বুড়িমার চকলেট বোম: এক বাঙালি নারীর সাফল্যের কাহিনি
Burima Chocolate Bomb: বাজি বিক্রির দোকানে তাঁর বয়স্ক মুখ, শাড়ির আঁচল গুঁজে কাজ করার ভঙ্গি সব মিলিয়ে মানুষ তাঁকে নিজের মতো করে নাম দিয়েছিল বুড়িমা।
ছোটবেলায় মামারবাড়ির পুকুর ধারে একটা অস্থায়ী বাজির দোকান বসত। লক্ষ্মী পুজোর পর থেকে কালী পুজো পর্যন্ত ছিল সেই দোকানের অস্তিত্ব। সেই দোকানের বিভিন্ন ধরণের শব্দবাজি পাওয়া যেত। সেই শব্দবাজির অন্যতম আকর্ষণ ছিল তার আওয়াজ। সেই শব্দবাজির গায়ে একটা লেবেল থাকত। সেই লেবেলে লেখা থাকত বুড়িমা চকলেট। এই বুড়িমার প্রতি বারবার নতজানু হয়েছি। আমাদের ছোটবেলাটা শব্দে শব্দে ভরিয়ে দেওয়ার জন্য মনে মনে যে কতবার ধন্যবাদ জানিয়েছি তার ঠিক নেই। দোকানে বুড়িমা চকলেটের পাশে অন্যান্য ব্রান্ডের চকলেট রাখা থাকলেও প্রতিবার বুড়িমা চকলেটই কিনতাম। কারণ একটা বুড়িমা চকলেট ফাটিয়ে মোটামুটি গোটা এলাকাকে জানান দেওয়া যেত যে কিছু একটা করলাম। এতটাই তেজ ছিল বুড়িমার। আদতে বুড়িমা ছিলেন সেই বাঙালি মহিলা, যিনি একা হাতে ব্যবসা করে দেখিয়ে দিয়েছেন বাঙালি পারে না এমন কিছু নেই। শুধু তাই নয়, মহিলা বাঙালি ব্যবসায়ী হিসেবে যে কৃতিত্ব স্থাপন করেছেন তা নজিরবিহীন।
বুড়িমার আসল নাম অন্নপূর্ণা দাস। ফরিদপুরের এক গৃহবধূ থেকে কলকাতার বাজি সাম্রাজ্যের কর্ণধার অন্নপূর্ণা দাসের জীবনের গল্প যেন এক ব্যবসায়িক উপাখ্যান। দেশভাগ ছিন্নমূল করে দেয়। ভিটেছাড়া হয়ে চলে আসেন তখনকার পশ্চিম দিনাজপুর জেলার ধলদিঘি সরকারি ক্যাম্পে। উদ্বাস্তুদের পার্মানেন্ট লায়াবিলিটি ক্যাম্প থেকে এক সময়ে হাওড়া জেলার বেলুড়ে স্থায়ী ঠিকানা হয় তাঁর। দেশভাগের পর শরণার্থী হয়ে যখন তিনি পশ্চিমবঙ্গে আসেন, তখন তাঁর কাছে ছিল না পুঁজি। সংসার চালাতে প্রথমে সবজি বেচেছেন, বিড়ি বেঁধেছেন, সিঁদুর-আলতা বানিয়েছেন। সেই ছোটখাটো ব্যবসার মধ্যেই তিনি বুঝেছিলেন, বাজার বোঝাই আসল মূলধন। বাজি ব্যবসায় নামেন একেবারে কাকতালীয়ভাবে। তৎকালীন দক্ষিণ ভারতের কারিগর আকবর আলির কাছ থেকে তিনি বাজি তৈরির কৌশল শেখেন। তারপর শুরু হয় ছোট পরিসরে বাজি তৈরি ও বিক্রি।
আরও পড়ুন
তুবড়ি থেকে তারাবাতি, যেভাবে সেদিন শুরু হয়েছিল আতশবাজির পথচলা
প্রথম দিকের বাজিগুলির মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয় চকলেট বোম। চকচকে কাগজে মোড়ানো সেই ছোট্ট শব্দবাজি তখন দীপাবলির অপরিহার্য অংশ। ক্রেতারা সহজেই মনে রাখে সেই নাম 'বুড়িমার চকলেট বোম'। আসলে, বাজি বিক্রির দোকানে তাঁর বয়স্ক মুখ, শাড়ির আঁচল গুঁজে কাজ করার ভঙ্গি সব মিলিয়ে মানুষ তাঁকে নিজের মতো করে নাম দিয়েছিল বুড়িমা। অন্নপূর্ণা দাস বুঝেছিলেন, এই লোকমুখের নামই তাঁর পণ্যের আসল ব্র্যান্ড হবে। বিপণন কৌশল হিসেবে এ ছিল এক অসাধারণ পদক্ষেপ। বড় কোম্পানি বা বিজ্ঞাপন ছাড়াই, শুধুমাত্র মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল বুড়িমা ব্র্যান্ড। তাঁর সাফল্যের মূলে ছিল গ্রাহক-মনস্তত্ত্বের নিখুঁত পাঠ। উৎসবের আবেগ, গন্ধ ও শব্দ সব মিলিয়ে তিনি তৈরি করেছিলেন এমন এক পণ্য যা কেবল বাজি নয়, এক সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা। তাঁর ব্যবসার আরেক বৈশিষ্ট্য ছিল স্থানীয় কর্মসংস্থান সৃষ্টি। অন্নপূর্ণা দাস বুঝেছিলেন, শ্রম সস্তা নয়, দক্ষতা-নির্ভর কাজই টিকিয়ে রাখে ব্যবসা। ফলে বাজি তৈরির প্রতিটি ধাপেই তিনি যুক্ত করেছিলেন স্থানীয় মহিলা ও যুবকদের। একসময় বুড়িমা চকলেট বোম শুধু বাজার দখল করেনি, গড়ে তুলেছিল ছোট এক অর্থনৈতিক পরিসর।
এক সময় তাঁর কাছে বাজি কেনার পয়সা ছিল না। তিনি দশটা একশো টাকার নোট ধার করেন। তাই দিয়ে নানা রকম বাজি কিনে দোকান সাজিয়ে বসলেন। জমল বিক্রিবাটা। তিন দিনের মাথায় পুলিশ এসে হাজির। বাজি বিক্রির লাইসেন্স আছে? বাজি বিক্রি করতে লাইসেন্স লাগে, জানা ছিল না। বললেন, 'এ বারের মতো ছেড়ে দিন।' কাজ হলো না। বাজি বাজেয়াপ্ত করল পুলিশ, গুঁড়িয়ে দিল দোকান। জেদ চেপে গেল। বাজির ব্যবসাই করবেন তিনি। করলেনও। ধীরে ধীরে বাংলার বাজি ব্যবসায় এক নম্বর জায়গাটি পাকা করে ফেললেন অন্নপূর্ণা দেবী। হয়ে উঠলেন মসিহা। বাজি-কারখানার জন্য তালবান্দা, ডানকুনি, শিবকালীতে জায়গা কিনলেন। ডানকুনিতে মাটি খুঁড়তে বেরল বিশাল শিবলিঙ্গ। চকলেট বোমের লোগো হলো তা। কারখানার জন্য কিনলেও তালবান্দার জমি বিলিয়ে দিলেন গরিবদের। এক সময় যাঁর মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না, তিনিই পঞ্চাশটি পরিবারকে বাড়ি বানিয়ে দিলেন। বলতেন, 'ব্যবসাটা তুচ্ছ! এসেছি মানুষকে ভালবাসতে।' অন্ধ্রপ্রদেশের শিবকাশীতে একটি দেশলাই কারখানা তৈরি করেন। ডানকুনিতে চলতে থাকে তাঁর বাজির কারখানা।
আরও পড়ুন
তুবড়ি থেকে ফানুস, আতসবাজির সেই উন্মাদনা হারিয়েছে কালীপুজোর কলকাতা?
পঞ্চাশ থেকে সত্তরের দশকে ভারতের ছোট ও মাঝারি শিল্পে নারী উদ্যোক্তার উপস্থিতি তেমন চোখে পড়ার মতো নয়। তখনকার সরকারি ও সমীক্ষাগত তথ্য অনুযায়ী, দেশজুড়ে নিবন্ধিত শিল্পের মধ্যে নারী মালিকানাধীন ইউনিটের হার ছিল মাত্র তিন থেকে চার শতাংশের মতো, আর পশ্চিমবঙ্গে তা প্রায় ১.৮ শতাংশ। অর্থাৎ একশো উদ্যোক্তার মধ্যে দুজনও নারী ছিলেন না। এই প্রেক্ষাপটে অন্নপূর্ণা দাসের উত্থান কেবল ব্যক্তিগত সাফল্য নয়, সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকেও তা এক বিরল ঘটনা। সেই সময়ের বাঙালি সমাজে ব্যবসা মানেই ছিল পুরুষদের ক্ষেত্র, নারীর জন্য এটি ছিল প্রায় নিষিদ্ধ। ন্যাশানাল স্যাম্পেল সার্ভের (NSS) ৩১তম রাউন্ড (১৯৭৬–৭৭) অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গের কর্মরত নারীদের প্রায় ৭২ শতাংশ গৃহস্থালির কাজেই সীমাবদ্ধ ছিলেন, স্বনিয়োজিত ব্যবসায়ীর মধ্যে নারী ছিলেন এক শতাংশেরও কম। এই পরিস্থিতিতে বেলুড়ের এক সাধারণ গৃহবধূ, অন্নপূর্ণা দাস, বাজির কারখানা খোলেন এবং সেটিকে জনপ্রিয় ব্র্যান্ডে রূপান্তরিত করেন।
বুড়িমা আতসবাজি ১৯৬০-৭০ দশকে কলকাতার হাটবাজার ও উৎসবের মৌসুমে এক অপরিহার্য নাম হয়ে ওঠে। তাঁর ব্যবসায়িক কৌশল ছিল মৌসুমি চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে উৎপাদন বাড়ানো, শ্রমিকদের দক্ষভাবে কাজে লাগানো এবং বাজারের চাহিদা অনুযায়ী পণ্যের বৈচিত্র্য বজায় রাখা। স্থানীয় ট্রেড রেজিস্ট্রির তথ্য অনুযায়ী, প্রতি উৎসব মরশুমে উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় ৩০-৪০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ত। অন্নপূর্ণা দাসের এই সাফল্য প্রমাণ করে, নারী উদ্যোক্তা মানে কেবল হস্তশিল্প বা গৃহস্থালির কাজ নয়। পুরুষনিয়ন্ত্রিত ও ঝুঁকিপূর্ণ ক্ষেত্রেও নিজের জায়গা করে নেওয়া সম্ভব। তাঁর উদ্যোগ ছিল এক প্রাথমিক দৃষ্টান্ত, যা আজকের নারী উদ্যোক্তাদের পথপ্রদর্শক।
দেশের সাম্প্রতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা এখন প্রায় ২০ শতাংশ, সেই দীর্ঘ যাত্রার সূচনা ঘটেছিল এমন সাহসী, সীমান্ত অতিক্রমকারী নারীর উদ্যোগ থেকেই। বুড়িমা ছিলেন সেই দশকের নস্টালজিয়া এবং এক সফল মহিলা উদ্যোগপতি । ১৯৯৬ সালে সরকারিভাবে সেই নস্টালজিয়া গত হয়। কারণ ওই বছরেই ৯০ ডেসিবেল ও তার বেশি যাবতীয় শব্দবাজি নিষিদ্ধ হয়। বুড়িমা ব্র্যান্ডের ব্যবসা অবশ্য তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। পরবর্তী প্রজন্ম আলোর বাজির ব্যবসা করছেন ঝকমকিয়ে।
Whatsapp
