অগ্নিপথ থেকে দলীয় কোন্দল, ঘরে-বাইরে চাপ! এই মুহূর্তে নির্বাচন হলে কী হবে বিজেপির?
ঘরে-বাইরে অস্বস্তি বেড়েই চলেছে বিজেপি-র। পরিস্থিতি যেদিকে গড়াচ্ছে, তা দেখে রাজনৈতিক মহলের অভিমত, এই মুহূর্তে লোকসভা নির্বাচন হলে বিজেপির পরাজয় নিশ্চিত।
ঘরে-বাইরে অস্বস্তি বেড়েই চলেছে বিজেপি-র। পরিস্থিতি যেদিকে গড়াচ্ছে, তা দেখে রাজনৈতিক মহলের অভিমত, এই মুহূর্তে লোকসভা নির্বাচন হলে বিজেপির পরাজয় নিশ্চিত।
'অগ্নিপথ’ নিয়ে বিহার, হরিয়ানা, তেলেঙ্গানা-সহ একাধিক রাজ্য অগ্নিগর্ভ। প্রতিবাদীদের অগ্নিসংযোগের ঘটনায় এখনও পর্যন্ত রেলের ক্ষতি হয়েছে ৭০০ কোটি টাকার। পরিস্থিতি সামাল দিতে তিন সেনাপ্রধানের সঙ্গে রবিবার জরুরি বৈঠক করতে হয়েছে প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং-কে। আলোচনার পর সরকারের তরফে সাংবাদিক বৈঠক পর্যন্ত করেছেন সেনাকর্তারা। তবুও ছবি বদলাচ্ছে না।
আর এর মাঝেই আগুনে ঘি ঢেলেছেন বিজেপির অন্যতম সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক এবং পশ্চিমবঙ্গে দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা কৈলাস বিজয়বর্গীয়। রবিবার মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরে এই অগ্নিপথ প্রকল্প কত ভালো তা বোঝাতে গিয়ে বলেছেন, ‘অগ্নিবীরদের বিজেপি অফিসে গার্ডের চাকরি দেব।' এই বেফাঁস মন্তব্য আন্দোলনকারীদের হাত আরও শক্ত করে দিচ্ছে। বিরোধী নেতা-নেত্রীরা তো বটেই, বিজেপি সাংসদ বরুণ গান্ধীও এই মন্তব্যের কড়া সমালোচনা করে এক টুইটে বলেছেন, ‘সেনাবাহিনীতে যোগদান শুধুমাত্র একটি চাকরি নয়। দেশের সেবা। এই কথা বুঝতে হবে।’ কংগ্রেস মুখপাত্র সাংসদ জয়রাম রমেশের বলেছেন, "আজ বোঝা যাচ্ছে, ২০১৯ সালে কেন বিজেপির প্রচার স্লোগান ছিল, ‘ম্যায় ভি চৌকিদার।" তৃণমূল কংগ্রেসের তরফে টুইট করে বলা হয়েছে, ‘দেশের যুবসমাজের দায়িত্ব বিজেপি অফিসের দ্বাররক্ষী হওয়া নয়। যুবসমাজ দেশের সেবা করতে চায়। প্রধানমন্ত্রীর উচিত এই মন্তব্যের ক্ল্যারিফিকেশন দেওয়া।’
The youth of India is not meant to be door keepers of @BJP4India offices.
— All India Trinamool Congress (@AITCofficial) June 19, 2022
The young power wants to serve this nation unlike the Modi government. The Prime Minister should clarify whether these are also comments by 'fringe' elements.https://t.co/CGbbqTM27z
শুধু কৈলাস বিজয়বর্গীয় নন, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জি কিষেন রেড্ডিও এই বিতর্ক আরও উসকে দিয়েছেন। তিনি স্পষ্ট বলেছেন, ‘অগ্নিপথে দক্ষতা বৃদ্ধির পথেও হাঁটবে কেন্দ্র। নাপিত, ধোপা, ইলেকট্রিশিয়ান, ড্রাইভারের কাজ শেখানো হবে। ৪ বছর ট্রেনিংয়ের পর এই ট্রেনিং তাঁদের কাজে লাগবে।’
আরও পড়ুন: অগ্নিপথ-এর নেপথ্যে আসলে আরএসএস? যে প্রশ্ন উঠে আসছে
প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে কি যুবকদের বাহিনীতে নেওয়া হবে এসব কাজ করানোর জন্যই? যুব সম্প্রদায় দেশের সেবা করবে বলে সেনা হতে চায়। বিজেপি পার্টি অফিসের দারোয়ান বা ধোপা, নাপিত, ড্রাইভার হতে কেউ সেনাবাহিনীতে যোগ দেয় না। বিজেপি দেশের যুব সম্প্রদায়কে ঠান্ডা মাথায় অপমান করছে। গেরুয়া নেতাদের এই ধরনের মন্তব্যে বিজেপি শীর্ষ নেতারা আরও চাপে পড়ে গিয়েছেন।
অন্যদিকে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে 'ক্রস ভোটিং'-এর বেনজির চাপে বিজেপি। ভোটের পাটিগণিত বলছে, এনডিএ প্রার্থীকে জিতিয়ে আনতে ন্যূনতম যত সংখ্যক ভোট প্রয়োজন, তার থেকে কম পড়ছে ২.৯৭ শতাংশ ভোট। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হয় গোপন ব্যালটে। এই ভোটে কোনও দলীয় ‘হুইপ’ দেওয়া যায় না। প্রেফারেন্স ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হন রাষ্ট্রপতি ৷ প্রেফারেন্স ভোট দেওয়া যায় এমন প্রযুক্তি থাকা ইভিএম এখনও তৈরিই হয়নি। ফলে ভোট হবে সেই ব্যালট পেপারের মাধ্যমেই। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য যে ধরনের ব্যালট পেপার ব্যবহার করা হয়, সেখানে থাকে মাত্র দু'টি কলাম। বাঁদিকের কলামে এই ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা প্রার্থীদের নাম থাকে। আর ডানদিকে প্রত্যেক প্রার্থীর নামের পাশে থাকে ফাঁকা চৌকো বাক্স। এই বাক্সেই ভোটাররা নিজেদের পছন্দ অনুসারে ১,২,৩ লিখে দেন। কোনও প্রার্থীর নামের পাশে '১' লেখার অর্থ, সংশ্লিষ্ট ভোটার ওই প্রার্থীকেই ফার্স্ট প্রেফারেন্স ভোট দিয়েছেন। এভাবেই সেকেন্ড, থার্ড প্রেফারেন্স ভোট দেওয়া যায়। এইখানেই রক্তচাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে মোদি, শাহ, নাড্ডার। মন্ত্রিত্ব না পাওয়া বা মন্ত্রিত্ব খোয়ানো মানেকা গান্ধী, বরুণ গান্ধী, রবিশঙ্কর প্রসাদ, প্রকাশ জাভরেকর, জয়ন্ত সিনহার মতো কয়েক ডজন বিজেপি সাংসদ দীর্ঘদিন ধরেই ক্ষোভে ফুঁসছেন। গোপন ব্যালটের সুযোগ নিয়ে এই সাংসদরা বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বকে 'শিক্ষা' দিতে পারেন, এমন উদ্বেগেই ঘুম ছুটেছে মোদি-শাহ-র।
এইসব চাপ সামলাতেই যখন দিশাহারা বিজেপি, ঠিক তখনই দলের অন্দর থেকেই বড়সড় তোপ ধেয়ে গিয়েছে শীর্ষ গেরুয়া নেতৃত্বের দিকে। এই তোপ সামলাতে না পারলে পদ্ম-শিবিরের ছন্নছাড়া চেহারা প্রকাশ্যে চলে আসতে পারে।
নরেন্দ্র মোদি যেভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিক্রি করার মহাযজ্ঞে নেমেছেন, তার প্রতিবাদে ‘সেভ সিপিএসইউ, সেভ নেশন’ কর্মসূচি নিয়ে এবার পথে নামছে বিজেপির শ্রমিক সংগঠন, ভারতীয় মজদুর সংঘ বা বিএমএস।
বিজেপির শ্রমিক শাখার প্রস্তাবিত এই প্রতিবাদ কর্মসূচিতে বলা হয়েছে দেশের মোট ৬-টি শহরে জাতীয় সমাবেশ করা হবে৷ এই ৬-টি শহরের মধ্যে চারটি শহরই বিজেপি-শাসিত রাজ্যের অন্তর্গত। বিএমএস স্পষ্ট জানিয়েছে, উত্তরপ্রদেশ থেকেই প্রতিবাদ আন্দোলন শুরু হবে৷ আগামী ১০ জুলাই উত্তরপ্রদেশের কানপুরে হবে মোদির রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিক্রির প্রতিবাদে প্রথম জাতীয় সমাবেশ। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়, প্রধানমন্ত্রী নিজেই উত্তরপ্রদেশের সাংসদ। আর সেই রাজ্যে দাঁড়িয়েই বিজেপির শ্রমিক সংগঠন বিএমএস মোদির বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
কানপুর সমাবেশের পর বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলির আর কোন শহরে জাতীয় সমাবেশ করবে বিএমএস, তাও জানিয়েছেন সংগঠনের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক বিনয়কুমার সিনহা। তিনি বলেছেন, আগামী ৩১ জুলাই মধ্যপ্রদেশের ভূপালে সমাবেশ হবে। হরিয়ানার আম্বালায় সমাবেশ হবে আগামী ৭ আগস্ট৷ অসমের গুয়াহাটিতেও এই ইস্যুতে জাতীয় সমাবেশ হবে। বিজেপি-শাসিত এই ৪ রাজ্যের পাশাপাশি আগামী ২৪ জুলাই কেরলের কোচিতে এবং ২৯ আগস্ট ওড়িশার ভুবনেশ্বরে জাতীয় সমাবেশ করবে বিএমএস। গেরুয়া শিবিরের শ্রমিক সংগঠনের এই ধরনের কেন্দ্র- বিরোধী আন্দোলনকে যথেষ্টই গুরুত্ব দিচ্ছে রাজনৈতিক মহল। বিরোধী দলগুলির সুরেই ভারতীয় মজদুর সংঘ বলেছে, দেশের একাধিক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বেসরকারিকরণের উদ্যোগ নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। দেখা গিয়েছে, অনেক ক্ষেত্রেই বাণিজ্যিকীকরণের পথেই হাঁটতে চায় কেন্দ্র। সরকারের এমন সিদ্ধান্ত শ্রমিক-কর্মচারীদের স্বার্থবিরোধী। এর ফলে হাজার হাজার মানুষের চাকরি খোয়ানোর আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। কেন্দ্রের এই কাজের প্রতিবাদ জানানো জরুরি। বিএমএস জানিয়েছে, তাদের এই ‘সেভ সিপিএসইউ, সেভ নেশন’ কর্মসূচিতে দেশের পাওয়ার, টেলিকম, ব্যাঙ্কিং, ইঞ্জিনিয়ারিং, বিমা'র মতো রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার কর্মীরা তো বটেই, একই সঙ্গে প্রতিরক্ষা, রেল, ডাক বিভাগে কর্মরত কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীরাও যোগ দেবেন। প্রথম দফার এই কর্মসূচিতে কেন্দ্রের ঘুম না ভাঙলে পরবর্তীতে এই ইস্যুতেই জাতীয় স্তরে অন্যান্য বাম ও ডানপন্থী শ্রমিক সংগঠনগুলির সঙ্গেও যৌথভাবে মোদি-বিরোধী আন্দোলনে নামতে পারে বিএমএস, এমন ইঙ্গিতও দেওয়া হয়েছে।
সব মিলিয়ে প্রবল ঘরোয়া দ্বন্দ্বে প্রায় বিবস্ত্র হওয়ার মুখে ভারতীয় জনতা পার্টি।