চুইংগামে বিপদ! নিজের অজান্তেই দেহে যে বিষ প্রবেশ করাচ্ছেন আপনি

Chewing gum microplastics: এক টুকরো চুইংগামে শত শত বা কয়েক হাজার মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা মুখের মধ্যে চলে যেতে পারে। অর্থাৎ আমরা লালার মাধ্যমে এই মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা গিলে ফেলি।

মাইক্রোপ্লাস্টিক নিয়ে প্রচুর সচেতনতামূলক প্রচার চলছে। প্লাস্টিক পরিবেশের কী কী ক্ষতি করে এ এখন শিশুপাঠ্য। তবে মাইক্রোপ্লস্টিক যেহেতু সরাসরি চোখে দেখা যায় না তাই, এর বিপুল ক্ষতির মর্মান্তিক দিকগুলি আমাদের অগোচরেই থেকে যায়। পরিবেশ এবং মানুষ, দুইয়ের বিপদের মূলে এখন মাইক্রোপ্লাস্টিক জুড়ে গিয়েছে নিবিড়ভাবে। আমাদের রক্তপ্রবাহে, ফুসফুসে, যকৃতে, এমনকী মায়ের বুকের দুধেও মিলছে মাইক্রোপ্লাস্টিক। সম্প্রতি গবেষকরা জানিয়েছেন, চুইংগামের মধ্যে দিয়েও প্লাস্টিকের অতি ক্ষুদ্রকণা আমাদের দেহে প্রবেশ করছে।

আসলে প্লাস্টিকের এই ক্ষুদ্র কণাগুলি নানা উপায়েই আমাদের দেহে ঢুকে যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, একটি প্লাস্টিকের টিব্যাগ চায়ের কাপে ১০ বিলিয়ন মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা মিশিয়ে দেয়। ধরা যাক, আপনি আপনার বাড়ি সাজাচ্ছেন, পুরনো রঙের বদলে নতুন রঙ করাচ্ছেন, সেই পেইন্টের প্লাস্টিকের মধ্যে দিয়েও মাইক্রোপ্লাস্টিক বাতাসে মিশে যেতে পারে। এই মাইক্রোপ্লাস্টিক শ্বাসের মাধ্যমে আমাদের দেহে ঢুকে যায়। আবার, একক-ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের জলের বোতল থেকে জল খেতে গিয়ে মাইক্রোপ্লাস্টিক গিলে ফেলতে পারি আমরা। শরীরে মাইক্রোপ্লাস্টিকের নতুন উৎসটি হচ্ছে চুইংগাম। সেটিও গিলেই ফেলছি আমরা।

চুইংগামে পলিমার নামক লম্বা অণু থাকে। কিছু ব্র্যান্ডের চুইংগামে গাছের রস থেকে পাওয়া প্রাকৃতিক পলিমার থাকে। অন্যগুলোতে থাকে পেট্রোলিয়াম শিল্প থেকে প্রাপ্ত সিন্থেটিক পলিমার। এই বিভিন্ন পলিমার কিন্তু প্লাস্টিকের মতোই, কিছু পলিমার তো সত্যিই প্লাস্টিক। চুইংগামের মধ্যে থাকা পলিমার, সে প্রাকৃতিক হোক বা সিন্থেটিক, যখন চিবানোর মাধ্যমে ভেঙে যায় তখন প্লাস্টিকের মাইক্রো পার্টিকেল ছড়িয়ে দিতে পারে।

আরও পড়ুন-৬০৪টি তাজমহলকে ঢেকে ফেলতে পারে ভারতের প্লাস্টিক-বর্জ্য! সামনে এল যে ভয়ঙ্কর তথ্য

আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটির সভায় সম্প্রতি চুইংগাম বিষয়ক গবেষণাটি উপস্থাপিত হয়েছিল। এই সভায় একজন স্বেচ্ছাসেবক দশটি ব্র্যান্ডের চুইংগাম চিবিয়েছিলেন - পাঁচটি প্রাকৃতিক এবং পাঁচটি সিন্থেটিক। লালার নমুনা সংগ্রহ করা হয় ওই স্বেচ্ছাসেবকের মুখ থেকে এবং তা মাইক্রোস্কোপের মাধ্যমে দেখা হয়। দেখা যায়, প্রাকৃতিক এবং সিন্থেটিক দুই ধরনের চুইংগামেই মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে।

লস এঞ্জেলেসের ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার গবেষকরা বলছেন, এক টুকরো চুইংগামে শত শত বা কয়েক হাজার মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা মুখের মধ্যে চলে যেতে পারে। অর্থাৎ আমরা লালার মাধ্যমে এই মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা গিলে ফেলি।

চুইংগামে কী ধরনের প্লাস্টিক পাওয়া যায়? এগুলি হলো পলিস্টেরিন (যেমন খাবারের পাত্র নেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়), পলিথিন (প্লাস্টিকের মুদির ব্যাগ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়) এবং পলিপ্রোপিলিন (যা গাড়ির বাম্পার এবং ওষুধের বোতল তৈরিতে ব্যবহৃত হয়)। কিন্তু, চুইংগামের মধ্যেকার মাইক্রোপ্লাস্টিক নিয়ে চিন্তায় পড়ে যাওয়ার আগে, আমাদের জানতে হবে এই মাইক্রোপ্লাস্টিক আকারে কত বড়?

চুইংগাম চেবানো ওই স্বেচ্ছাসেবকের লালায় পাওয়া মাইক্রোপ্লাস্টিকগুলি ২০ মাইক্রোমিটার বা তারও বেশি আকারের ছিল। অর্থাৎ সবচেয়ে পাতলা মানুষের চুলের ব্যাসের মতোই। কিন্তু মানবদেহের একটি কোশের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে ১০ মাইক্রন বিশাল আকার (উদাহরণস্বরূপ, একটি লোহিত রক্তকণিকার ব্যাস প্রায় সাত মাইক্রন)। মাইক্রোপ্লাস্টিকের আকার গুরুত্বপূর্ণ কারণ যে মাইক্রোপ্লাস্টিক মানুষের কোশ এবং ভ্রূণের ক্ষতি করতে পারে তা এর চেয়ে ৫০০ থেকে ১,০০০ গুণ ছোট (২০ থেকে ৫০০ ন্যানোমিটার)। এই অতি-ক্ষুদ্র মাইক্রোপ্লাস্টিকগুলিকে ন্যানোপ্লাস্টিক বলা হয়।

ন্যানোপ্লাস্টিক বেশিই বিপজ্জনক কারণ এগুলি এতই ছোট যে এন্ডোসাইটোসিস নামক একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেহের জীবন্ত কোশ তা গিলে ফেলে। ন্যানোপ্লাস্টিক দেহের কোশে শোষিত হলে তারা সমস্ত ধরনের সমস্যাই সৃষ্টি করতে পারে। ন্যানোপ্লাস্টিক কোশকে প্রতিক্রিয়াশীল অক্সিজেন প্রজাতি নামক বিষাক্ত অণু তৈরি করতে বাধ্য করতে পারে। এই বিষাক্ত পদার্থগুলি সরাসরি কোশকে মেরে ফেলতে পারে না ঠিকই তবে তারা কোশকে দুর্বল করে দিতে পারে।

আরও পড়ুন- মাতৃদুগ্ধেও প্লাস্টিক! রোজ যাচ্ছে শিশুর পেটে! ভয়াবহ তথ্য এবার সামনে

যে প্লাস্টিকের কণাগুলি প্রাণীর ভ্রূণে জন্মগত ত্রুটির কারণ হয়ে উঠতে পারে তাও খুব ছোট অর্থাৎ ন্যানোপ্লাস্টিক, ওই স্বেচ্ছাসেবকের লালায় পাওয়া অনেক বড় আকারের মাইক্রোপ্লাস্টিক নয়।

চুইংগাম বিষয়ে এই গবেষণাটি খুব সহজে একটি সত্য আমাদের বুঝিয়ে দেয়। আমরা কত সহজেই, কত অজান্তেই নিজেদের দেহে শত শত মাইক্রোপ্লাস্টিক কণার আবাস গড়ে তুলছি। তবে, চুইংগাম চিবোলেই যে বড় রকমের স্বাস্থ্য সমস্যা হবে, তা বলার সময় এখনও আসেনি। চুইংগাম চিবানোর ফলে যে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে তা তুলনামূলকভাবে বিশাল আকারের এবং মানবদেহে এত বড় কণার প্রভাব যদি থেকেও থাকে তবে সেই সম্পর্কে এখনও বিস্তারিত কিছুই জানা যায়নি। গবেষকরা এখনও জানেন না, চুইংগাম আদৌ ন্যানোপ্লাস্টিক তৈরি করতেও সক্ষম কিনা। আসলে ন্যানোপ্লাস্টিক এতই ক্ষুদ্র যে তাদের শনাক্ত করার জন্য বিশেষ যন্ত্রপাতি প্রয়োজন। সেই কারণেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চুইংগাম গবেষকরা আপাতত ন্যানোপ্লাস্টিকের সন্ধান না করার সিদ্ধান্তই নিয়েছেন।

More Articles