেয়ে, একজন কবিতার প্রচ্ছন্নতার আশ্রয়ে, অন্যজন প্রবন্ধের স্বচ্ছতায় যে-মর্মে প্রবেশ করেন, সেখানে জীবনের সকল স্পন্দন সাহিত্যের সাংকেতিক ভাষায় বিস্ময়করভাবে ধ্বনিত হয়ে ওঠে।

স্প্যানিশভাষী অগ্রগণ্য লেখকদের অনেকেই রবীন্দ্রজীবনীর কঙ্কালে নয়, তাঁর রচনার সার্বজনীন বৈশিষ্ট্যের মধ্যেই খুঁজে পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের অনন্য কণ্ঠস্বর এবং সে কণ্ঠস্বর হিমেনেছ, ওকাম্পো, হোসে বাসকনসেলোস, পেদ্রো এনরিকেস উরেনঞা, নেরুদা, মিস্ত্রালসহ স্প্যানিশভাষী বহু লেখককেই এক সময় অনুপ্রাণিত করেছিলে। হিমেনেছে এই প্রভাব ছিল অনেক বেশি স্পষ্ট তবে সৃষ্টিশীল। হয়তো তাই রবীন্দ্রনাথকে যখন তিনি অনুবাদ করেছেন, তখন তা হয়ে উঠেছে ‘আন্দালুসীয় রবীন্দ্রনাথ’। সৃষ্টিশীল সত্ত্বার সঙ্গে আরেক সৃষ্টিশীল সত্ত্বার সম্মিলনে এভাবেই সৃষ্টি হয় আরেক নতুন সত্ত্বার যদিও তা উভয়ের বৈশিষ্ট্যকে বহন করেই গড়ে ওঠে। নেরুদার প্রথম কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতায় ছিল রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতার হুবহু প্রতিধ্বনি। পাসের ক্ষেত্রেও কি তবে তাই ঘটেছিল? উভয়ের ভাবনার উপরোক্ত সাযুজ্য আমাদেরকে এমন একটি প্রশ্নের জন্য অনুপ্রাণিত করতে পারে বৈকি!

কিন্তু এই সাযুজ্যটুকু ছাড়া পাসের রচনায় রবীন্দ্রনাথের প্রভাবের আর কোনও নজির আছে বলে আমার মনে হয় না। হতে পারে পাস অজান্তেই ঠিক এই একটি ক্ষেত্রে অনুভূতির অভিন্ন সমতলে এসে দাঁড়িয়েছিলেন শুধু একবারের জন্য। আর এটি এমনই এক ধ্রুব অনুভূতি যা সৃষ্টিশীল লেখক মাত্রেই অনুভব করেন; তা কেউ প্রকাশ করুন আর না-ই করুন। ফলে শুধু এই সাযুজ্য দিয়ে প্রভাব নির্ধারণ করাটাও হবে অর্থহীনতার বিস্তার। তারপরেও এই সাযুজ্যের উল্লেখ করছি রবীন্দ্রনাথের প্রতি পাসের আগ্রহের চিহ্ন ও ইতিহাসটিকে বুঝে নেওয়ার লক্ষ্যে।

আরও পড়ুন- সত্তার দ্বৈত রূপে রবীন্দ্রনাথ ও বোর্হেস: ভাবনার যমজ সন্তান

রবীন্দ্রনাথের প্রতি পাসের আগ্রহের সূচনা কখন থেকে শুরু তা নির্দিষ্ট করে বলার উপায় নেই এই জন্য যে পাস নিজে তা কোথাও উল্লেখ করেননি। তথ্যমাতালদের জন্য এটা জানা হয়তো খুবই কৌতূহলোদ্দীপক যে, ১৯৩১ সালের ৭ জুন El Nacional পত্রিকার Los nuevos শীর্ষক বিভাগে পাসের প্রথম কবিতা 'Juego’ প্রকাশিত হয়। ঠিক এই সংখ্যাতেই প্রকাশিত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের একটি গদ্য কবিতাও। সন্দেহ নেই যে, নোবেলভূষিত এই কবির সঙ্গেই নিজের প্রথম আত্মপ্রকাশের ঘটনাকে তিনি লক্ষ্য করে থাকবেন। ঠিক এই কারণে অনুমান করা যায় যে, ১৯৫১ সালে কূটনৈতিক পেশার সূত্রে ভারতে প্রথমবার আসার আগে থেকেই তিনি রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে অবগত ছিলেন। এরকম ধারণা করার পেছনে স্প্যানিশ সাহিত্যে রবীন্দ্র-রচনার অনুবাদের ইতিহাসটিকেও আমলে রাখলে আমরা একটা সমর্থন খুঁজে পাব। ১৯১৫ সালেই রবীন্দ্রনাথের দ্য ক্রিসেন্ট মুন হুয়ান রামোন আর সেনোবিয়ার অনুবাদে স্প্যানিশ ভাষায় প্রকাশিত হয় লা লুনা নুয়েবা নামে। এর পর থেকে রবীন্দ্রনাথের এই বই তো বটেই, আরও অন্যান্য গ্রন্থ অনূদিত হয়ে প্রকাশিত হতে থাকে স্পানঞা এবং লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশ থেকে। এমনকী মেহিকো থেকেও ১৯১৮ সালেই প্রকাশিত হয় অকালপ্রয়াত কবি ও অনুবাদক পেদ্রো রেকেনার অনুবাদে গীতাঞ্জলি। পাঠক ও সাহিত্যিক জীবনের শুরুতে এসব অনুবাদের সঙ্গে পাসের মতো গোগ্রাসী পাঠক যে পরিচিত ছিলেন সেটা সহজেই অনুমান করা যায়। তবে সেই পরিচয়ের গভীর বা অগভীর কোনও প্রভাব যে তাঁর লেখায় ছিল তেমনটা বলা যাবে না। পরিণত বয়সে বা শেষ জীবনেও যখন রবীন্দ্রপ্রসঙ্গ এসেছে তখনও ওরকম কোনও প্রভাবের কথা তাঁকে স্মরণ করতে দেখা যায় না। যদিও তিনি উল্লেখ করেছেন যে, ১৯২৪ সালে মেহিকোর লেখক ও শিক্ষামন্ত্রী হোসে বাসকনসেলোসের নেওয়া শিক্ষা-প্রকল্পের অধীনে রবীন্দ্রনাথের ক্রিসেন্ট মুন এবং ন্যাশনালিজম বই দুটো বেরিয়েছে। তবে যে-অর্থে প্রথম জীবনের নেরুদার কবিতায়, কিংবা হিমেনেছের সাহিত্যিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ পর্বে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতিকে দেখতে পাই, পাসের সৃষ্টিশীল রচনায় সেরকম কোনও চিহ্ন আমরা খুঁজে পাব না। ভারতীয় সংস্কৃতির প্রভাব তাঁর কবিতায় এবং ভাবনায় থাকলেও রবীন্দ্রনাথের কোনও প্রভাব তার মধ্যে নেই। তবে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকর্মের প্রতি তাঁর আগ্রহ জাগ্রত ছিল দীর্ঘদিন থেকেই। এ সম্পর্কে তিনি বিভিন্ন সময় মন্তব্য করেছেন এবং লিখেছেন স্বতন্ত্র একটি প্রবন্ধও। ভারতীয় সংস্কৃতিতে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতি এবং তাঁর ভূমিকা সম্পর্কে পাসের মূল্যায়নের কথা আমরা জানতে পারব বিসলুম্ব্রে দে লা ইন্দিয়া (Vislumbre de la India) বা ইন লাইট অব ইন্ডিয়া (In light of India) গ্রন্থের ১১৭-১১৮ পৃষ্ঠায়:

এখানে অবশ্যই আমাকে এ কথা বিশেষভাবে বলতে হবে যে আধুনিক সমালোচনামূলক ভাবনার অনুপস্থিতি মানে এই নয় যে এখানে মহৎ সাহিত্যেরও অভাব আছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর এক উদাহরণ। তিনি কোনো ভাবুক ছিলেন না, ছিলেন একজন মহান শিল্পী। তাঁর জীবন ও কর্ম ছিল ভারত ও পৃথিবীর মধ্যে এক সেতুবন্ধ। ডব্লিউ বি ইয়েটস ও আঁদ্রে জিদের মতো ইউরোপের সেরা মানুষেরা তাঁর প্রতি মুগ্ধ হয়েছেন, এমনকি হিস্পানিক জগতেও অনেক উৎসাহী পাঠক তিনি পেয়েছেন। তিনি বুয়েনোস আইরেস ভ্রমণ করেছেন; ছিলেন ভিক্তোরিয়া ওকাম্পোর বন্ধু যাকে তিনি তাঁর একটি কবিতার বই উৎসর্গ করেছেন। স্ত্রী সেনোবিয়া কাম্প্রুবির সহযোগিতায় রবীন্দ্রনাথের বেশির ভাগ লেখা অনুবাদ করেছিলেন মহান কবি হুয়ান রামোন হিমেনেছ। এই অনুবাদগুলো পাবলো নেরুদাসহ সেকালের বহু তরুণ কবিকে প্রভাবিত করেছিল। নেরুদার প্রথম দিকের একটি বই ‘বিশটি প্রেমের কবিতা ও একটি হতাশার গান’-এর কোনো কোনো মুহূর্তে রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠের প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথ রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেননি বটে কিন্তু তিনি ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা এবং এর মূল্যচেতনার একজন আবেগপ্রবণ প্রহরী (তাঁর বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন ভারতীয় সংস্কৃতি ক্ষেত্রে সংঘটিত বাংলা রেনেসাঁর অন্যতম কেন্দ্রীয় চরিত্র)। গান্ধিবাদী রাজনীতির সুনির্দিষ্ট কিছু দিক, যেমন—পশ্চিমা সভ্যতার সামগ্রিক বর্জন এবং বিদেশি বস্ত্র ও পণ্যের বহ্নি-উৎসব ইত্যাদি নিয়ে কবির সমালোচনা ছিল। (রবীন্দ্রনাথ বলতেন, ওই সব কাপড়চোপড় বিবস্ত্র মানুষগুলোকে দিতে পারলে বরং আমার ভালো লাগত।) এ নিয়ে গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যে সামান্য টানাপোড়েন হয়।

গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যে পরস্পরের প্রতি যে শ্রদ্ধাবোধ ছিল এসব মতভেদের কারণে অবশ্য তাতে গভীর কোন চিড় ধরেনি। তবে এ কথা স্মরণে রাখা ভালো, কবিদের সম্পর্কে ধারণাটি যদিও উল্টো, কিন্তু কবিরা সচরাচর কাণ্ডজ্ঞানেরই পরিচয় দিয়ে এসেছেন, সাধুদের সম্পর্কে যা অনেক সময় কেউ বলতে পারবেন না। কবি ও সাধুর মধ্যে সংলাপের বিনিময় কঠিন; কারণ, কোনো কিছু বলার আগে কবিকে অন্যদের শুনতে হয়, যেমন ধরা যাক, ভাষাকে, যা প্রত্যেকের এবং কারোরই নয়। আর সাধু কথা বলেন ঈশ্বরের বা নিজের সঙ্গে- নীরবতার দুই প্রতিমূর্তি। (অনুবাদ: সাজ্জাদ শরিফ)

সংস্কৃতির সৃষ্টিশীল ভাষ্যকার ও সাহিত্য সমালোচক পাসের কাছে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যিক গুরুত্ব যেমন ছিল তেমনই রবীন্দ্রনাথের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ভাবনাগুলোকেও তিনি বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিতে মূল্যায়ন করেছিলেন নির্ভুলভাবে। তাঁর এই মূল্যায়ন ছিলো জীবনের শেষ পর্বের দিকে।

১৯৭১ সালের দিকে শেলডেন রোডম্যানের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে বলেন:

“আমি জানি না এই সময়ে ভারতে গুরুত্বপূর্ণ কবি আছেন কিনা”, তিনি (পাস) বলেন, ”আমার এক বন্ধু স্বামীনাথন যিনি চিত্রশিল্পী, তবে তাকে আমি কবি হিসেবে বিবেচনা করি। আমার ভালো লাগে ১৮ ও ১৯ শতকের কবিদের, সেই সব মরমী কবিদের যারা কবিতা আবৃত্তির সাথে নাচতেন এবং গাইতেন, গীন্সবার্গের মতো। রবীন্দ্রনাথের কথাতো অবশ্যই বলতে হবে”, তিনি আরও বলেন, “তবে আমি তাকে চিত্রশিল্পী হিসেবেই বেশি পছন্দ করি। আপনি কি তার পাণ্ডুলিপি দেখেছেন? এক অর্থে তিনিই কংক্রিট (concrete) কবিতার সূচনা করেছিলেন।” (Tongues of fallen Angels, new directions, 1974, p-142)

তাঁর এই মন্তব্যের আগেই পাস ১৯৬৭ সালে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে একটি স্বতন্ত্র প্রবন্ধ লেখেন যার শিরোনাম ছিল 'লোস মানুস্ক্রিতোস দে রবীন্দ্রনাথ তাগোরে’, পরে এটি তাঁর এল সিগনো ই এল গারাবাতো গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়।

লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হলো প্রবন্ধটি কবি, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার কিংবা নাট্যকার রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নয় বরং চিত্রকর রবীন্দ্রনাথই নজর কেড়েছে অক্তাবিও পাসের। প্রবন্ধের শিরোনামটির বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায় ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পাণ্ডুলিপি’। অর্থাৎ সেই সব পাণ্ডুলিপি যেগুলো চিত্রকর রবীন্দ্রনাথের আঁতুড়ঘর।

পাস রবীন্দ্রনাথের ‘কবিতার চুম্বকীয় শক্তি’র (el poder magentico de su poesia) কথা স্বীকার করলেও শেষ পর্যন্ত বলেছেন “আজকাল তার অনেক কবিতাকেই মনে হয় বাগাড়ম্বর এবং তা আমাদের হাসির উদ্রেক করে (Muchos de sus poemas hoy nos parecen camp y nos hacen sonreir)"। পাসের এই বক্তব্যের পাশাপাশি হঠাৎ করেই হয়তো মনে পড়বে রবীন্দ্রনাথের শেষ পর্বের কবিতা সম্পর্কে কবি শঙ্খ ঘোষের, ঈষৎ নমিত কিন্তু সারাৎসারে অভিন্ন, সেই উক্তি:

“তাই বলে কি সঙ্গে সঙ্গে এও মানব না যে অতিবাচনের ভার রবীন্দ্রনাথকে থেকে থেকে কেমন স্খলিত করে দেয়? লক্ষ্য করব না যে শেষ বয়সে এই পল্লবিত ভাষণ বেড়ে গিয়েছিলো আরো বেশি?”
(অমরেন্দ্র চক্রবর্তী,কবিতা-পরিচয়,  দেজ’ পাবলিশিং , কলকাতা, ডিসেম্বর ১৯৮১, পৃ:৪১)

রবীন্দ্রনাথ নিজেও কি টের পাচ্ছিলেন না এই পল্লবিত ভাষণের বাহুল্য? বাহুল্যের ভার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই হয়তো তিনি বর্ণমালা থেকে রংয়ের জগতে প্রবেশ করেছেন। “শেষ বারো বছরে ঝর্নার বেগে এঁকে তুলতে পারেন প্রচলবিরোধী আড়াই হাজার ছবি।” (নির্মাণ আর সৃষ্টি, শঙ্খ ঘোষ, প্যাপিরাস প্রকাশনী,২০০৯,পৃ ৭২)। অথচ এই রবীন্দ্রনাথই একসময় মনে করতেন “Being thoroughly convinced that my fate had refused me passport across the strict boundaries of letters.” (Rabindra-Chitrokaula, Edited by Abul Hasnat, Chhayanaut,2011, P- 34)। অক্ষরের সীমান্ত পার হয়ে তিনি শেষ জীবনে এসে প্রবেশ করলেন রংয়ের রাজ্যে। একদিকে নীরদ সি. চৌধুরী, অন্যদিকে এজরা পাউন্ড এই নতুন রাজ্যে প্রবেশকে স্বাগত না জানালেও স্বদেশে কুমারস্বামী এবং বিদেশে ক্যারল কুটরবার্টসন, রমাঁ রলাঁ বা কঁতেস দ্য নোয়াই সাদরে বরণ করে নিয়েছিলেন চিত্রকর রবীন্দ্রনাথকে।

“প্যারিসে প্রদর্শনীর ক্যাটালগে লিখেছিলেন কঁতেস দ্য নোয়াই: মিস্টিক রবীন্দ্রনাথ এখানে না-জেনেই খুলে দিয়েছিলেন এমন এক মনকে, যে মন বিদ্রুপ করতে পারে, এমনকী ঘৃণা করতে পারে। ‍কুমারস্বামী বলেছেন, এ হলো আধুনিক এক আদিম ছবির জগৎ। অজানা-সব রূপের ছন্দোময় আকুতিতে ভরে উঠেছে তাঁর নূতন এই শিল্পসম্ভার।” ( শঙ্খ ঘোষ, নির্মাণ আর ‍সৃষ্টি, প্যাপিরাস প্রকাশনী, ২০০৯, পৃ ৭২)

লাতিন আমেরিকায় এক বিক্তোরিয়া ওকাম্পো, হাইমে সাবিনেস, এদুয়ার্দো গনছালেস লানুসা বা পেদ্রো এনরিকেস উরেনঞা ছাড়া আর কোনও গুরুত্বপূর্ণ কবি-লেখকই কবি রবীন্দ্রনাথকে তেমন গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন বলে মনে হয় না। কবি রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তীব্র কটুক্তি সত্ত্বেও বোর্হেস যদি তাঁকে ন্যাশনালিজম বইয়ের কারণে প্রাবন্ধিক হিসেবে গ্রাহ্য করে থাকেন, তাহলে অক্তাবিও পাস ভাবুকতার ক্ষেত্রে যৌক্তিক, সুগভীর ও দূরদর্শী হিসেবে রবীন্দ্রনাথকে মেনে নিয়েও শেষ পর্যন্ত চিত্রকর রবীন্দ্রনাথই ছিলেন তার কাছে সবচেয়ে বেশি আর্কষণীয়। কেন বেশি আকর্ষণীয় তার কারণসহ তিনি ১৯৬৭ সালে লিখিত Los manuscritos de Rabindranath Tagore নামক সেই স্বতন্ত্র প্রবন্ধে উল্লেখ করেছিলেন এভাবে:

সময় যত পার হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলার প্রতি মানুষের আগ্রহ তত বাড়ছে। সম্প্রতি এক লেখায় ভারতীয় চিত্রকলার এক প্রধান প্রতিভা স্বামীনাথন বলেছেন, বাংলার এই কবির চিত্রকর্ম মৌলিকতার দিক থেকে সমকালীন ভারতীয় চিত্রশিল্পে অন্যতম। তিনি ঠিকই বলেছেন। অন্তত আমার ধারণা, তার চিত্রকলা তার কবিতার মতোই গুরুত্বপূর্ণ; অধিকন্তু তা আরও আধুনিক। আজকাল তার অনেক কবিতাকেই মনে হয় বাগাড়ম্বর এবং তা আমাদের হাসির উদ্রেক করে। কিন্তু তার চিত্রকলার ক্ষেত্রে সেটা ঘটে না। রবীন্দ্রনাথ কবিতায় যা বলেননি, চিত্রকর্মে তা বলেছেন; আর তা বলেছেন তীব্রতা, উৎকল্পনা ও স্বাধীনতা নিয়ে, যা সত্যিই চিত্তাকর্ষক। কবি রবীন্দ্রনাথের তুলনায় চিত্রশিল্পী রবীন্দ্রনাথ আমাদের অনেক কাছের। তবে শিল্পী ও কবির মধ্যে একটি মিলনবিন্দু রয়েছে। এই মিলনবিন্দুটি হচ্ছে সত্যিকারের স্পর্শকাতর বিন্দু এবং তা লেখকের রচনাকর্মে গভীরতার ব্যঞ্জনা দেয়। বিক্তোরিয়া ওকাম্পো তার প্রবন্ধে যে পাণ্ডুলিপির উল্লেখ করেছেন আমি তার কথা বলছি। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি এবং পরাবাস্তববাদীদের ধারণা সম্পর্কে অনবহিত থেকে রবীন্দ্রনাথ নির্ভর করেছিলেন স্বজ্ঞার ওপর। লেখার আঁকিবুঁকি এবং অন্য আপতনগুলো শৈল্পিক অভিজ্ঞতায় রূপান্তরিত করতে গিয়ে তিনি পাণ্ডুলিপির পাতাকে এক জাদুকরী রূপ দেন। শব্দগুচ্ছ চিত্রের ইশারায় রূপান্তরিত হয়ে অর্থের পরিমণ্ডল থেকে বেরিয়ে আসে। একই সঙ্গে আঁকিবুঁকি, রেখা আর বর্ণিকাভঙ্গের এক অনিবার্য আভাসে যুক্ত ও বিযুক্ত হয়। এ হচ্ছে ভাষার ব্যর্থতা কিন্তু কবিতার বিজয়। কবিতা যা বলে তা ভাষার অতীত; ছবি যা প্রকাশ করে তা দৃশ্যের অতীত।

কবিতা ও চিত্রকলার মধ্যকার সম্পর্কের প্রতি রবীন্দ্রনাথের আগ্রহ তার লেখায় আমরা আগেই দেখতে পাই। জাপানি কবিদের প্রথম পাঠের পর তার মন্তব্য: ‘তারা কাব্যগীতি নয় বরং কাব্যচিত্র লেখেন।’ গভীর অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন এই পর্যবেক্ষণ ভারতীয় কাব্য-ঐতিহ্যের সঙ্গে চীনা ও জাপানি কাব্য-ঐতিহ্যের পার্থক্যকে তুলে ধরে। রবীন্দ্রনাথ নিজেকে কবিতাচিত্র বা শব্দচিত্রের প্রলোভনের হাতে সমর্পণ করেননি। আপোলিনেয়ার থেকে এখানে তিনি আলাদা। ফরাসি এই কবি শব্দ দিয়ে ছবি আঁকতে চেয়েছিলেন, তার অনেক ক্যালিগ্রাম সুন্দর হলেও কবিতার সঙ্গে চিত্রের এই মিলন ঘটানোর চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। পক্ষান্তরে রবীন্দ্রনাথ রেখা ও রঙের সাহায্যে গান গাইতে চেয়েছেন। তবে তা ভাষা ও বর্ণের পক্ষে নয়, বরং রেখা ও আঁকিবুঁকির পক্ষে- যা সব সময় ছন্দময়। ১৯৩০ সালে এক প্রবন্ধে তিনি বলেন: ‘সব ধরনের শিল্পের ক্ষেত্রে যা অভিন্ন সেই ছন্দের বিধান জড়বস্তুকে রূপান্তরিত করে জীবন্ত সৃষ্টিতে। আমার ছন্দের সহজাত প্রবৃত্তি এবং শৈল্পিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা আমাকে উদ্ভাবনের সেই জায়গায় নিয়ে গেছে, যেখানে শিল্পে রেখা ও রং থেকে কোনো তথ্য নির্গত হয় না। রেখা ও রং শিল্পের প্রকরণে খুঁজে ফেরে এক ছন্দময় উদ্ভাবনা। তার পরম লক্ষ্য অন্তর্দৃশ্য বা বহির্বাস্তবতার চিত্রায়ণ বা অনুকরণ নয়...।’ এই কথাগুলো-যা আমাকে কান্দিনিস্কির কথা মনে করিয়ে দেয়- শিল্পের এক মনোগ্রাহী সংজ্ঞা এবং আধুনিক শিল্পের প্রস্তাবনা। একটু পরে একই প্রবন্ধে তিনি বলেন: ‘...আর এ ছিল আমার পাণ্ডুলিপির আকস্মিকতা সম্পর্কে এক অভিজ্ঞতা। বিচ্ছিন্ন এই পরিমার্জনাগুলো ছন্দময় সম্পর্কে যুক্ত হয়ে এক অনন্য প্রকরণের জন্ম দেয়...।’ বাঙালি এই কবি আমাদের ক্রমাগত বিস্মিত করেন। স্মরণ করা যাক আধুনিক শিল্পের দুঃসাহসী একটি উদ্যোগের কথা: ‘কংক্রিট পোয়েট্রি।’ আপনারা জানেন, এ এক আন্দোলন যার কেন্দ্র ব্রাজিল, ইংল্যান্ড ও জার্মানিতে। তরুণ এই শিল্পীরা চান (এবং কখনো কখনো তা অর্জনও করেন) অর্থ ও অর্থহীনতার মধ্যে শব্দ, রেখা ও বর্ণের সঙ্গে বাচনিক ও শৈল্পিক সম্পর্ক রচনা করতে। রবীন্দ্রনাথ খানিকটা সে রকমই চেষ্টা করেছেন। তার কাজের এই দিক নতুন চিত্রকর, কবি ও সংগীতকারদের সামনে খুলে দেয় এমন এক জগৎ, যা অত্যন্ত অল্প কজনই আবিষ্কার করেছেন। রবীন্দ্রনাথের হৃদয়গ্রাহী পাণ্ডুলিপি আমাদের কাছে এমন এক শিল্পীকে তুলে ধরে, যিনি একই সঙ্গে আমাদের পূর্বসূরি ও সমকালীন।

কালের দূরত্বে বসে আমাদের কাছে রবীন্দ্রনাথের সমকালীনতা এবং প্রাসঙ্গিকতার প্রশ্নটি বারবার আসবে; দেশে বিদেশে সর্বত্র। তার সাহিত্যকর্মের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে একালে নানান আলোচনা হলেও  তার চিত্রকর্মের সমকালীনতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে কম এবং সেই কম আলোচনার মধ্যে তার চিত্রকর্মের সত্যিকারের গুরুত্বকে পাসের মতো বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে রেখে দেখার চেষ্টা হয়েছে আরও কম। তার চিত্রকর্মকে যতই হেঁয়ালি এবং খেয়ালি মনের বিচ্ছুরণ হিসেবে দেখি না কেন তা যে অতলে শিল্পের মৌল স্বভাবের নির্ভুল অনুগামী ছিলো তা পাসের মতো আর কে এমনভাবে দেখাতে পেরেছেন?

আরও পড়ুন- জীবনবোধে এক হয়ে যান মার্থা নাসবম থেকে রবীন্দ্রনাথ : সুমন চট্টোপাধ্যায়

রবীন্দ্র-চিত্রকলার প্রতি পাসের মুগ্ধতার প্রকাশ কেবল তাঁর প্রবন্ধেই সীমাবদ্ধ ছিল না, যেমনটা আগেই বলেছি, যখনই রবীন্দ্র-প্রসঙ্গ বা চিত্রকলার প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়েছে, তিনি অকুন্ঠচিত্তে প্রশংসা করেছেন বাঙালি এই চিত্রশিল্পীর। তারই এক নমুনা আমরা দেখতে পাব ‘আর্তে দে মেহিকো’ নামের শিল্পকলা বিষয়ক এক পত্রিকায় তাঁর এক সাক্ষাৎকারে। আমি কেবল এই দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের রবীন্দ্র-বিষয়ক অংশটুকু এখানে পাঠকদের কৌতূহল নিবৃত্তির জন্য তুলে দিচ্ছি:

“মনে হয় কোনো কোনো শিল্পীর মূল কাজের পাশে তাদের অন্য কিছু কাজ সাধারণত খুবই, বা তারচেয়েও বেশি কৌতূহলোদ্দীপক। আমরা এর আগে অন্যত্র ভিক্টর উগোর ড্রয়িংগুলো নিয়ে কথা বলেছিলাম, যিনি মহৎ কবি হওয়া সত্ত্বেও ছিলেন এক মহান শিল্পী। তবে আরেকটি লক্ষণীয় ঘটনা আছে যা ভারতীয় কবি রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে ঘটেছে। আমার স্ত্রী ও আমি যখন কোলকাতায় ছিলাম, তখন রবীন্দ্রনাথের এক শিষ্যা আমাদেরকে নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন যিনি কবির সমস্ত কাগজপত্র সংরক্ষণ করে রাখতেন। তার ঘরটা ছিল এক রকম স্মৃতিশালার মতো, সেখানেই দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম চিত্রশিল্পী রবীন্দ্রনাথের কাজ যা ভিক্টর উগোর মতোই কৌতূহলোদ্দীপক। তার ক্ষেত্রে একটা বিশেষত্ব হলো এই যে, রবীন্দ্রনাথ যে-ভাষায় লিখতেন তাকে বলা হয় দেবনাগরী, এর লেখ্যরূপ খুবই সুন্দর। তবে হ্যাঁ, দাগ কাটতেন, সংশোধন করতেন, মুছে ফেলতেন এবং দাগগুলোকে রূপান্তরিতও করতেন। কংক্রিট কবিতা যে-কাজটা করে অনেকটা সেরকম, তবে তিনি এটা করতেন অনেক বেশি প্রকাশবাদী (Expresionnista) ভঙ্গিতে যা আমাদের চেনা বহু কংক্রিট কবিদের চেয়ে অনেক বেশি জীবন্ত। এবং হঠাৎ করেই অক্ষরগুলো দিয়ে তিনি সৃষ্টি করতেন অসামান্য ভূদৃশ্য, আর কাল্পনিক ও ভয়ংকর সব জীবজন্তু। বিক্তোরিয়া ওকাম্পোও এই পাণ্ডুলিপিগুলো দেখেছিলেন, যখন রবীন্দ্রনাথ তার সান ইসিদ্রোর বাসায় ছিলেন। অন্যান্যদের মধ্যে অন্যতম, আঁদ্রে জিদের পৃষ্ঠপোষকতায় রবীন্দ্রনাথ প্যারিসে একটা প্রদর্শনী করেছিলেন। শিল্পকর্ম, চিত্রকলা এবং লেখা যেখানে একে অপরের সাথে জড়িয়ে গেছে সেধরনের কাজগুলোর প্রতি আমার আগ্রহ চিরকালের।”

Creo que los trabajos hechos por algunos artistas al lado de su obra central son generalmente tan interesantes o más que ella. Ya hemos hablado en otras ocasiones de los dibujos de Víctor Hugo, que fue un gran artista plástico además de gran poeta. Pero hay otro caso notable, el del poeta indio Tagore. Cuando mi mujer y yo estuvimos en Calcuta, fuimos invitados por una mujer que había sido discípula de Tagore y que conserva todos los papeles del poeta. Ha hecho de su casa una especie de museo y ahí pudimos ver, además de la obra de Tagore pintor, que era tan interesante como la de Víctor Hugo, algo muy especial: Tagore escribía en unos caracteres que se llaman devanagari, que es una escritura muy hermosa. Pero claro, tachaba, corregía, borraba y transformaba las manchas. De modo que hacía una especie de poesía concreta pero de una manera mucho más expresionista y mucho más vivía de la de muchos poetas concretos que conocemos. Y de pronto, con las letras creaba paisajes extraordinarios y criaturas fantásticas, amenazantes.

Victoria Ocampo también vio esos manuscritos cuando Tagore vivió en su casa de San Isidro. En París, Tagore hizo una exposición auspiciada por André Gide, entre otros.

Siempre me han interesado esas obras en donde las artes, como la pintura y la escritura, se cruzan. O donde las artes derivan de su cauce central hacia trabajaos, materiales y facturas laterales.

এই সাক্ষাৎকারেরও আগে, ১৯৭১ সালে পাস কবি ও অনুবাদক চার্লস টমলিনসনের কবিতার বর্ণনামধুর ও চিত্রল-স্বভাবের প্রসংশা করতে গিয়ে তার কবিতাকে Visauly Mental বলে অভিহিত করেছিলেন, তারই সূত্রে এসেছিল রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলার প্রসঙ্গও। রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে তার আগের কথাগুলোরই খানিকটা প্রতিধ্বনি সত্ত্বেও বলার ধরন ও পর্যবেক্ষণে ছিল কিছু নতুনত্বও। পাশাপাশি অক্ষর থেকে রংয়ে বা রং থেকে অক্ষরে শিল্পীদের হিজরত করার সৃষ্টিশীল মুক্তির ভাষ্য তিনি হাজির করেছিলেন টমলিনসনকে নিয়ে En Blanco y Negro নামক লেখাটিতে। আর সেখানেই তিনি অন্যদের পাশাপাশি চিত্রকর রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করেন এভাবে:

এটা আশ্চর্যের নয় যে এইসব উদ্বেগ নিয়েই কোনো কবি চিত্রকলার প্রতি আকর্ষণ বোধ করেন। সাধারণত, যে-কবি আঁকেন তিনি শব্দ দিয়ে যা প্রকাশ করতে পারেন না তাকেই তিনি রং ও কাঠামোর মাধ্যমে প্রকাশ করার চেষ্টা করেন। যে-শিল্পী লেখেন, তার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে। আর্প-এর কবিতা তার চিত্রকলার বিমূর্ত আভিজাত্যের সামনে রসবোধ ও অদ্ভূত কল্পনায় মোড়ানো বিপরীত এক রূপ। (আঁরি) মিশোর মধ্যে ছন্দোময় স্ফূর্তির অনিবার্যতাসহ ভাষাতীত সুভাষিত সংকেতগুলো দৃশ্যময় কুহক হয়ে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথের নির্দিষ্ট কিছু রংয়ের অভিব্যক্তি তার বহু সুরের গীতলতার চটচটে মিষ্টতার আধিক্যের ক্ষতি পুষিয়ে দেয়।

No es extraño que un poeta con estas precupaciones se sienta atraido por la pintura. En general, el poeta que pinta trata de expresar con las formas y colores aquello que no puede decir con las palabras. Lo mismo sucede con el pintor que escribe. La poesia de Arp es un contrapunto de fantasia y humor frente a la abstracta elegancia de su obra plastica. En Michaux la pintura y el dibujo con esencialmente encantaciones ritmicas, signos mas alla del lenguaje articulado, magia visual. El expresionismo de ciertas tintas de Tagore nos compensa con su violencia de la pegajosa dulzura de muchas de sus melodias. (In/Mediaciones, Octavio Paz, Editorial Seix Barral, 1979, P 216)

খেয়ালি ছন্দে রচিত রবীন্দ্রনাথের এই মাতাল চিত্রকর্মগুলো সম্পর্কে পাসের এই উক্তির সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের মনে পড়বে চিত্রকলা সম্পর্কে তাঁর প্রগাঢ় পাণ্ডিত্যের কথা যা তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছিল মার্সেল দুশাম্প সম্পর্কে Marcel Duchamp: Appearance shipped Bare, একেবারে ব্যতিক্রমধর্মী একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ রচনায়। তারও অনেক পরে, ১৯৮৭ সালে বেরিয়েছিল Essays on Mexican Art নামের এক গ্রন্থ। রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা সম্পর্কে পাসের প্রবন্ধ এবং পরবর্তীকালে তাঁর বিভিন্ন মন্তব্য যে কোনও ঝোঁকের বশে বা হুজুগে নয়, বরং চিত্রকলা সম্পর্কে তার সুগভীর পাণ্ডিত্য ও উপলব্ধি থেকে উৎসারিত– তা সেই পূর্বোক্ত প্রবন্ধ (Los manuscritos de Rabindranath Tagor) থেকেই বোঝা যায়। তিনি শিল্পকলা ও সংস্কৃতির বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটেই রবীন্দ্রনাথের চিত্রকর্মের স্বতন্ত্র স্পন্দন ও আত্মার আশ্চর্য্যকে শনাক্ত করেছিলেন। সেই বিশ্লেষী প্রবন্ধে তিনি যে বলেছিলেন, “রবীন্দ্রনাথের হৃদয়গ্রাহী পাণ্ডুলিপি আমাদের কাছে এমন এক শিল্পীকে তুলে ধরে, যিনি একই সঙ্গে আমাদের পূর্বসূরী ও সমকালীন।” (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পাণ্ডুলিপি, এল সিগনো ই এল গারাবাতো, ১৯৭৩), তখন তিনি মোটেই বাড়িয়ে বলেন না, বরং রবীন্দ্রনাথের প্রতিভার অপেক্ষাকৃত আচ্ছাদিত ও অনালোকিত দিকটিকে আমাদের সামনে স্পষ্ট করে দিয়ে বুঝিয়ে দেন রবীন্দ্রনাথের বহুমুখী প্রতিভার বহুবর্ণিল রূপটিকে। রবীন্দ্রনাথের অন্যসব রচনার প্রাচুর্যের পাশে তাঁর চিত্রকলাকে আমরা সমান গুরুত্বে দেখিনি আজও। যদিও রবীন্দ্রনাথ নিজেই তাঁর চিত্রকর্মের গুরুত্ব সম্পর্কে গভীর আস্থার সঙ্গে ঘোষণা করেছিলেন যে, "আমার বাকি সমস্ত শিল্পকর্ম সম্পর্কে এখন আমার আগ্রহ নেই। একমাত্র যার জন্যে আমি গর্বিত: তা আমার ছবি।’ (রম্যাঁ রলাঁ, ভারতবর্ষ: দিনপঞ্জী ১৯১৫-১৯৪৩, ফরাসি থেকে অনুবাদ: অবন্তীকুমার সান্যাল, দ্বিতীয় মুদ্রণ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৯,পৃ-২৫৫)

ভাবতে আশ্চর্য লাগে, কয়েক দশকের ব্যবধানে, রবীন্দ্র-ব্যক্তিত্ব মূল্যায়নের ক্ষেত্রে, প্রথার কল্লোল উজিয়ে রবীন্দ্রনাথের এই গভীর আস্থারই প্রতিধ্বনি করেছেন অক্তাবিও পাস।

রবীন্দ্রনাথের বহুবিধ পরিচয়ের কথা সারা বিশ্ব জানলেও, চিত্রকর রবীন্দ্রনাথের পরিচয়টি এখনও পর্যন্ত অন্য পরিচয়গুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে-পড়া বলে মনে হয়, তা সে ইওরোপেই হোক, কি এশিয়াতেই হোক। লাতিন আমেরিকাতেও কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, শিক্ষাগুরু হিসেবে তার বিপুল পরিচিতি থাকলেও চিত্রকর রবীন্দ্রনাথের স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কে অক্তাবিও পাস ছাড়া আর কেউই লেখেননি। লাতিন আমেরিকায় রবীন্দ্র-পরিচয়ের এই অপূর্ণ দিকটিকে অক্তাবিও পাস তার অসামান্য শিল্পবোধ দিয়ে পূরণ করেছিলেন। কেবল লাতিন আমেরিকাতেই নয়, সম্ভবত সারা বিশ্বেই, রবীন্দ্রনাথের চিত্রকর পরিচয়ের গুরুত্বকে তিনি–পৃথিবীর প্রথমসারির সৃজনশীল ব্যক্তিত্ব হিসেবে যে গভীরতায় স্পর্শ করেছেন তা আর কেউই করতে পারেননি।

More Articles