'আমাদের বন বিক্রির জন্য নয়', কেন COP30 সম্মেলনে আদিবাসী ও পরিবেশকর্মীদের প্রতিবাদ?

COP30 Brazil: ১২ নভেম্বর দুপুরে একদল পরিবেশ ও আদিবাসী অধিকারকর্মী সম্মেলনকেন্দ্রের মূল প্রবেশদ্বারে ঢোকার চেষ্টা করলে তাঁদের সঙ্গে নিরাপত্তারক্ষীদের ধাক্কাধাক্কি বেঁধে যায়।

বিশ্বজুড়ে ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা ও জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ প্রভাব মোকাবিলায় এবার বিশ্বের দেশগুলো জড়ো হয়েছে ব্রাজিলের বেলেম শহরে, জাতিসংঘের বার্ষিক জলবায়ু সম্মেলন COP30-এ। ২০১৫ সালের ঐতিহাসিক প্যারিস চুক্তির দশ বছর পূর্তিতে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনকে ঘিরে যেমন আশা, তেমনি হতাশাও দেখা দিয়েছে। কারণ, চলমান এই সম্মেলনের চতুর্থ দিনে উত্তেজনা ছড়াল। বুধবার (১২ নভেম্বর) দুপুরে একদল পরিবেশ ও আদিবাসী অধিকারকর্মী সম্মেলনকেন্দ্রের মূল প্রবেশদ্বারে ঢোকার চেষ্টা করলে তাঁদের সঙ্গে নিরাপত্তারক্ষীদের ধাক্কাধাক্কি বেঁধে যায়।

চোখে রঙিন হেডব্যান্ড, হাতে ব্যানার ও প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, “Our forests are not for sale” (আমাদের বন বিক্রির জন্য নয়)। বিক্ষোভকারীদের দাবি, জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, তাতে স্থানীয় জনগণ ও আদিবাসীদের মতামত উপেক্ষা করা হচ্ছে। তাঁদের বক্তব্য, “তারা আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, কিন্তু আমাদের কথা শুনছে না।” বিক্ষোভকারীদের একটি দল নিরাপত্তা বেষ্টনী পেরিয়ে ভবনের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করলে, নিরাপত্তারক্ষীরা বাধা দেন। সেই সময় দুই পক্ষের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা গার্ডিয়ান-এ জানিয়েছেন, একজন নিরাপত্তারক্ষী আহত হন এবং কয়েকজন বিক্ষোভকারীকে আটক করে বাইরে সরিয়ে দেওয়া হয়। ঘটনার পরপরই পুলিশ ও আয়োজক সংস্থা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। সম্মেলনকেন্দ্রের ভেতরে আলোচনাও কিছু সময়ের জন্য স্থগিত রাখা হয়।

এই ঘটনার পর আয়োজক কমিটি জানায়, শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের অধিকার তারা সম্মান করে, তবে নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার যে কোনো প্রচেষ্টা বরদাস্ত করা হবে না। অন্যদিকে, বিক্ষোভকারীদের সংগঠনগুলোর অভিযোগ— COP30 সম্মেলনে তাঁদের কথা শোনা হচ্ছে না। বিক্ষোভকারীদের মধ্যে থেকে এক আদিবাসী নেতা বলেন, “আমরা যে বন রক্ষা করি, সেই বন নিয়েই আলোচনা চলছে, অথচ সেই টেবিলে আমাদের জায়গা নেই।” ব্রাজিল সরকার COP30 আয়োজনে নিজেদের ‘পরিবেশবান্ধব প্রতিশ্রুতি’র কথা তুলে ধরছে। দেশটির পরিবেশমন্ত্রী জানিয়েছেন, “এই সম্মেলন শুধু নীতি নয়, মানুষের কণ্ঠস্বর শোনার জায়গা।” তবে এই ঘটনার পর আন্তর্জাতিক মহলে প্রশ্ন উঠেছে— বাস্তবে আদিবাসীদের অংশগ্রহণ কতটা নিশ্চিত হচ্ছে?

আরও পড়ুন

ভারত বিশ্বের নবম বৃহত্তম বনভূমি! FAO রিপোর্টে নতুন যে তথ্য উঠে এল

COP30 কী?

COP30 হলো 'Conference of the Parties', ‘চুক্তিভুক্ত দেশগুলির সম্মেলন’। এটি জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত চুক্তির (UNFCCC) আওতায় অনুষ্ঠিত ৩০তম বৈঠক। প্রায় ২০০টি দেশ এই চুক্তির স্বাক্ষরকারী, যারা প্রতি বছর একত্রিত হয়ে বিশ্ব উষ্ণতা কমানোর লক্ষ্যে পরিকল্পনা ও অগ্রগতি পর্যালোচনা করে। COP30 আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে ১০ নভেম্বর এবং চলবে ২১ নভেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত। তবে মূল আলোচনা শুরুর আগেই ৬ ও ৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হয় নেতাদের সম্মেলন, যেখানে উপস্থিত ছিলেন কয়েকজন শীর্ষ নেতা। এবারই প্রথমবারের মতো এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে ব্রাজিলের বেলেমে।

এই সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন— যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী স্যার কেয়ার স্টার্মার, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ এবং আয়োজক দেশ ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস, ইউরোপীয় কমিশনের সভাপতি উরসুলা ফন ডার লায়েন এবং ব্রিটেনের প্রিন্স অব ওয়েলস, যিনি রাজা চার্লসের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন। তবে অনুপস্থিত ছিলেন বিশ্বের দুই সবচেয়ে বড় কার্বন নিঃসরণকারী দেশের নেতা— চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আগেই জানিয়ে ছিল, তারা কোনো উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি পাঠাবে না।

কেন ব্রাজিলকে বেছে নেওয়া হলো?

ব্রাজিল বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বনাঞ্চল আমাজন রেইনফরেস্ট-এর দেশ, যা পৃথিবীর 'ফুসফুস' নামে পরিচিত। তাই এই অঞ্চলে জলবায়ু সম্মেলন আয়োজনকে প্রতীকী গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে সিদ্ধান্তটি বিতর্কও সৃষ্টি করেছে। অনেক প্রতিনিধি দলের অভিযোগ, বেলেমে থাকা-খাওয়ার খরচ এত বেশি যে দরিদ্র দেশগুলোর অংশগ্রহণ কঠিন হয়ে পড়েছে। সম্মেলনের জন্য নতুন রাস্তা তৈরির সময় বনের একটি অংশ কেটে ফেলা হয়েছে, যা পরিবেশবাদীদের ক্ষুব্ধ করেছে। তাছাড়া ব্রাজিল এখনও তেল ও গ্যাস উত্তোলনের নতুন লাইসেন্স দিচ্ছে— যা জলবায়ু সংকটের মূল কারণগুলির একটি।

কেন COP30 গুরুত্বপূর্ণ?

প্যারিস চুক্তিতে দেশগুলো প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল— বিশ্ব উষ্ণতা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখবে। কিন্তু বাস্তবে তাপমাত্রা বেড়ে চলেছে, এবং এখন এই সীমা অতিক্রম করাই অবশ্যম্ভাবী বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। জাতিসংঘ জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত মাত্র এক-তৃতীয়াংশ দেশ নতুন পরিকল্পনা (emission reduction plans) জমা দিয়েছে— যা প্রতিশ্রুতির তুলনায় অনেক কম। গুতেরেস সতর্ক করেছেন, “১.৫ ডিগ্রি লক্ষ্য অতিক্রম হবে, তবে শতাব্দীর শেষে আমরা আবার সেটি নামিয়ে আনতে পারি, যদি এখনই পদক্ষেপ নিই।” জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস স্পষ্টই বলেছেন— ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস সীমা 'অতিক্রম করা এখন অনিবার্য'।

আরও পড়ুন

ভাঙছে আফ্রিকা, তৈরি হচ্ছে নতুন মহাসাগর! পৃথিবীর মানচিত্র বদলে যেতে পারে যে ঘটনায়

গত বছর COP29-এ ধনী দেশগুলো প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তারা ২০৩৫ সালের মধ্যে বছরে অন্তত ৩০০ বিলিয়ন ডলার দেবে দরিদ্র দেশগুলিকে জলবায়ু মোকাবিলায় সহায়তার জন্য। কিন্তু দরিদ্র দেশগুলির দাবি, এই অর্থ যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন কমপক্ষে ১.৩ ট্রিলিয়ন ডলার। ব্রাজিল এবার একটি রোডম্যাপ প্রকাশ করেছে, যেখানে দেখানো হয়েছে কীভাবে এই তহবিল লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব। COP28-এ দেশগুলো প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ২০৩০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য শক্তির ক্ষমতা তিনগুণ বাড়ানোর। কিন্তু আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থা (IEA) জানিয়েছে, বর্তমান গতিতে সেই লক্ষ্য পূরণ সম্ভব নয়। সম্মেলনের উদ্বোধনী দিনে ব্রাজিল ঘোষণা করেছে একটি নতুন তহবি— “Tropical Forests Forever Facility”, যার লক্ষ্য ১২৫ বিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বন সংরক্ষণ। তবে যুক্তরাজ্য জানিয়েছে, তারা এতে সরকারি অর্থ দেবে না, বেসরকারি সংস্থাগুলো যেন নিজেরা বিনিয়োগ করে।

অনেক সমালোচক COP সম্মেলনগুলিকে “গ্রিনওয়াশিংয়ের মঞ্চ” বলে অভিযোগ করেন অর্থাৎ, দেশগুলো শুধু পরিবেশবান্ধব চিত্র তুলে ধরে, কিন্তু বাস্তবে খুব কম কাজ করে। তবুও, COP-ই একমাত্র বৈশ্বিক মঞ্চ যেখানে প্রায় সব দেশ একসঙ্গে বসে ভবিষ্যতের পৃথিবী নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়।

তবে এই বছরের আলোচনায় সবচেয়ে বড় বাধা এসেছে ট্রাম্প প্রশাসনের জলবায়ু-বিরোধী অবস্থান থেকে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট সম্প্রতি এক বক্তৃতায় বলেছেন, “জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রতারণা।” তিনি আবারও প্যারিস চুক্তি থেকে সরে যাওয়ার হুমকি দিয়েছেন এবং তেল-গ্যাস উত্তোলন বাড়ানোর ঘোষণা করেছেন। এর ফলে বৈশ্বিক ঐক্য অর্জন আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। এর আগে প্লাস্টিক দূষণ ও শিপিং নির্গমন নিয়েও বৈশ্বিক চুক্তি আটকে গিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কিছু দেশের আপত্তিতে। এ কথাও বলা জরুরি, জলবায়ু নীতিতে শুধু বৈজ্ঞানিক বা অর্থনৈতিক দিক নয়, সামাজিক ও মানবিক দিকও সমান গুরুত্বপূর্ণ। আদিবাসী ও স্থানীয় জনগণ যে এই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে চান— COP30-এ তাঁদের সেই দাবিই আবারও জোরালোভাবে উঠে এল। একদিকে পরিবেশবাদী ও আদিবাসীরা দাবি করছেন প্রকৃতি রক্ষায় বাস্তব পদক্ষেপ, অন্যদিকে অনেক দেশের রাজনৈতিক টানাপোড়েনে আলোচনা আটকে যাচ্ছে। তবুও আশা করতে হচ্ছে, কারণ যত দেরিই হোক, জলবায়ু নিয়ে বৈশ্বিক সংলাপের একমাত্র পথ এখনও COP-ই।

More Articles