সাবান-শ্যাম্পু কিনতেও দশ বার ভাবছে মধ্যবিত্ত? সামনে এল যে রিপোর্ট
Economy Of India: আসল কথা হচ্ছে, মধ্যবিত্ত শ্রেণি বাজারমুখো হচ্ছে কম। উৎসবের মরসুমের আগে মধ্যবিত্ত শ্রেণি আগে যে পরিমাণ কেনাকেটা করত, সেই জায়গাটা কমতে কমতে তলানিতে ঠেকেছে।
মোদি জমানায় দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি চোখ কপালে তোলার মতোই। সরকার অন্তত তেমনই দাবি করে চলেছে। দেশের জিডিপি বাড়ছে তড়তড়িয়ে। আসন্ন সময়ে অন্তত আরও ৭ শতাংশ জিডিপি বাড়ার পূর্বাভাসও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তব কি সত্যিই ততটা মধুর? সম্প্রতি একাধিক পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, দেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণি ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। কমছে তাদের ক্রয়ক্ষমতা। কেন? তবে কি বাজারমাফিক আয়বৃদ্ধির যে স্বাভাবিক ধারা, সেখানেই গোল? নাকি এই সমস্যা প্রোথিত আরও গভীরে?
সম্প্রতি নেসলে ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যান বেশ কিছু ম্যাক্রো-ইকোনমিক ডেটা আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। যেখানে দেখা যাচ্ছে, সাম্প্রতিক কালে ভারতীয় মধ্যবিত্তদের আয় ও ব্যায়— দুই-ই কমেছে পাল্লা দিয়ে। দেশের অন্যতম FMGC (ফাস্ট-মুভিং কনজিউমার গুডস) সংস্থা নেসলের সিএমডি সুরেশ নারায়ণম স্পষ্টতই জানাচ্ছেন, তাঁর সংস্থার ক্ষেত্রে শহরাঞ্চলে বহু সেগমেন্টেই বিক্রিবাটা চোখে পড়ার মতো কমেছে। অর্থাৎ সাধারণ সাবান-শ্যাম্পুর মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটার ক্ষেত্রেও অনেক সাবধানী মানুষ। বিশেষত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ।
এফএমজিসি সংস্থাগুলির ক্ষেত্রে খুব বড় একটা জায়গা মিডল সেগমেন্ট। যেখানে ভিড় জমান মধ্যবিত্তরা। সংস্থাগুলোর বিক্রির একটা বড় অংশ নির্ভর করে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির উপরেই। কিন্তু সেই ভরসার জায়গাটাই মার খাচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে। কারণে দেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণি ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। ত্রৈমাসিক বৃদ্ধির হার বিবেচনা করে দেখা যাচ্ছে তেমনটাই। এবং যা একেবারেই স্বাভাবিক নয় বলেই জানাচ্ছেন সুরেশ নারায়ণম।
আরও পড়ুন: মোদির ‘বিকশিত ভারতে’র দাবি আদৌ সত্য? আসলে যেখানে দাঁড়িয়ে দেশের অর্থনীতি
চলতি বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালের মে মাসের আয়ের হিসেবনিকেশ করে এশিয়ান পেইন্টসের সিইও জানিয়েছিলেন, সরকার জিডিপি বৃদ্ধির যে হিসেব দিচ্ছে, তার সঙ্গে তাদের সেক্টোরাল পারফর্মেন্স মিলছে না আদপেই। যদিও তাঁর সেই বক্তব্যের পরেই বেশ বিতর্ক শুরু হয়ে যায়। তড়িঘড়ি নিজের বক্তব্য প্রত্যাহার করে এশিয়ান পেইন্টসের তরফে জানানো হয়, সিইও-র বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। সরকার-বিরোধী কিছু বলার ইচ্ছা ছিল না তাঁর। কিন্তু সরকার যা-ই বলুক না কেন, বহু কর্পোরেট এবং মার্কেট অ্যানালিস্টই কিন্তু বলছেন ভারতের গ্রামীণ এবং শহরাঞ্চল, দুই এলাকাতেই মানুষের কেনাকাটার হার কমেছে।
আসল কথা হচ্ছে, মধ্যবিত্ত শ্রেণি বাজারমুখো হচ্ছে কম। উৎসবের মরসুমের আগে মধ্যবিত্ত শ্রেণি আগে যে পরিমাণ কেনাকেটা করত, সেই জায়গাটা কমতে কমতে তলানিতে ঠেকেছে। গাড়িবিক্রি সংক্রান্ত একটি সাম্প্রতিক রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন ইনভেন্ট্ররি অর্থাৎ ডিলারদের কাছে স্টকে পড়ে রয়েছে প্রায় ৭ লক্ষ গাড়ি, যার মিলিত দাম হতে পারে প্রায় ৮৬ কোটি টাকার কাছাকাছি। অর্থাৎ যে পরিমাণ গাড়ি তৈরি হচ্ছে, সেই পরিমাণ গাড়ি বিক্রির বাজার তৈরি হচ্ছে না। ডিলারদের কাছে প্যাসেঞ্জার গাড়ির স্টক ২০২৩ সালের এই সময়ের তুলনায় চলতি বছর বেড়েছে প্রায় ৭৫ শতাংশ। গত কয়েক বছরে এই পরিমাণে চাহিদার ঘাটতি দেখা গিয়েছে কিনা সন্দেহ। বাণিজ্যিক গাড়ির বিক্রিও চলতি বছর প্রায় ৪ থেকে ৬ শতাংশ কমেছে। সেই তুলনায় অবশ্য দু'চাকার বিক্রি বেড়েছে। তবে সেই সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য় কিছু নয়, অন্তত ২০১৮ সালের সাপেক্ষে তো বটেই।
অফিশিয়াল স্পিন মাস্টারদের অনেকেই বলেছেন, ভারতীয় মধ্যবিত্তদের অনেকেই কমদামী গাড়ির দিকে আর ঝুঁকছেন না। বরং তাঁরা বেশি দামী এসইউভি-র কেনার দিকেই বেশি মন দিচ্ছেন। যদিও মারুতি সংস্থার চেয়ারম্যান আরসি ভার্গব সেই সম্ভাবনাকে কার্যত উড়িয়ে দিয়ে জানিয়েছেন, এসইউভি-র বিক্রি এখনও বেশি কারণ উচ্চবিত্তরা এখনও এসইউভি কিনছেন বেশি পরিমাণে। আর মধ্যবিত্ত, যারা সংখ্যায় আসলে অনেক বেশি, তাদের আয় ও ক্রয়ক্ষমতা কোথাও একটা থমকে গিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, কোভিড পরবর্তী সময়ে ইংরেজি 'কে' হরফের আকারের যে জিডিপি বৃদ্ধির কাঠামো অর্থনীতিবিদেরা দেখিয়েছেন, সেই ধারাই অব্যাহত রয়েছে। অর্থাৎ প্রিমিয়াম সেগমেন্টের বিক্রিবাটা বাড়লেও মধ্যবিত্ত সেগমেন্টের বাজার কমেছে অনেকটাই।
শুধু শহরাঞ্চলেই নয়, গত কয়েক দশক ধরে গ্রামীণ এলাকাতেও ছবিটা কার্যত একই। আগামী দিনে প্রায় ৭ শতাংশ জিডিপি বৃদ্ধির পূর্বাভাসের কথা বলা হলেও বাজার কিন্তু তেমন কথা বলছে না। শহরাঞ্চলে মধ্যবিত্তদের কেনাকাটার হার গত কয়েক মাসে এদিকে উল্টো ছবিটাই তুলে ধরছে। জিডিপি বাড়লেও তার প্রতিফলন কেন মধ্যবিত্তের ক্রয়ক্ষমতায় পড়ছে না, তা কার্যত একটা ধাঁধাই বলা যেতে পারে। National Sample Survey Office (NSSO)-র সমীক্ষা বলছে, গত এক দশক ধরে ক্রয়বৃদ্ধির বার্ষিক হার ৩.৫ শতাংশ, যা জিডিপি বৃদ্ধির অর্ধেক। জিডিপি বৃদ্ধির একটি অর্থ মানুষের আয় বাড়ছে। আর তা যদি বেড়েই থাকে, তাহলে তা কেনাকাটার ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হচ্ছে না কেন? কেউ কেউ বলছেন, আজকাল মধ্যবিত্তরা অনেক বেশি সঞ্চয়ী হয়েছেন। বাজে খরচে তাঁরা নেই। তাই যদি হয়, সেক্ষেত্রে তো ছোট ছোট ক্ষেত্রে সঞ্চয়হার বাড়ার কথা। সেক্ষেত্রেও সার সত্য সেই সংকোচনই। তবে কি জিডিপি বৃদ্ধি নিয়ে সরকারের এই শ্রীবৃদ্ধির দাবি ফুলানো-ফাঁপানো গ্যাসবেলুন ছাড়া আর কিছুই নয়? এমন সংশয় প্রকাশ করছেন বহু অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞই।
আরও পড়ুন:ভারতের থেকে বেশি সুখে আছে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনও! সামনে এল যে চাঞ্চল্যকর তথ্য
ফলে এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে ভারতীয় মধ্যবিত্তদের আয়-ব্যয়ের এই স্থিতবস্থার বিষয়টি গভীর ভাবে খতিয়ে দেখার প্রয়োজন রয়েছে বলেই মনে করছেন অনেকে। আমেরিকান পিউ রিসার্চ সেন্টারের তথ্য বলছে, ২০১০ সালে দেশে মধ্যবিত্তের সংখ্যা ছিল ৫০-৭০ মিলিয়নের কাছাকাছি। ২০২০ সালে সেই সংখ্যাটা পৌঁছেছে ১৫০-২০০ মিলিয়নের কাছাকাছি। ২০১৭ সালে পিউ ভারত এবং চিনের মধ্যবিত্ত শ্রেণির উপর একটি গবেষণা চালায়। যেখানে দেখা গেল, দৈনিক ১০ ডলার থেকে ৫০ ডলার আয় রেঞ্জের মধ্যে ভারতীয় মধ্যবিত্তের সংখ্যা ১০৮ মিলিয়ন। যেখানে চিনের মধ্যবিত্ত সংখ্যা সেসময় ছিল ৭০৭ মিলিয়নের কাছাকাছি। আরও ভালো করে বলতে গেলে, চিনের জনসংখ্যার প্রায় ৬১ শতাংশ দিনে ১০ ডলার আয় করে থাকেন। ভারতের ক্ষেত্রে সেই সংখ্যাটা মাত্র ৩ শতাংশ। অর্থাৎ চিনের নিম্নবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির একটা বড় অংশকে মধ্যবিত্ত শ্রেণির আওতায় আনতে সফল হয়েছে সে দেশের অর্থনীতি। ভারতের কাছে যা এখনও স্বপ্ন মাত্র।
চিনের ক্ষেত্রে জিডিপির উপর করের পরিমাণ ২০০০ সালে ১৪ শতাংশ ছিল, তা ২০২০ সালে বেড়ে হয়েছে ২৩ শতাংশ। ভারতের ক্ষেত্রে এই সময়কালে বৃদ্ধি হয়েছে ১৫ শতাংশ থেকে মাত্র ১৮ শতাংশ। যদি ভারত সরকারের জিডিপি বৃদ্ধির দাবি পুরোপুরি সত্যিই হত, তাহলে কর থেকে প্রাপ্ত আয়ও তো পাল্লা দিয়ে বাড়ত। কিন্তু তেমনটা আদতে কিন্তু দেখা যায় না। এর নেপথ্যের আসল কারণ হিসেবে বলাই যায়, মধ্যবিত্তের আর্থিক বৃদ্ধি সেই গতিতে হচ্ছে না। সাম্প্রতিক কালে তাঁদের আয় এবং ক্রয়ক্ষমতা দু'টোই যে কারণে থমকে গিয়েছে একেবারে। আর সরকার জিডিপি বৃদ্ধির ঝুটো সন্তোষ নিয়ে নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ে চলেছে অনবরত। ভারত পৃথিবীর অন্যতম দ্রুত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত অর্থনীতির দেশ, এমন একটা ভুয়ো ধারণা বুকে আগলে বসে রয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যের কথা এই যে, কেউ এসে একবারও জিজ্ঞেস করছে না, 'রাজা তোর কাপড় কোথায়'? কেউ প্রশ্ন করছে না, এই যে এত প্রবৃদ্ধি, তা আসলে যাচ্ছেটা কোথায়? তা সমাজের প্রতিটি স্তরে সমান ভাবে বণ্টন হচ্ছে তো? নাকি আসলে সর্ষের মধ্যেই বসে রয়েছে ভূত!