সোনার বাংলার প্রান্তিক মানুষের কাছে রবীন্দ্রনাথ বেঁচেবর্তে আছেন?
Rabindranath Tagore of Marginal Class: সোনার বাংলার একাংশ রবীন্দ্রনাথকে চেনে না? সত্যিই তো চেনে না। চিনবেই বা কেন! আধিপত্যের গর্ব টুকরো টুকরো হয়ে যায় মুহূর্তে। তেমনটাই হওয়া উচিত।
‘পশ্চিমবাংলার অধিবাসী’, এই পরিচয় দেওয়া মাত্রই মাথায় আসে বাঙালি জাতি, বাংলা ভাষা ও বাংলা সংস্কৃতির কথা। মানচিত্রের দিকে তাকালেও ভেবে নিই, গোটা পশ্চিমবঙ্গ যেন শুধুমাত্র বাঙালির ঘর-গেরস্থালি। আমরা, যারা বাংলা ভাষায় কথা বলি, বাংলা সংস্কৃতির ধারক ও বাহক, জন্মসূত্রে পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা, বিষয়টাকে এভাবেই দেখতে এবং ভাবতে অভ্যস্ত। কিন্তু, রাজধানী শহর থেকে প্রান্তের দিকে যত যাই, দেখি ভিড় করে আছেন অন্যান্য জাতি ও ভাষাভাষী মানুষ। বাঙালির জাতি পরিচয় তৈরি হওয়ার বহু আগে থেকেই তাঁরা বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ নামক রাজ্যটির ভৌগোলিক বৃত্তে বসবাস শুরু করেছেন। কালক্রমে, বাঙালির রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যের নিচে চাপা পড়ে গেছে তাঁদের পরিচয়। আজ তাঁরা প্রান্তিক। সরকারি আইনে, দলিল-দস্তাবেজে তাঁদের পরিচয় ‘আদিবাসী’, ‘অন্যান্য তপশিলি জাতি ও উপজাতি’। সভ্যতার অভিঘাতে তাঁদের ভবিষ্যতের উচ্ছেদ, কিম্বা পরিযান। শেষমেষ, তাঁরা আধিপত্যকারী ভাষা-সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে যান। অথবা, চিরতরে হারিয়ে যান পৃথিবীর বুক থেকে।
রাজ্যের উত্তর-পূর্ব প্রান্তের দিকে চলে যাই। তরাই-ডুয়ার্সের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে রয়েছে বন-জঙ্গল ও তৃণভূমি। মাল, মূর্তি, নেওড়া, কুর্তি, মালঙ্গি, দিমা, মানসাই, তোর্সা — এমন অজস্র ছোট-বড় নদী বনের ভিতর দিয়ে বয়ে চলেছে। পূর্ব হিমালয় ঘেঁষা এই বনাঞ্চলে বসবাস করেন একাধিক ভাষাগোষ্ঠীর মানুষ। যেমন– মেচ, গারো, রাভা, বোরো, লিম্বু, ডুকপা, নেপালি, আদিবাসী, সাঁওতালি, ওঁরাও ইত্যাদি। নিজস্ব ভাষা ও নিসর্গ-প্রকৃতিকে ঘিরে গড়ে উঠেছে তাঁদের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল। অথচ সেখানে শিক্ষা বলতে, হয় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বাংলা ও নেপালি মাধ্যম স্কুল অথবা বেসরকারি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। চাইতে বা না চাইতেই নিজস্ব ভাষা ছেড়ে বাচ্চারা বাংলা, হিন্দি ও ইংরেজি ভাষার মধ্য দিয়ে জানে বাইরের পৃথিবীকে। ফাঁকি থেকে যায় তাঁদের ভিতরের স্বতন্ত্র পৃথিবীকে জানার আয়োজনে। যাই হোক, প্রসঙ্গান্তরে ফিরে যাই।
সেইসব স্কুল থেকে পাশ করেছে এমন তরুণ-তরুণীদের যখন জিজ্ঞেস করা হয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কে? উত্তরে কেউ বলে, তিনি বাঙালি লেখক। কারও মনে পড়ে, স্কুলের বইয়ে কোনও এক কারণে বোধহয় সে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম দেখছিল। কেউ বা বলে, দেশের জাতীয় সংগীত জনগণমন-র রচয়িতা রবীন্দ্রনাথ। আর, যারা সরকারি-বেসরকারি স্কুলে যাবার সুযোগটুকু পায়নি তাদের কাছে রবীন্দ্রনাথ নামের কোনও ব্যক্তির আলাদা অস্তিত্ব নেই। সজোরে ধাক্কা লাগে মনে। বাঙালি হিসেবে প্রশ্নকারী নিজেকেই প্রশ্ন করতে থাকে; এই কি তাহলে সোনার বাংলা যার একাংশ রবীন্দ্রনাথকে চেনে না? সত্যিই তো চেনে না। চিনবেই বা কেন! আধিপত্যের গর্ব টুকরো টুকরো হয়ে যায় মুহূর্তে। তেমনটাই হওয়া উচিত। মিথ্যে গর্ব ভেঙে গেলে মন প্রান্তজনের সঙ্গে সংলাপে জড়ায়। যে রবীন্দ্রনাথকে আকৈশোর চিনতে শিখেছি, যাঁর সৃষ্টি-শব্দ-সুর মিশে গেছে অনুভূতিতে, সেই রবীন্দ্রনাথ কি একেবারেই বিরাজ করেন না প্রান্তজনের ভেতরে? মন বলে ‘করে’। কিন্তু কীভাবে? উত্তর হাতড়ে চলি। চিন্তায়-অভিজ্ঞতায়-অনুভবে যতটুকু খুঁজে পাই তাকেই জোড়াতালি দেওয়ার মরিয়া চেষ্টা চালাই। আসলে, প্রান্তজনের রবীন্দ্রনাথ কেমন – তারই আদল গড়তে চায় মন।
আরও পড়ুন-নজরুলের পত্রিকায় সেদিন লেখেননি রবীন্দ্রনাথ
দিমা নদী সংলগ্ন, রাভা ও আদিবাসী অধ্যুষিত এক বনবস্তি। সেই বস্তি জুড়েই হেঁটে বেড়াচ্ছি ইতিউতি। বসন্তের বিকেল। প্রাক-বসন্তে পরপর কয়েকদিনের বৃষ্টিতে মাঠ-জঙ্গল একেবারে ঘন সবুজ হয়ে উঠেছে। পড়ে আসা আলোর নরম ঝিলিক লেগেছে গাছের পাতায়, ঘাসের আগায়। আলগা হাওয়া বইছে। ধীর লয়ে ঘরে ফিরছে একপাল বাছুর-ছাগল। কয়েক হাত দূরে কতকগুলো ময়ূর ঘুরছে তাদের মস্ত পাখা মেলে দিয়ে। যত হাঁটছি, পেরোচ্ছি সোঁতা, মাঠ-প্রান্তর, মন তত আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে অজানিত সুরে। অদ্ভুত এক মুগ্ধতা অবশ করে ফেলছে শরীর। গুনগুনিয়ে উঠছি —
‘এই তো ভালো লেগেছিল আলোর নাচন পাতায় পাতায়/ শালের বনে খ্যাপা হাওয়া এই তো আমার মনকে মাতায়…’
আচমকা, পাশে থাকা তরুণী, যে একাধারে আমার সখী ও কাজের সাথীও বটে, সে বলে ওঠে, ‘দিদি, মনে হচ্ছে মাঠ-জঙ্গলের এত সবুজ আমাকে ঘিরে ফেলছে… যেন দামি মখমলের পোশাকের মতো জড়াচ্ছে সারা গায়ে’। স্তম্ভিত হয়ে যাই। মনে হয় মুগ্ধতায় মিলে যাচ্ছি আমরা। এই 'আমরা' কারা? একজন, যার পরিচয় বনবস্তির মেয়ে, যে রাভা ভাষা-সংস্কৃতিতে লালিত। আরেকজন, তার চেয়ে বয়সে কিছুটা বড়, শহুরে মধ্যবিত্ত বাঙালি মেয়ে। মুগ্ধতায় আমি আশ্রয় নিচ্ছি রবীন্দ্রনাথের গানে। তাঁর গান ছুঁয়েছে আমাকে, ছুঁয়েছে প্রান্তজনের অনুভূতিও। এইখানে, মুগ্ধতার ঘোরে সব একাকার। কাজের কথা-টথা পড়ে থাকে। দু'জনায় হাঁটতে থাকি। গাইতে থাকি—
“লাগল ভালো, মন ভোলালো, এই কথাটাই গেয়ে বেড়াই--
দিনে রাতে সময় কোথা, কাজের কথা তাই তো এড়াই।
মজেছে মন, মজল আঁখি-- মিথ্যে আমায় ডাকাডাকি-
ওদের আছে অনেক আশা, ওরা করুক অনেক জড়ো-
আমি কেবল গেয়ে বেড়াই, চাই নে হতে আরো বড়ো”
প্রান্তজনের রবীন্দ্রনাথকে খুঁজতে গেলে যার কাজ ও ভাবনার প্রসঙ্গ এসেই পড়বে তিনি, পাওলো ফ্রেয়রি। ১৯৪০-এর দশক থেকে ৮০-র দশক পর্যন্ত ফ্রেয়রি, ব্রাজিলের শোষিত, নিপীড়িত, হতদরিদ্র মানুষের সঙ্গে কাজ করেন। তাঁর মূল কাজ ছিল প্রান্তিক মানুষের পড়াশোনা। সেই অভিজ্ঞতা থেকে তিনি লিখেছিলেন ‘পেডাগজি অফ দ্য অপ্রেসড’। শোষিতের শিক্ষাকে তিনি দেখেছিলেন শোষণের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি ও সমাজ বদলের প্রক্রিয়া হিসেবে। ব্যক্তিগতভাবে, এযাবৎ প্রান্তিক অঞ্চলে কাজ করা এবং প্রান্তজনের সঙ্গে সংলাপ তৈরির গোটা প্রচেষ্টাই ফ্রেয়রির ভাবনায় জারিত। আবার, এই প্রত্যন্ত অঞ্চলেই, বন-জঙ্গলের নিসর্গ-প্রকৃতির ভিতর বারবার ফিরে পাই রবীন্দ্রনাথের গান, চিন্তা, দর্শন। তাই, এই তাল-মিলের ভিতর দিয়েই এগিয়ে যাওয়া যাক। প্রান্তের কথাই যখন হচ্ছে, তখন ভেবে দেখা দরকার; প্রান্তিক কারা? তারা প্রান্তিক হলোই বা কেন? কোন ইতিহাস রয়েছে এই ‘প্রান্তিকতা’-র অন্ধকারে? রবীন্দ্রনাথের গানেই কি কেবল জুড়ে যাবে প্রান্তজনের অনুভূতিমালা, নাকি তাদের সামাজিক পরিস্থিতিও স্পষ্ট হবে রবীন্দ্রনাথের চিন্তায়?
প্রান্তিকতার ইতিহাসে মিশে আছে শোষণ ও বঞ্চনার ইতিহাস। যে আর্থ-সামাজিক কাঠামোয় আমরা বাস করি তা গড়ে উঠেছে শোষণের ভিত্তিতে। মুষ্টিমেয় মানুষ, যাদের আছে পুঁজির জোর তারাই পুঁজি ধরে রাখতে ও উত্তরোত্তর মুনাফা বাড়াতে দেশের বৃহৎ জনসাধারণের উপর শোষণ চালায়। তৈরি হয় শোষক ও শোষিত – দুই শ্রেণি। ‘সমবায়নীতি’ প্রবন্ধগুচ্ছে রবীন্দ্রনাথ সমালোচনা করছেন এই শোষণ নীতির। তাঁর কথায়, “বর্তমান সভ্যতার নীতি এই।” আর আমরা জানি শোষণের বীজ গর্ভে ধারণ করে সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিকতা। তাই ব্রিটিশ ভারতের পরাধীনতাকে তিনি দেখছিলেন শোষণের শৃঙ্খল হিসেবেই। শোষক ও শোষিতের দুনিয়ায়, কেবল অর্থনৈতিক শোষণ নয়, একদল চায় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য। সেই আধিপত্যের বয়ান রাষ্ট্রযন্ত্রের শরীরেও। যে যত বড় হয়, যার অর্থের জোর বেশি, যার ভাষা-সংস্কৃতি, সামাজিক অবস্থান যত বড়, সে চায় ক্ষুদ্রের উপর তার শাসন, শোষণ। আর তার কেন্দ্রবিন্দু রাজধানী ও বড় শহরগুলোর অন্দরে। যারা ক্ষুদ্র, দুর্বল তাদের কেবল ঠেলতে থাকে প্রান্তের দিকে। তাদের পরিচয় প্রান্তিক। শোষণের নিগড় ভাঙতে চাওয়া, প্রান্ত আর কেন্দ্রকে মেলাতে চাওয়ার ইচ্ছে ধরা পড়েছে রবীন্দ্রনাথের সমবায় ভাবনায়। তিনি লিখেছেন,
"শক্তিমানের ধর্মবুদ্ধির দ্বারা দুর্বলকে রক্ষা করার চেষ্টা আজও সম্পূর্ণ সফল হতে পারেনি। অবশেষে একদিন দুর্বলকে এই কথা মনে আনতে হবে যে, আমাদেরই বিচ্ছিন্ন বল বলীর মধ্যে পুঞ্জীভূত হয়ে তাকে বল দিয়েছে। বাইরে থেকে তাকে আক্রমণ করে তাকে ভাঙতে পারি, কিন্তু তাকে জুড়তে পারি নে; জুড়তে না পারলে কোনো ফল পাওয়া যায় না। অতএব আমাদের চেষ্টা করতে হবে আমাদের সকলের কর্মশ্রমকে মিলিত ক'রে অর্থশক্তিকে সর্বসাধারণের জন্যে লাভ করা। একেই বলে সমবায়নীতি।"
সমবায়ের মধ্যে দিয়েই তিনি সম্পদের বন্টন, উৎপাদন ও অর্থনীতি ব্যবস্থার অসাম্য দূর করতে চেয়েছিলেন। আশ্চর্যজনকভাবে, তিনি যেভাবে বলছেন, আমরা জুড়তে পারি না। তাতে অনুধাবন করতে পারি আমাদের ব্যর্থতা। আমরা তো খণ্ড হিসেবে দেখি নিজের অস্তিত্বকে। সুতরাং, খণ্ড হিসেবে জানি দুনিয়াকেও। এই আলাদা আলাদা করে দেখা বা খণ্ড করার প্রবণতা আমাদের চেতনায় ঢুকে পড়ে ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থায়, ঔপনিবেশিক শিক্ষার হাত ধরে। এর থেকে নিষ্কৃতির উপায়?
এখানেই প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে রবীন্দ্রনাথের সমবায়নীতির সত্য। সেই সত্য কেমন? তিনি বলছেন, "লঙ্কার বহুখাদ্যখাদক দশমুণ্ডধারী বহু-অর্থ-গৃষ্ণু দশ-হাত-ওয়ালা রাবণকে মেরেছিল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বানরের সংঘবদ্ধ শক্তি। একটি প্রেমের আকর্ষণে সেই সংঘটি বেঁধেছিল। আমরা যাঁকে রামচন্দ্র বলি তিনিই প্রেমের দ্বারা দুর্বলকে এক করে তাদের ভিতর প্রচণ্ড শক্তিবিকাশ করেছিলেন। আজ আমাদের উদ্ধারের জন্যে সেই প্রেমকে চাই, সেই মিলনকে চাই।" গানের মধ্য দিয়ে তিনি আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলছেন,
ওরে পথিক, ওরে প্রেমিক,
বিচ্ছেদে তোর খণ্ড মিলন পূর্ণ হবে।
আয় রে সবে
প্রলয়গানের মহোৎসবে ॥
অতএব, শোষণের বঞ্চনা থেকে মুক্তির উপায় লড়াই। সে লড়াই-ই হতে পারে প্রলয়গানের মহোৎসব। সেখানে মিশে যায় প্রেম ও মিলন। তিনি উপমা টেনেছেন রামচন্দ্রের। আজকের ভারতবর্ষে দাঁড়িয়ে যেখানে ‘রাম’ ঘৃণার রাজনীতির হাতিয়ার, সেখানেই মনে করতে ইচ্ছে করে — জোলা, তাঁতি কবীর তো সেই রামকেই খুঁজেছিলেন যার সঙ্গে তাঁর সম্বন্ধ প্রেমের, ভালোবাসার। কবীরও পরিচয়ে এক সংখ্যালঘু, প্রান্তিক। সেই পরিচয়কে তিনি প্রেমেই জয় করতে চেয়েছিলেন।
আরও পড়ুন- জীবনবোধে এক হয়ে যান মার্থা নাসবম থেকে রবীন্দ্রনাথ : সুমন চট্টোপাধ্যায়
আবার, এই মিলনের প্রসঙ্গে জুড়ে যায় ফ্রেয়রির চিন্তা। তিনি লিখছেন, "আমাদের চৈতন্য আছে, তার জোরেই আমরা জানি নিজেকে, বাইরের পৃথিবীকেও।" তবে এই তো সেই মিলন। চৈতন্যের মিলন। যে মিলন ঘটলে শোষিত তার ঐতিহাসিক ভার মুক্ত করে স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যাবে। তার দেখা-বোঝার সীমাবদ্ধতা যেখানে, বাইরের শাসক-শোষক এবং ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদ তাকে নিয়ত বলে চলেছে সে দুর্বল। আর, ভালো থাকার একমাত্র পথ পুঁজিবাজারে উপার্জনের প্রতিযোগিতায় জেতা। তাই, সেও মেনে নেয় সে দুর্বল, প্রতিযোগিতায় চিরকাল হেরোর দলে। নিজের সীমা পেরোনোর কথা ভাবতে গিয়ে আবার ভেবে ফেলি রবীন্দ্রগান —
“আমার আপন গান আমার অগোচরে আমার মন হরণ করে, নিয়ে সে যায় ভাসায়ে সকল সীমারই পারে।”
রবীন্দ্রনাথের সমবায় ভাবনায় দেখতে পাই স্বায়ত্তশাসন ও আত্মনির্ভরতার কথা। তাঁর লেখাতেই রয়েছে —
"দেশের সমস্ত গ্রামকে নিজের সর্বপ্রকার প্রয়োজনসাধনক্ষম করে গড়ে তুলতে হবে। এজন্য কতকগুলি পল্লী নিয়ে এক-একটি মণ্ডলী স্থাপন করা দরকার, সেই মণ্ডলীর প্রধানগণ যদি গ্রামের সমস্ত কর্মের ও অভাবমোচনের ব্যবস্থা করে মণ্ডলীকে নিজের মধ্যে পর্যাপ্ত করে তুলতে পারে তবেই স্বায়ত্তশাসনের চর্চা দেশের সর্বত্র সত্য হয়ে উঠবে। নিজের পাঠশালা, শিল্পশিক্ষালয়, ধর্মগোলা, সমবেত পণ্যভাণ্ডার ও ব্যাঙ্ক-স্থাপনের জন্য পল্লীবাসীদের শিক্ষা সাহায্য ও উৎসাহ দান করতে হবে।"
এই ভাবনার সাক্ষ্য বহন করে শিলাইদহ, পতিসরে রবীন্দ্রনাথের পল্লী-উদ্যোগ থেকে শান্তিনিকেতন- শ্রীনিকেতনকে ঘিরে যাবতীয় উদ্যোগ ও কাজকর্ম। প্রান্তজনের সঙ্গে কাজ করার চিন্তাভাবনায় পুষ্টি যোগায় রবীন্দ্রনাথের সমবায় উদ্যোগ।
এতকিছু বোঝার পরে মনে হয়, নিজের ভিতরে জমে আছে আধিপত্যের সমস্ত চিহ্ন। সঙ্গে এক গভীর গ্লানিও। সেই নিয়ে প্রান্তবাসীর সঙ্গে মিলব কেমন করে? উত্তর পাই ফ্রেয়রির লেখায়। শোষিতের প্রতি প্রকৃত সংহতিকে তিনি দেখছেন ভালোবাসার সর্বার্থক প্রকাশ হিসেবে। ঘুরে-ফিরে আসে রবীন্দ্রচিন্তায় থাকা প্রেম-ভালোবাসা। সেই প্রেম মিলনোন্মুখ। সে পারে চৈতন্যের আগল খুলে দিতে। বাস্তবতার সমস্ত সীমানা ভেঙে স্বাধীনতার দেশে পৌঁছে দিতে। স্বাধীনতা অর্থাৎ, মুক্তি। প্রান্তে না থেকেও শোষণের যন্ত্রণাকে জেনেছি লিঙ্গ পরিচয়ের কারণে। এ জায়গায় আমি ও আমার সাথী-সখী, আমরা এক। আমরা জানি,
“আমার মুক্তি ধুলায় ধুলায় ঘাসে ঘাসে॥
দেহমনের সুদূর পারে হারিয়ে ফেলি আপনারে,
গানের সুরে আমার মুক্তি ঊর্ধ্বে ভাসে॥”
আরও একবার মিলে যাই প্রান্তজনের সঙ্গে। সুতোটা বেঁধে দেন রবীন্দ্রনাথ। মাথার মধ্যে থাকেন ফ্রেয়রি। ১৯৪১ সালে মারা যাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ৪০-র দশক থেকে সবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করছেন ফ্রেয়রি। অথচ, অদ্ভুতভাবে ফ্রেয়রির দর্শন ও বোধের সঙ্গে মিলে যাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ, উভয়েরই রাজনৈতিক ও সামাজিক বোধের ভুল-ত্রুটি, সীমাবদ্ধতা সমস্তটা নিয়ে। মিলে যাচ্ছে বাংলার পল্লীগ্রামের সঙ্গে ব্রাজিলের প্রান্তিক মানুষ। সেই সুর শিখছে আমার চেতনাও। সময়ান্তরে বসে সবটা মিলিয়ে নিতে পারছি প্রান্তজনের সঙ্গে সংলাপে।
আসলে, প্রান্তজনের রবীন্দ্রনাথ নেই। কিন্তু প্রান্তজনের অন্তরে, প্রান্তিক নিসর্গ-প্রকৃতির ভিতর প্রতিদিন বাঁচেন রবীন্দ্রনাথ।