চা খেতে ডেকেছিলেন খোদ দাউদ ইব্রাহিম! ঋষি কাপুরের বয়ানেই স্পষ্ট বলিউডের মাফিয়া যোগ?
Dawood Ibrahim And Rishi Kapoor: বর্ষীয়ান অভিনেতা বলেছিলেন, “আমি মনে করি না দাউদের বাড়ি গিয়ে আমি কোনও ভুল করেছি। লোকে যত বলে, আমাদের দেশের বিরুদ্ধে দাউদ সেরকম কিছুই করেননি”।
দাউদ ইব্রাহিম, নামটাই যথেষ্ট বুকে কাঁপুনি ধরানোর জন্য। আশির দশক থেকে একটানা ৩০ বছর আন্ডারওয়ার্ল্ডের বেতাজ বাদশা ছিলেন দাউদ ইব্রাহিম। ১৯৯৩ সালে ১২ মার্চ মুম্বইতে পরপর বোমা বিস্ফোরণে তিনশোরও বেশি মানুষ নিহত হন। মনে করা হয় এর মাস্টারমাইন্ড ছিলেন দাউদই। ২০১৩ সালের মার্চ মাসে দেশের সুপ্রিম কোর্ট জানিয়ে দেয় এই বোমা হামলায় দাউদ ইব্রাহিম সরাসরি জড়িত। সেই থেকেই তিনি আত্মগোপন করে রয়েছেন বলে জানা যায়। তবে আজ হঠাৎ কেন প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠলেন দাউদ? বুঝতে পারবেন একটু পরেই। আপাতত এই প্রতিবেদনের দ্বিতীয় মূল চরিত্রের সঙ্গে আলাপ করে নেওয়া যাক।
তাঁর সম্বন্ধে বলা হয়, বলিউডকে যুবক বানিয়েছিলেন তিনি। তিনি বলিউডের অন্যতম জনপ্রিয় অভিনেতা ঋষি কাপুর। ১৯৭০ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে বলিউডে পা রাখেন রাজ কাপুরের পুত্র ঋষি কাপুর। জীবনে একের পর এক বহু সুপারহিট সিনেমা উপহার দিয়ে গিয়েছেন তিনি। তাঁর পুত্র রণবীর কাপুরও বলিউডের একজন প্রতিষ্ঠিত অভিনেতা। যাই হোক, এবার আসা যাক আসল কথায়। কেন লেখার শুরুতেই দাউদ ইব্রাহিমের কথা এল? নিজের আত্মজীবনীতে দাউদ ইব্রাহিমের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের দু’টি ঘটনা উল্লেখ করেছিলেন ঋষি কাপুর। একই সঙ্গে এমন কিছু কথাও বলেছিলেন যা পরবর্তীকালে বিতর্কের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
শুরু করা যাক প্রথম ঘটনা দিয়ে। দাউদ ইব্রাহিমের সঙ্গে ঋষি কাপুরের প্রথম দেখা হয় ১৯৮৮ সালে দুবাইতে। আশা ভোঁসলে-রাহুল দেব বর্মনের অনুষ্ঠানের জন্য ঋষি, তাঁর বন্ধু বিট্টু আনন্দের সঙ্গে দুবাইতে গিয়েছিলেন। সেখানে এয়ারপোর্টে নামতেই দাউদের এক লোক ঋষি কাপুরকে দেখে এগিয়ে আসেন এবং একটি ফোন দিয়ে বলেন, দাউদ সাহেব আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান। তখন দাউদ ঋষি কাপুরকে নিজের বাড়িতে আসার আমন্ত্রণ জানান। সঙ্গে সঙ্গে দাউদের ওই লোক ঋষি কাপুর ও তাঁর বন্ধুকে গাড়িতে করে নিয়ে যান দাউদের বাড়িতে। ঋষি কাপুর লিখেছেন, “আমি যখন লাগেজ নিয়ে বিমানবন্দর ছেড়ে বেরোচ্ছি, সেই সময় হঠাৎই একটি অজানা, অচেনা যুবক আমার কাছে এগিয়ে এসে আমার হাতে একটা মোবাইল ফোন ধরিয়ে দিল। বলল, দাউদ সাব বাত করেঙ্গে। '৯৩-এর মুম্বই বিস্ফোরণের অনেক আগেকার ঘটনা। আর তখনও তেমন কেউই জানতেন না, দাউদ দেশের দুশমন।”
আরও পড়ুন- রাজপরিবারে প্রথম রানি এলিজাবেথের অভিষেকই দেখা গিয়েছিল টেলিভিশনে
ঘটনার বর্ণনা করতে গিয়ে ঋষি জানান, তাঁরা যখন পৌঁছলেন, তাঁদের স্বাগত জানাতে বেরিয়ে এলেন খোদ দাউদ ইব্রাহিম। দাউদ নাকি তাদের বলেছিলেন যে তিনি একদমই মদ খেতে এবং খাওয়াতে পছন্দ করেন না তাই তাঁদের চা খাওয়ার নেমন্তন্ন করা হয়েছে। তারপর তাঁদের খুব যত্ন করেই চা ও বিস্কুট খাইয়েছিলেন দাউদ। ঋষির সঙ্গে আড্ডায় দাউদ নিজের বহু অপরাধমূলক কাজের কথাও তাঁকে বলেন, সঙ্গে এও বলেন যে সেই কাজগুলির জন্য তাঁর কোনও অনুশোচনা নেই। দাউদ ঋষিকে জানান, তাঁর বাবা রাজ কাপুর, তাঁর দুই কাকা শাম্মি ও শশী, দিলীপকুমার, মেহমুদ সহ বেশ কয়েকজন ভারতীয় অভিনেতার তিনি ভক্ত। ঋষিকে সেদিন ঘণ্টা চারেক দাউদের সঙ্গে কাটাতে হয়। এরপর দাউদের বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় দাউদ ঋষিকে ডেকে বলেন, “কখনও কিছুর প্রয়োজন হলে, টাকা বা যা কিছু, আমাকে নির্দ্বিধায় জিজ্ঞাসা করবেন”। ঋষি তাঁর বইয়ে লিখেছেন, “দাউদ বলেছিলেন, আমার ‘তাওয়াইফ’ ছবিটি ওঁর ভালো লেগেছিল। ওই ছবিতে আমার ভূমিকার নাম ছিল দাউদ। আমার বাবা, আমার কাকাদের সম্পর্কেও শ্রদ্ধাশীল ছিলেন দাউদ। সেদিন আমরা বেশ কয়েক কাপ চা খেয়েছিলাম।”
দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটে এক বছর পর, অর্থাৎ ১৯৮৯ সালে। দুবাইয়ের এক দোকানে স্ত্রী নীতুর সঙ্গে জুতো কিনতে গিয়েছিলেন ঋষি কাপুর। ঘটনাচক্রে তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন দাউদও। ঋষি কাপুর তাঁর আত্মজীবনীতে জানিয়েছেন, সেই সময় দাউদকে ঘিরে ছিল ৮-১০ জন দেহরক্ষী এবং দাউদের হাতে ছিল ফোন। ঋষি কাপুর এর আগে কখনও কোনও মানুষকে এভাবে ফোন নিয়ে ঘুরতে দেখেননি। কেননা ভারতে তখনও ‘মোবাইল’ ফোন আসতে কয়েক বছর দেরি আছে। আসল ঘটনায় আসা যাক, ঋষি জানান সেবারও দাউদ তাঁকে দোকান থেকে কিছু উপহার কিনে দিতে চান। ভদ্রতার খাতিরে ঋষি না করে দেন দাউদের প্রস্তাবে। তখন দাউদ নিজের মোবাইল ফোন নম্বর দেন ঋষিকে এবং কোনও দরকার হলে নির্দ্বিধায় ফোন করতে বলেন। অবশ্য ঋষি তাঁকে কোনও ফোন নম্বর দেননি, কারণ ভারতে তখনও মোবাইল ফোন আসেইনি।
এরপর দাউদের সঙ্গে ঋষি কাপুরের আর কোনও সাক্ষাৎ হয়েছিল কিনা জানা যায় না। এই দু’টি সাক্ষাতের পরেই ১৯৯৩ সালে ঘটে মুম্বইয়ের সেই কুখ্যাত বোমা বিস্ফোরণগুলি। লেখার শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে, ঋষি কাপুর এই দাউদ সম্পর্কিত কিছু মন্তব্য করেছিলেন যার জেরে পরবর্তীকালে বেশ বিতর্ক হয়েছিল। ইন্ডিয়া টুডে-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অভিনেতাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তিনি মাফিয়া দাউদ ইব্রাহিমের সঙ্গে চা খেয়েছেন বলে কি তাঁর অনুশোচনা বোধ হয়? এই প্রশ্নের উত্তরে একটি চমকে দেওয়া জবাব দিয়েছিলেন ঋষি কাপুর। ঋষি কাপুর সাফ জানিয়ে দেন কোনও অনুশোচনা বোধ করেন না তিনি, বরং দাউদকে দেখে তিনি অনুপ্রেরণা পান। বর্ষীয়ান অভিনেতা বলেছিলেন, “আমি মনে করি না দাউদের বাড়ি গিয়ে আমি কোনও ভুল করেছি। লোকে যত বলে, আমাদের দেশের বিরুদ্ধে দাউদ সেরকম কিছুই করেননি”।
আরও পড়ুন- বয়কট বলিউডের আহ্বান কতটা সমস্যায় ফেলতে পারে রণলিয়ার ‘ব্রহ্মাস্ত্র’-কে?
ঋষি কাপুরের এই মন্তব্য তোলপাড় ফেলে দেয় সারা দেশে। দাউদ ছাড়াও তিনি অন্য অপরাধীদের সঙ্গে দেখা করেছেন বলেও সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন ঋষি। সাক্ষাৎকারের এই ভিডিও প্রকাশ্যে আসায় অনেকে ক্ষুব্ধ হন। কেউ কেউ বলেন, দাউদের মতো মাফিয়ারা বলিউডে প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিলেন ঋষি কাপুরের মতো মানুষদের জন্যই। আবার কেউ কেউ সেই সময়ই (২০১৭ সালের প্ৰথমদিকে) বলিউডকে সম্পূর্ণ ভাবে বয়কট করার ডাক দিয়েছিলেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে মুক্তি পায় সিনেমা ‘ডি-ডে’। এই ছবিতে মুখ্য ভূমিকায় দেখা গিয়েছিল ইরফান খান, ঋষি কাপুর, অর্জুন রামপাল, শ্রুতি হাসান, হুমা কুরেশি প্রমুখকে। সেই ছবিতে দাউদের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন ঋষি কাপুর। নিজের আত্মজীবনী ‘খুল্লাম খুল্লা’-য় ঋষি কাপুর জানান ওই চরিত্রে অভিনয় করার জন্য তিনি দাউদের দ্বারাই অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।