গোরখনাথ মন্দিরে হামলা কি নতুন অশান্তির সলতে পাকাবে উত্তরপ্রদেশে?
সবে শেষ হয়েছে উত্তরপ্রদেশ নির্বাচন। পরপর দু'বার উত্তরপ্রদেশের মসনদে বসেছেন যোগী আদিত্যনাথ। এর মধ্যেই খোদ মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের অন্যতম ‘রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু’ গোরখনাথ মন্দির আক্রমণ নিয়ে সরগরম উত্তরপ্রদেশের রাজ্য রাজনীতি। দু'দিন আগেই আহমেদ মুর্তাজা আব্বাসি নামের এক ব্যক্তি গোরখনাথ মন্দিরের দুই পিএসি জওয়ানকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আক্রমণ করে। আহত হন দুই কনস্টেবল। এরপরেই উত্তরপ্রদেশ পুলিশ গ্রেফতার করে আব্বাসি-কে। তদন্তে নামে উত্তরপ্রদেশের অ্যান্টি টেররিস্ট স্কোয়াড। গোটা ঘটনার তদন্ত করতে নেমে এটিএস-এর হাতে উঠে আসে কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য। বম্বে আইআইটির প্রাক্তনী, পেশায় কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার আব্বাসি উদ্দ্যেশ্যপূর্ণভাবেই হামলা চালিয়েছে মন্দিরে। উত্তরপ্রদেশের ধর্মীয় রাজনীতিতে এই আক্রমণ বিভিন্ন সম্ভাবনাকে উসকে দিয়েছে।
‘গোরখনাথ মন্দির': উত্তরপ্রদেশের রাজনীতির 'পাওয়ার পয়েন্ট'
উত্তরপ্রদেশের রাজনীতির সুলুকসন্ধান করলেই দেখা যাবে কীভাবে ধর্ম, জাতপাত এখানকার রাজনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে। সেই নিরিখে ধরলে গোরখনাথ মন্দিরের গুরুত্ব উত্তরপ্রদেশ রাজনীতিতে অনস্বীকার্য। এখানকার মোহান্ত সম্প্রদায় বরাবরই নির্বাচনের গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের হাত ধরে গোরখনাথ মন্দিরের এক নতুন ক্ষমতায়ন হয়েছে। ১৯৯৭ সালে গোরখনাথ মন্দিরেই যোগী সেবায়েতের ভূমিকায় যোগ দেন। দীর্ঘ ১৪ বছর হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিতে নিজের অবদান রেখে ২০১৪-য় যোগী আদিত্যনাথ গোরখনাথ মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের দায়িত্ব পান। সেখান থেকেই ২০১৭-র উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনে যোগীর নেতৃত্বে বিজেপির বিপুল বিজয় এবং উত্তরপ্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসা। এহেন মন্দিরে হামলার ঘটনা এবং এটিএস-এর কাছে আব্বাসির স্বীকারোক্তি নিয়ে একাধিক জটিলতা তৈরি হয়েছে।
'সেক্রেড গেম': হামলা ও নীল নকশা
কেন গোরখনাথ মন্দিরেই হামলা চালাল আব্বাসি? পুলিশের এই প্রশ্নের মুখে আব্বাসি স্পষ্ট জানিয়েছে, গোটা ভারতে বিজেপি সরকারের আমলে মুসলিমদের ওপর যে আগ্রাসন ও আক্রমণ নেমে এসেছে, সেই প্রতিশোধস্পৃহা থেকেই সে আক্রমণ চালিয়েছে গোরখনাথ মন্দিরে। এমনকী, উদ্দেশ্য পূরণের পর আত্মঘাতী হওয়ার পরিকল্পনাও করে রেখেছিল সে। গোরখনাথ মন্দিরের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ হিন্দু মন্দিরে হামলা যে দেশের রাজনীতিতে অশান্তি সৃষ্টি করবে, জেনেই আব্বাসি টার্গেট করেছিল গোরক্ষপুরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত গোরখনাথ মন্দিরকে।
আব্বাসির ফোনের কল ডিটেইলস থেকে উঠে এসেছে আরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য। ঘটনার দিন সে আবদুল রহমান বলে এক ব্যক্তিকে ফোন করে। দু'জনের মধ্যে একাধিকবার কথা হয়। এমনকী, এই হামলার পরিকল্পনা করার জন্য তারা দু'জন একসঙ্গে নেপাল গিয়েছিল। সেখানে উগ্রপন্থ্রী সংগঠন আইএস-এর ইফতিকারুদ্দিনের সঙ্গে তারা দেখা করে হামলার বিষয়ে পরামর্শ করে। গোটা ঘটনায় উগ্রপন্থী যোগের কথা মাথায় রেখে পুলিশ ও তদন্তকারী দলের অফিসাররা লাগাতার জেরা করেছেন আব্বাসিকে। জেরার সামনে আব্বাসি জানিয়েছে, দেশজুড়ে ধারাবাহিক বোমা বিস্ফোরণের পরিকল্পনাও করেছিল তারা। ভারতের মতো একটি দেশে কেন মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষরা বঞ্চিত ও অপমানিত হবেন, সেখান থেকেই তার মাথায় হামলার পরিকল্পনা এসেছিল।
এই ঘটনার পরই গোরখনাথ মন্দিরের প্রধান দর্শনার্থী এবং রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের নিরাপত্তা আরও জোরদার করল পুলিশ। আগে যোগীর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা জেলা পুলিশ ও পিএসি-কে সরিয়ে সিআরপিএফ-এর ২৩৩ নম্বর ব্যাটেলিয়নকে যোগীর নিরাপত্তার দায়িত্ব দেওয়া হল।
সাম্প্রদায়িক সলতে: আশঙ্কা ও সম্ভাবনা
গোরখনাথ মন্দির আক্রমণের ঘটনা স্বাভাবিকভাবেই সাম্প্রদায়িক অশান্তিকে উসকানি দিতে পারে। উত্তরপ্রদেশের মতো হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি রাজ্যে এই ধরনের আক্রমণ স্বাভাবিকভাবে সাধারণ জনতাকে উত্তেজিত করতে পারে। যে উত্তরপ্রদেশের জনগণের বিপুল আস্থা অর্জন করেছেন যোগী, সেখানে এই ঘটনা মুসলিমদের ওপর আক্রমণের অছিলা হয়ে উঠবে না তো? সেক্ষেত্রে সরকার এবং প্রশাসন সাম্প্রদায়িক উসকানি রুখতে কতটা ধর্মনিরপেক্ষ আচরণ করবে? আশি-কুড়ি বিভাজনের তত্ত্বে যিনি ভোট লড়েন, সেই যোগী আদিত্যনাথ কি কড়া হাতে পরিস্থিতি সামলাবেন?
তার উত্তর সময় দেবে।