বয়কট বলিউডের আহ্বান কতটা সমস্যায় ফেলতে পারে রণলিয়ার 'ব্রহ্মাস্ত্র'-কে?

Boycott Bollywood trend: বলিউড থেকে টলিউড। হিন্দি থেকে বাংলা। সর্বত্র নামছে বয়কটের ঢল।

বক্স অফিস। কালেকশন। হিট। ফ্লপ। সিনেমা এবং বিনোদনের এই চেনা শব্দবন্ধেই আচমকা প্রবেশ 'বয়কট'-এর। হঠাৎ করে ঠিক নয়, এই শব্দের চিরাচরিত পরিচিতি থাকলেও সমসাময়িক বিনোদন-প্রেক্ষাপটে যার মাত্রা বেড়েছে। বলা ভাল, তীব্রতা বেড়েছে নিরন্তর। বলিউড থেকে টলিউড। হিন্দি থেকে বাংলা। ২০১৪ পরবর্তী বিজেপি সরকারের অধীনে বয়কট অস্ত্রে আরও শোরগোল ফেলেছে নেটপাড়া। একের পর এক ছবি মুক্তির আগেই ডুবে গিয়েছে না দেখার আবেদনের অতলে। করোনাকালে সিনেমা হলে ছবিমুক্তি প্রায় বন্ধ থাকার পরে ২০২২ আসতেই এই ধারা বাড়তে থাকে। একের পর এক ছবি বয়কটের ডাকে সরব হন নেটিজেনদের একাংশ।

সম্প্রতি সেই তালিকায় যোগ হয়েছে রানি মুখোপাধ্যায়ের ভাই, অয়ন মুখোপাধ্যায় পরিচালিত 'ব্রহ্মাস্ত্র'। যে ছবিতে মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেছেন রণবীর কাপুর ও আলিয়া ভাট। প্রসঙ্গত, এই প্রথম কোনও ছবিতে অনস্ক্রিন রসায়ন দেখা যাবে রণলিয়া-র। এই ছবি ৯ সেপ্টেম্বর মুক্তি পাওয়ার আগেই বিতর্ক চরমে। বলিউডের একাধিক ছবির মতোই সমস্যায় ব্রহ্মাস্ত্র নির্মাতারা। ৬ সেপ্টেম্বর সেই বিতর্কে আগুন লাগে উজ্জ্বয়নীর মহাকালেশ্বর মন্দিরে। যেখানে 'বজরং দল'-এর তুমুল বিক্ষোভের মুখে পড়েন রণবীর, আলিয়া। শুধুমাত্র অয়ন মন্দিরে প্রবেশ করে বিগ্রহ দর্শন করতে সমর্থ হন। পুজো না দিয়েই ফিরতে হয় গর্ভবতী আলিয়া এবং তাঁর স্বামীকে। অভিযোগ, গোমাংস খাওয়া নিয়ে হিন্দু ভাবাবেগে আঘাত করেছেন রণবীর। যাঁর ছবিতেও সেই ভাবাবেগেই আঘাতের অভিযোগ উঠেছে। কেন এই অভিযোগ?

২০১১ সাল। কংগ্রেস শাসনাধীন ভারতে মুক্তি পেল ইমতিয়াজ আলি পরিচালিত, রণবীর কাপুর অভিনীত 'রকস্টার'। দাবি, এই ছবির প্রচারে গিয়ে একটি অনুষ্ঠানে ক্যামেরার সামনে রণবীর বলেন, ''আমাদের পরিবার পেশোয়ার থেকে আগত। আমরা গরুর মাংসের নানা পদ খায়। ভাল লাগে খেতে।'' হঠাৎ করে রণবীরের বলা ওই মন্তব্যের ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। যা নিয়ে দাবি করা হচ্ছে, হিন্দুধর্মে পূজিত গোমাতা সম্পর্কে অপমানজনক মন্তব্য করেছেন হিন্দু পরিবারের সন্তান রণবীর। এই মন্তব্য হিন্দু ভাবাবেগে আঘাত দিয়েছে। যা তাঁর 'ব্রহ্মাস্ত্র' ছবিতেও হয়েছে। যদিও ছবি মুক্তির আগেই শুধুমাত্র ছবির ট্রেলার বা ঝলক দেখে কী ভাবে এই দাবি করা হচ্ছে, তা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন।

আরও পড়ুন: বলিউডের নতুনরা খারাপ ছাত্র, সকলে শুধু বিখ্যাত হতে চায়: তিগমাংশু ধুলিয়া

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই বছরের জুলাইয়ে করণ মালহোত্রা পরিচালিত, রণবীর কাপুর অভিনীত 'শামসেরা' মুক্তি পায়। এই ছবি ১৫০ কোটি খরচে তৈরি হলেও চলেনি। ছবি বয়কটের খুব একটা প্রভাব এখানে না থাকলেও ফ্লপ হয় এই ছবি। যদিও বয়কট ট্রেন্ড সম্পর্কে রণবীরের মত, ''ছবির বিষয়বস্তু যদি ভাল হয় কেউ আটকাতে পারবে না, ছবি চলবেই। কে না চায় সিনেমা দেখে হাসতে-কাঁদতে-আনন্দ পেতে!'' যদিও ব্রহ্মাস্ত্র বয়কটের ট্রেন্ডে যথেষ্ট চিন্তিত নির্মাতারা। প্রায় ৪০০ কোটি ব্যয়ে এই ছবি তৈরি হয়েছে। ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে যা সর্বোচ্চ বলে দাবি করা হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে যদি ছবি না চলে, মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হবেন তাঁরা।

কিন্তু 'বয়কট' ট্রেন্ড করলেই ছবি চলবে না, এই আশঙ্কার মেঘ কেন জমছে? সামগ্রিক কিছু ঘটনাবলি এর স্বপক্ষে প্রামাণ্য হতে পারে। এই বছরে মুক্তি পাওয়া আমির খানের 'লাল সিং চড্ডা'। যে ছবিতে ধর্মীয় এবং জাতীয়তাবাদের ভাবাবেগে আঘাত দেওয়া হয়েছে বলে বয়কট করা হয়। ছবিটি চলেনি। সাম্প্রতিককালে, ঋত্বিক রোশন অভিনীত 'বিক্রম ভেদা' ছবির ট্রেলার মুক্তির পরেই এই ট্রেন্ড শুরু হয়েছে। এছাড়াও বয়কট প্রভাব এসে দাঁড়িয়েছে বাংলায়। রাজ চক্রবর্তী পরিচালিত 'ধর্মযুদ্ধ' ছবি বয়কটের ট্রেন্ড উঠেছে নেট-জগতে। যা নিয়ে তীব্র বিরোধিতা করে রাজ বলেন, ''এসব করছে একটি রাজনৈতিক দল এবং তাদের আইটি সেলের লোকেরা। যারা ছবি না দেখেই এসব বলছে।'' এদিকে শুধুই রাজের 'ধর্মযুদ্ধ' নয়, বয়কটের তালিকায় ঢুকেছে ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তের 'বিসমিল্লাহ্'। যে প্রসঙ্গে অভিনেতা ঋদ্ধি সেন বলেন, ''এগুলো যাঁরা করছেন না পড়েই। এঁরা শুধু বাংলার ইতিহাস পড়লেই বুঝতেন বাংলা কতটা স্বাধীনচেতা।'' বয়কটের ধারা থেকে বাদ যায়নি কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের 'লক্ষ্মী ছেলে'-ও। যদিও এই ছবি দর্শকমহলে বিপুল সাড়া ফেলে। ছবি মুক্তির সময়ে বয়কট নিয়ে কৌশিক বা ছবির প্রযোজক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, নন্দিতা রায় কিছু না বললেও 'উইন্ডোজ প্রোডাকশন'-এর তরফে ইউটিউবার এবং ছবির কলাকুশলীদের একটি আলোচনায়, বয়কট প্রসঙ্গে কৌশিক কটাক্ষের সুরে বলেন, ''বয়কট বানান করতে পারে না, বয়কট লিখছে!'' নন্দনে দাঁড়িয়ে পরিচালক মন্তব্য করেন, ''এই সময়ে দাঁড়িয়ে 'লক্ষ্মী ছেলে'-র মতো ছবি ভীষণ প্রয়োজনীয়।'' ছবি বয়কট এবং তার প্রভাবে ছবি না চলার নিদর্শন যেমন আছে আবার ছবির গল্প বা নির্মাণের ঘাটতির জন্য বয়কটের খাতায় নাম লেখানো ছবির না চলার যুক্তিও রয়েছে। কিন্তু বয়কট এবং নেট-জগতে সেই ট্রেন্ডের বশবর্তী হয়ে ছবি সুপার-ডুপার হিট হয়েছে, এই উদাহরণ ভারতবর্ষজুড়ে রয়েছে। আমরা যদি শুধুমাত্র এই দশকের ইতিহাসের দিকে তাকায়, তাহলে কী দাঁড়ায়?

২০১১। বক্স অফিসে ঝড় তোলে বিদ্যা বালান অভিনীত 'দ্য ডার্টি পিকচার'। দক্ষিণ ভারতের অভিনেত্রী সিল্ক স্মিতার জীবনী নিয়ে তৈরি ১৮ কোটির এই ছবি ব্যবসা করে ১১৭ কোটি। যদিও এই ছবিতে যৌনতা নিয়ে আপত্তি ওঠে। দেশের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে এই ঘটনা, এমন অভিযোগ তোলা হয়। ২০১৩। 'রামলীলা'। রণবীর সিং এবং দীপিকা পাড়ুকোন-অভিনীত সঞ্জয় লীলা বনশালির এই ছবিতে উঠে এসেছিল রাজস্থান, জাতিগত বিভেদ, গোষ্ঠীর লড়াই। এসব নিয়ে বিতর্কের মুখোমুখি হয়। কিন্তু ছবিটি হিট হয়। দেশজুড়ে শুধু নয়, সমস্ত বিক্ষোভ ছাড়িয়ে বিদেশেও চলে এই ছবি। ২০১৪ সাল। বিশাল ভরদ্বাজের 'হায়দার'। নয়ের দশকের জম্মু-কাশ্মীর। মানুষের অধিকার এবং ভারতীয় সেনার অবস্থানের আলোকে শেক্সপিয়রের 'হ্যামলেট'-কে ভিত্তি করে এই সিনেমা তৈরি হয়। শাহিদ কাপুর অভিনীত ছবিটি নিয়েও বিতর্ক শুরু হয়। বয়কট ট্রেন্ডে মারাত্মক না হলেও ছবি বয়কটের একটা প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু ছবিটি বিরাট ব্যবসা না করলেও ফ্লপ হয়নি। ২০১৪ সালে আমির খান অভিনীত 'পিকে' নিয়েও বিতর্ক চরমে ওঠে। মুসলিম অভিনেতার হিন্দুধর্মে ভাবাবেগের অভিযোগ নিয়ে সরব হয় একাধিক সংগঠন। বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ হয়। ছবিটি বক্স অফিসে সাড়া ফেলে। ২০১৬ সালে 'উড়তা পঞ্জাব'। এই ছবি ঘিরেও বিরোধিতার ঝড় ওঠে। কিন্তু আলিয়া ভাট অভিনীত ছবিটি খুব একটা খারাপ ব্যবসা করেনি। ২০১৭ সালে 'লিপস্টিক আন্ডার মাই বুরখা'। এই ছবি নিয়ে মুসলিম ভাবাবেগে আঘাতের অভিযোগ ওঠে। দেশজুড়ে এই ছবিটি খুব একটা চলেনি এবং প্রদর্শনের ক্ষেত্রেও বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। ২০১৮ সালে রানি পদ্মাবতী নিয়ে বিতর্কে জড়ায় সঞ্জয় লীলা বনসালির 'পদ্মাবত'। করনি সেনার তীব্র বিক্ষোভে নামবদল হয় ছবির। কাঁচি চলে সেন্সর বোর্ডেও। কিন্তু ছবিটি প্রচুর টাকার ব্যবসা করে। এছাড়াও 'এনএইচ ১০', 'আর্টিকেল ১৫'-এর মতো সাম্প্রতিককালের বহু ছবিই মুক্তির আগে পড়েছে বিতর্কের মুখে।

প্রশ্ন উঠেছে মুসলিম বা অন্য ধর্ম নয় কেন, শুধু হিন্দুদের নিয়ে এত কাঁটাছেড়া কেন করেন পরিচালক, অভিনেতা অভিনেত্রীরা! যদিও সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের একটি অংশের মত, ছবি বয়কটের পিছনে সূক্ষ্মভাবে হলেও হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির আঁচ রয়েছে। একটা নির্দিষ্ট নীতি এবং আদর্শের বিরোধিতা অথবা সেই সংক্রান্ত সেন্টিমেন্ট নিয়ে নড়াচড়া করলেই সুযোগ পায় ওই নির্দিষ্ট অংশ। আর তখনই এইরকম পন্থার অবলম্বন করা হয়। যদিও ভারত গণতান্ত্রিক এবং এখানে বাধা নেই বলেই হিন্দু দেবদেবী নিয়েও পরীক্ষানিরীক্ষা করা যায়, ছবি বানানো যায়; এমনও বলছেন কেউ কেউ।

More Articles