রসায়নে নোবেল ২০২৫: CO₂ বন্দি, মরুভূমিতে জল সঞ্চার সম্ভব হবে এবার

2025 Nobel Prize in Chemistry: ধাতব আয়ন এবং জৈব লিঙ্কার দিয়ে তৈরি এই গঠন গুলিকে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন কাজে, যেমন গ্রিনহাউস গ্যাসগুলিকে আটকে রাখা, হাইড্রোজেন সংরক্ষণ করা, এমনকি ওষুধ সরবরাহ করার ক্ষেত্রেও ব্যবহার করতে পারেন।

প্রতি বছর অক্টোবর মাস এলেই নোবেলের মরসুম চালু হয়ে যায়। আজ সুইডিশ কমিটি ঘোষণা করল রসায়ন তথা মরসুমের তৃতীয় নোবেল। ধাতু এবং জৈব যৌগের কাঠামো বা  মেটাল-অরগানিক ফ্রেমওয়ার্ক উদ্ভাবনের জন্য এ বছরের রসায়নে নোবেল পেয়েছেন তিনজন বিজ্ঞানী- অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব মেলবোর্নের অধ্যাপক রিচার্ড রবসন, জাপানের কিয়োটো ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক সুসুমু কিতাগাওয়া, এবং ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয়ের অধ্যাপক ওমর এম ইয়াঘি।

কী করেছেন তাঁরা?

ভিনদেশি এই তিন বিজ্ঞানী, অণুর ভেতরই ঘর তৈরি করেছেন, যেগুলোকে বলা হয় মেটাল-অরগানিক ফ্রেমওয়ার্ক (MOF); এককথায় ধাতব-জৈব কাঠামো। কী এই এমওএফ?

এটি হলো চকচকে আণবিক কাঠামো যা ধাতব পরমাণুগুলি ও জৈব অণু মিলে মিশে তৈরি হয়, ফলে এটি আকারে হয় কেলাসকার এবং ছিদ্রযুক্ত। এগুলির ভেতর অধিকাংশ জায়গাই ফাঁকা। ধাতব আয়ন এবং জৈব লিঙ্কার দিয়ে  তৈরি এই গঠন গুলিকে বিজ্ঞানীরা  বিভিন্ন কাজে, যেমন গ্রিনহাউস গ্যাসগুলিকে আটকে রাখা, হাইড্রোজেন সংরক্ষণ করা, এমনকি ওষুধ সরবরাহ করার ক্ষেত্রেও ব্যবহার করতে পারেন।

আরও পড়ুন 

ডিজিটাল ডিটক্সের মাঝেই নোবেল জয়! নির্জন যাপনের মধ্যেই জুটল সেরার শিরোপা

এই ধাতব-জৈব কাঠামোর আণবিক গঠনের ধারণা অনেক আগের। আজ থেকে ৫০ বছর আগে রব্সন তাখন সদ্য সদ্য ইউনিভার্সিটি অব মেলবোর্নে পড়াতে ঢুকেছেন। কাঠের টুকরোতে ছিদ্র করে করে কাঠি যোগ করে বিভিন্ন জৈব কাঠামোর মডেল বানানোর দায়িত্ৱ পড়েছে, যেগুলি দিয়ে শিক্ষার্থীরা সিলাবাসের বিভিন্ন জিনিস শিখবে। সেই কাজ করতে গিয়ে তিনি খেয়াল করেন কাঠের টুকরোতে গর্ত গুলো ঠিক কথায় হবে তার উপর নির্ভর করছে জৈব কাঠামোর মডেলের প্রকৃতি। এক দশক কাটার পর আশির দশকের শেষ দিকে রব্সন প্রথম ভাবলেন, যদি ধাতব আয়নকে ‘কোণ’ আর জৈব যৌগকে ‘ছড়ি’ হিসেবে ব্যবহার করা যায়, তাহলে এক ধরনের ত্রি-মাত্রিক নেটওয়ার্ক বানানো সম্ভব, যেটি হবে স্থির, সুশৃঙ্খল এবং ফাঁপা— যেন থরে থরে অণুর ভেতর অণুদের জন্য ঘর সাজানো আছে। সেখান থেকেই জন্ম নিল ধাতু–জৈব কাঠামোর মূল ধারণা। ১৯৮৯ সালে তাঁর কাজ চেপে বেরোল জার্নাল অব দ্য আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটি-তে। কিন্তু সে কাঠামো তখনও খুব ভঙ্গুর, জল বা বায়ুর আঘাত পেলেই ভেঙে যেত।

তারপর মঞ্চে এলেন সুসুমু কিতাগাওয়া, জাপানের কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তিনি প্রথম থেকেই দার্শনিক গোছের; অনুপ্রানিত হয়েছিলেন আর এক জাপানি বিজ্ঞানী, ইউকাওয়ার (মেসন কণার আবিষ্কর্তা) একটি বই পড়ে। ইউকাওয়া তাঁর বইতে প্রাচীন এক চিনা দার্শনিক প্রবাদ উল্লেখ করেন- ‘নষ্ট জিনিস মানে একেবারে নষ্ট নয়, কাজে লাগে মাঝে মাঝে’। কথাটা বেশ মনে ধরে ভদ্রলোকের। তিন দশক আগে তিনি যখন নিজের তৈরি প্রথম দ্বি-মাত্রিক আণবিক কাঠামোটি উপস্থাপন করেন, সেটা বিশেষ কাজের ছিল না, তবে ওর মধ্যে অ্যাসিটোন অণু লুকিয়ে রাখা যেত।

আরও পড়ুন 

কোয়ান্টামের জগতে নোবেল স্বীকৃতি তিন বিজ্ঞানীর হাত ধরে নতুন দিগন্ত

হাল ছাড়ার পাত্র তিনি নন। এই জাপানি বিজ্ঞানীর বড় সাফল্য আসে ৯৭ সালে; তাঁর নেতৃত্বে  গবেষকেরা কোবাল্ট, নিকেল বা জিঙ্ক আয়ন এবং 4,4'-বাইপিরিডিন অণু ব্যবহার করে একটি  ত্রি-মাত্রিক ধাতব জৈব কাঠামো তৈরি করেন, যেটি বেশ শক্তিশালী এবং স্থিতিশীল। পরের বছর, তিনি বুলেটিন অব দ্য কেমিক্যাল সোসাইটি অব জাপান-এ তাঁদের তৈরি ধাতব যৌগ সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ লেখেন। এছাড়াও তিনি দেখান কিছু MOF গ্যাস শোষণ করলে ‘ফুলে ওঠে’— আবার গ্যাস ছাড়লে ‘চুপসে যায়’। বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে “breathing MOF”।

সবশেষে, আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলে’র অধ্যাপক ওমর ইয়াঘি এই গবেষণাকে পরিণতি দিলেন। জর্ডানের আম্মান শহরে জন্ম নেওয়া ওমর দশ বছর বয়সে হাতে নিলেন এক বই, যার পাতায় পাতায় হরেক রকমের আনবিক গঠন। ভবিষ্যতে এই ছেলের হাতেই জন্ম নিল জালের মতো ভিন্ন দ্বি-মাত্রিক আনবিক গঠন। তাঁর গবেষণার জন্ম দিল এক নতুন এক বিভাগ— Reticular Chemistry, যার কাজই হলো 'জাল বুনে রাসায়নিক নকশা তৈরি'। ওমরের তত্ত্ৱাবধানে তৈরি MOF-5 তাক লাগিয়ে দিল রসায়নের দুনিয়ায়; মাত্র কয়েক গ্রাম MOF-5-এর অভ্যন্তরীণ পৃষ্ঠের ক্ষেত্রফল একটা ফুটবল মাঠের সমান!

কী কাজে লাগবে এই অরুপ রতন? শিল্পক্ষেত্রে নির্গত CO₂-কে বন্দি করা, হাইড্রোজেন ও মিথেন গ্যাসকে সংরক্ষণ করা, মরুভূমির আর্দ্রতা থেকে জলের জোগান দেওয়ার মতো অভিনব কাজ করতে পারে এই MOF; এটি বিশ্ববাসীকে দেখিয়েছে রসায়ন মানে কেবল বিদ্ঘুটে সব বিক্রিয়াই নয়, এটি নিত্য নতুন নকশারও  বিজ্ঞান।

More Articles