বাংলার রাজনীতিতে বিজেপির দিন শেষ? যে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে

বাংলার মানুষ বিজেপিকে আর বিশ্বাস করতে পারছে না। গেরুয়া-শিবিরের সিংহভাগ লোকজনও এমনটাই মনে করছেন। দলের কর্মীদের ধারণা, পরবর্তী নির্বাচনে দলের নির্বাচিত সাংসদ বা বিধায়কদের একজনের পক্ষেও আসন টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।

অদূর ভবিষ্যতেও বঙ্গ-রাজনীতির মূল স্রোতে বিজেপির ফেরা কঠিন। উত্তর এবং দক্ষিণবঙ্গের সাম্প্রতিক নির্বাচনের ফলাফল স্পষ্টভাবে সেই বার্তাই দিয়েছে।

রাজ্যে একুশের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির প্রাপ্ত ভোট কমে এখন তলানিতে। বিধানসভা নির্বাচনে গেরুয়া শিবিরের পাওয়া ৩৮ শতাংশ ভোট কিছুদিন আগে হয়ে যাওয়া ১০৮টি পুরসভা ভোটে ঠেকেছিল ১৩ শতাংশে। সদ্যসমাপ্ত শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদ এবং দক্ষিণবঙ্গের ৬টি পুর ওয়ার্ডের উপনির্বাচনের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, এই মুহূর্তে ১৩ শতাংশ ভোটও বিজেপির সঙ্গে নেই। একদিকে সাধারণ মানুষ যখন ভোট দিচ্ছে না, তখনও বিজেপির অন্দরে চালু নিজস্ব 'গৃহদাহ কর্মসূচি'। ফলে এই দলকে ভরসাযোগ্য মনে করার ন্যূনতম কারণও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আর এই দায় বিজেপিকেই নিতে হবে।

এই প্রথমবার শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদ দখলে পেল তৃণমূল। গত ৫ বছর এই বোর্ড সামলেছে বামেরা। শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদের অন্তর্গত গ্রাম পঞ্চায়েতে মোট আসন ২২টি। এর মধ্যে তৃণমূল পেয়েছে ১৯টি। ত্রিশঙ্কু ৩। পঞ্চায়েত সমিতিতে ৬৬টি আসনের মধ্যে তৃণমূল ৫৪টি, বিজেপি ১০টি, নির্দল ২টি আসন পেয়েছে। মহকুমা পরিষদের ৯টি আসনের মধ্যে তৃণমূল ৮টি, বিজেপি ১টি পেয়েছে। দক্ষিণবঙ্গে যে ৬টি পুর ওয়ার্ডে উপনির্বাচন হয়েছে, তার ৪টিতে জিতেছে তৃণমূল। বাকি দু'টি গিয়েছে কংগ্রেস ও সিপিএমের ঝুলিতে। এই ফল বলছে, বঙ্গ-রাজনীতিতে অনেকটাই ঝাপসা হয়ে গিয়েছে বিজেপি। তবে জিতলে মহকুমা পরিষদের সভাধিপতি হতেন তৃণমূল প্রার্থী কাজল ঘোষ, এমনই জল্পনা ছিল নির্বাচনের আগে। নির্বাচনে তৃণমূলের জয়জয়কার হলেও খড়িবাড়ি ব্লকের বিন্নাবাড়ি-রানিগঞ্জ ৫ নম্বর আসনে বিজেপির এক অনামী প্রার্থী অজয় ওঁরাওয়ের কাছে হারতে হয়েছে শিলিগুড়ির এই ডাকসাইটে নেতা কাজল ঘোষকে। স্থানীয় তৃণমূলের একাংশ অবশ্য বলেছে, এই হারের পিছনে তীব্র দলীয় কোন্দল অনুঘটকের কাজ করেছে। সমস্যা ছিল প্রার্থীকে নিয়েই। ফলে এই জয়ে বিজেপির কৃতিত্ব কম।

আরও পড়ুন: ত্রিপুরায় রাজধানী থেকেই নিকেশ বিজেপি, চাণক্যের নাম সুদীপ রায় বর্মন

সদ্যসমাপ্ত এই নির্বাচন ফের ঝুঝিয়েছে বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকে জেলায় জেলায় গেরুয়া শিবিরে যে ধস নামতে শুরু করেছিল, তা অব্যাহত৷ পুরভোটের ফলাফলে তারই মাশুল গুনতে হয়েছে বিজেপিকে। বঙ্গ বিজেপিতে হয়েই চলেছে রক্তক্ষরণ। শুধু ব্লক, গ্রাম বা জেলা স্তরেই নয়, অভ্যন্তরীণ কোন্দলের তীব্রতা বৃদ্ধি পাওয়ায় রাজ্য কমিটির গা থেকেও সশব্দে খসে পড়ছে পলস্তারা। রাজ্য নেতাদের একাংশ ক্রমাগত পরস্পরের বিরুদ্ধে কাদা ছুড়ছেন। তাতে সাধারণ মানুষ তো বটেই, দীর্ঘদিনের বিজেপি সমর্থকরাও এখন তিতিবিরক্ত। রাজনৈতিক প্রজ্ঞাহীন তথা সাংগঠনিক ভাবনাচিন্তাহীন কিছু লোকজন বঙ্গ বিজেপিকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এমন লোকজন অবশ্য আগেও ছিল। তবে তাঁরা গায়ে-গতরে খেটে ফাঁকটা ভরাট করার চেষ্টা করেছেন। ইদানীং সেই প্রচেষ্টা বিলুপ্ত হয়েছে। যে কোনও দলের শীর্ষ পদে কাউকে বাছাই করা হলে সেই ব্যক্তির বিশ্বস্ততা বা সংগঠনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ন্যূনতম যোগ্যতা কতখানি, তা যাচাই করার পাশাপাশি দেখা হয় সেই ব্যক্তি কতখানি গ্ল্যামারাস, কতখানি পরীক্ষিত, তাঁর নামে কোনও পথসভায় পাঁচটা বাড়তি লোক আসেন কি না। বঙ্গ বিজেপির একাংশই বলেছেন, দলের রদবদলে এসবের কিছুই বিবেচিত হয়নি। বর্তমান রাজ্য সভাপতি শিক্ষিত, পরিশীলিত, মার্জিত এবং বিশ্বস্ত হলেও বাকি কোনও রাজনৈতিক গুণের অধিকার এখনও অর্জন করে উঠতে পারেননি। অন্যান্য পদাধিকারীরা এখনও জনমানসে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। সাধারণ মানুষ জানেই না, ওই দলের অন্যান্য পদে কারা আছেন। এরা সম্ভবত এখনও আছেন অনেকটা 'অ্যাপ্রেন্টিস' মোডে। ছোট বা বড় ভোটের প্রচারে সামান্যতম দাগ কাটতেও যে এঁরা ব্যর্থ, তা প্রথম ধরা পড়ে কলকাতা পুরভোটের সময়। তারপর ১০৮টি পুরসভার ভোটেও একই ছবি।

সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনে তা আরও নগ্নভাবে সামনে এসেছে। বিগত বিধানসভা নির্বাচনের সময় যে যাইই ভাবুক, বাংলার মানুষ এখন আর বিজেপিকে তৃণমূলের বিকল্প শক্তি হিসেবে মানতেই চাইছে না। এই না-মানার একমাত্র কারণ, বঙ্গ বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বর সামগ্রিক ব্যর্থতা। সাম্প্রতিক কোনও নির্বাচনের প্রচারেই তাঁরা মানুষের সামনে তুলে ধরতেই পারেননি ক্ষমতায় এলে তাঁরা কী কাজ করবেন। উত্তর বা দক্ষিণবঙ্গ, সর্বত্রই এক ছবি। বঙ্গ-বিজেপির প্রাক্তন সভাপতি তথা বর্তমান জাতীয় সহ-সভাপতি ইকো পার্কে প্রাতঃভ্রমণ করতে যতখানি ব্যস্ত ছিলেন, তার একাংশ এনার্জিও দেখা যায়নি ভোট প্রচারে। বিরোধী দলনেতা ক্যামেরা ছাড়া কোথাও যান না, শুধুমাত্র প্রচারের ওপর টিকে আছেন। মোদি-শাহর স্টাইলে দু'-চারটি সভা করেই দায় সেরেছেন তথাকথিত রাজ্য নেতারা। যদি এই মানসিকতা নিয়ে ভোট করেন, তাহলে এর থেকে ভালো ফল হবে কেন? তাই প্রতি ভোটের শেষে বিজেপির 'ফটোকপি' বয়ান, "ভোট লুঠ হয়েছে, সন্ত্রাস হয়েছে, আমাদের ভোট দিতে দেওয়া হয়নি।" সাধারণ মানুষের কাছে প্রত্যাখ্যাত বঙ্গ বিজেপির ভাবখানা এমনই, "একটুর জন্য ক্ষমতা হাতছাড়া হয়েছে। মানুষ ভোট দিতে পারলেই আমাদের জয় নিশ্চিত ছিল।" একবারও ভাবছে না, দিশাহীন, নড়বড়ে এই বিজেপিকে সাধারণ মানুষ কেন ভোট দেবে?

গত বিধানসভা ভোটে শিলিগুড়ি পুর এলাকায় ভালো ফল করেছিল বিজেপি। এবার সেসব ছবি হয়ে গিয়েছে। দলের বিধায়ক নিজের বুথে, নিজের পাড়ার হেরেছেন। ঘুরে দাঁড়ানো তো দূরের কথা, নিজেদের ভোটও ধরে রাখতে পারেনি বিজেপি। আসানসোলে জিতেন্দ্র তিওয়ারি, অগ্নিমিত্রা পলেরা নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। পর পর দু'বারের সাংসদ বাবুলের অনুপস্থিতি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে বিজেপি। গেরুয়া-শিবির এমন কাউকে সামনে রাখতে পারেনি, যার হাত ধরে, যার বুদ্ধিতে, দল ঘুরে দাঁড়াতেই পারে। একই ছবি সর্বত্র। মমতা-সুনামিতে খড়কুটোর মতো উড়ে গিয়েছে পদ্ম-বাহিনী। কোথাও তৃতীয়, কোথাও চতুর্থ হয়েও ঢাক পেটানো বন্ধ করছে না কিছু নেতা। নিশ্চিহ্ন হয়েও অশৌচ পালনের কোনও তাগিদই নেই বঙ্গ বিজেপির। এর আগে রাজ্যজুড়ে হয়ে যাওয়া পুরভোটের পর কর্মীরা প্রশ্ন তুলেছিলেন, ভোটের দিন পুর এলাকাগুলিতে দলের ক'জন কর্মী সক্রিয় ছিলেন? কেন তাঁরা ছিলেন না? রাজ্য নেতারা একবারও তা ভেবেছেন? নেতাদের ভাবার সময় কোথায় ? কেউ ব্যস্ত মিডিয়ায় বিপ্লব করতে, কেউ ব্যস্ত আজগুবি, অপ্রাসঙ্গিক কথা বলে নিজেকে প্রাসঙ্গিক রাখতে, আবার কেউ কেউ দূরে দাঁড়িয়ে মজা লুটছেন, কখন এই বিজেপি মুখ থুবড়ে পড়ে! এমন হবুচন্দ্রর দলের ভবিষ্যৎ কী হতে পারে, তা বুঝতে রকেট-সায়েন্টিস্ট হতে হবে না।

বিজেপির নিচুতলার কর্মীরা সংগতভাবেই তাই আজ প্রশ্ন তুলছেন, তৃণমূলের সন্ত্রাসের জন্য দলের ভরাডুবি হচ্ছে, অজুহাত হিসেবে এমন কথা আর কতদিন বলা হবে? দলের নেতা-বিধায়কদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে কেন এলাকায় এলাকায় মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে না? কলকাতার মতো তৃণমূল-দুর্গে জয়ী বিজেপি কাউন্সিলর সজল ঘোষ শাসক দলের চোখে চোখ রেখে কথা বলে সাফল্য পেয়েছেন। সেটা দেখার পরেও কেন রাজ্য নেতাদের চৈতন্য হলো না?

বিজেপি এভাবে ধরাশায়ী হওয়ায় মুছে যাওয়া বামেরা এখন আহ্লাদিত। সিপিএম নেতা-কর্মীরা বলছেন, বাংলার বিরোধী রাজনীতির পরিসরে উঠে আসছে বামেরা। উঠে আসার নমুনা হিসেবে চন্দননগরের ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে জয়ের কথা তুলে ধরছে। কিন্তু একবারও বলছে না, উত্তরবঙ্গের নির্বাচনে কেন ধরাশায়ী হতে হলো।

আসলে বাংলার মানুষ বিজেপিকে আর বিশ্বাস করতে পারছে না। গেরুয়া-শিবিরের সিংহভাগ লোকজনও এমনটাই মনে করছেন। দলের কর্মীদের ধারণা, পরবর্তী নির্বাচনে দলের নির্বাচিত সাংসদ বা বিধায়কদের একজনের পক্ষেও আসন টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। তাঁরা বলছেন, এখনই বলে দেওয়া যায়, সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রত্যাখ্যানই অপেক্ষা করছে বিজেপির জন্য।

বঙ্গ-রাজনীতির মূল পর্বে সম্ভবত আর কখনওই খেলতে পারবে না ভারতীয় জনতা পার্টি।

 

More Articles