না জেনেই খাচ্ছেন বিষ! ভারতের কোন ১২টি কোম্পানির গরম মশলায় আছে বিষাক্ত ধাতু?
Lead Poison in Garam Masala: সবচেয়ে উচ্চ মাত্রায় সীসা মিলেছে, 'পারস'-এর মশলায়। প্রায় ৩.৫২ পার্টস পার মিলিয়ন বা পিপিএম।
খাবারে স্বাদ বাড়াতে প্রায় প্রতিদিনই দারচিনি আর গরম মশলার ব্যবহার হয় ভারতীয় রান্নাঘরে। এই মশলাগুলির স্বাস্থ্য উপকারিতাও যথেষ্ট! রক্তে শর্করার মাত্রা ও কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে অনেকেই নিয়ম করে ডায়েটে রাখেন এই মশলাগুলি। তবে এবার, ভারতের তৈরি এই প্যাকেটজাত মশলাগুলি নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য সামনে এসেছে। তথ্য বলছে, ভারতের ১২টি সংস্থার দারচিনি গুঁড়ো ও গরম মশলায় পাওয়া গিয়েছে মাত্রাতিরিক্ত সীসা। সম্প্রতি কনজিউমার রিপোর্ট এমনই তথ্য সামনে এনেছে। কোন কোন সংস্থার মশলায় মিলেছে অতিরিক্ত মাত্রায় সীসা? এর কী প্রভাব পড়তে পারে আমাদের শরীরে?
সম্প্রতি কনজিউমার রিপোর্টের তথ্য প্রকাশ হওয়ার পর থেকে চিন্তা বেড়েছে চিকিৎসকদের। বলা হয়েছে, এই মশলাগুলি খাওয়া সুরক্ষিত নয়। এই রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতের ১২টি সংস্থার দারচিনি গুঁড়ো ও গরম মশলাতেই রয়েছে লেড বা সীসার মতো ভারী ধাতু, যা স্বাস্থ্যের পক্ষে ভীষণরকম ক্ষতিকর। সবচেয়ে উচ্চ মাত্রায় সীসা মিলেছে, 'পারস'-এর মশলায়। প্রায় ৩.৫২ পার্টস পার মিলিয়ন বা পিপিএম। উল্লিখিত বাকি সংস্থাগুলি হলো — 'ইজিএন' (২.৯১পিপিএম), 'মিমি'জ প্রোডাক্ট' (২.০৩পিপিএম), 'বোল অ্যান্ড বাস্কেট' (১.৮২ পিপিএম), 'রানি ব্র্যান্ড' (১.৩৯পিপিএম), 'জারা ফুডস' (১.২৭পিপিএম), 'থ্রি রিভার্স' (১.২৬পিপিএম), 'ইউ ই ব্র্যান্ড' (১.২৫পিপিএম), 'বেইলিফেং' (১.১৫পিপিএম), 'স্পাইসি কিং' (১.০৫পিপিএম), 'বড়িয়া অ্যান্ড ডিপ' (১.০৩পিপিএম), 'দীপ' (১.০২পিপিএম)। 'ফুড সেফটি রিসার্চ অ্যান্ড টেস্টিং'- এর ডিরেক্টর জেমস রজার্স জানিয়েছেন, এই সকল সংস্থার মশলাগুলিতে যে পরিমাণ সীসা পাওয়া গিয়েছে, তা একজন ব্যক্তির শরীরে ২৪ ঘণ্টায় যতটা সীসা যাওয়া উচিত তার থেকে অনেক বেশি।
আরও পড়ুন- সোনার থেকেও দামী! বিরিয়ানির গোপন মশলার জন্য যেভাবে রক্ত ঝরিয়েছিল দুই দেশ
রিপোর্টে বলা হয়েছে, এইসব মশলাগুলি যে কোনও বয়সি মানুষের শরীরেই খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে। প্রাপ্তবয়স্কদের শরীরে সীসা জমে গেলে স্নায়ুতন্ত্রের সমস্যা দেখা যায়। এক্ষেত্রে নার্ভও বিকল হয়ে যেতে পারে। শরীরের রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতাও কমে যায়। দ্য ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের মতে, সারাদিনে একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির শরীরে ১২.৫ মাইক্রোগ্রামের বেশি সীসা প্রবেশ করা স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। প্রতিদিন একটি শিশুর শরীরে ০.৫ মাইক্রোগ্রামের বেশি সীসা প্রবেশ করা অস্বাস্থ্যকর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে শরীরে নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি সীসা প্রবেশ করলে রক্তচাপ বেড়ে যাওয়ার সম্ভবনা থাকে। এছাড়াও হার্ট, স্নায়ুতন্ত্র ও কিডনির অসুখ হওয়ার ঝুঁকি থাকে। অন্তঃসত্ত্বা মহিলার শরীরে অতিরিক্ত মাত্রায় সীসা গেলে গর্ভপাতের আশঙ্কা থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, দীর্ঘদিন ধরে অতিরিক্ত মাত্রায় এই ধাতু শরীরে প্রবেশ করলে মস্তিষ্কের বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
দারচিনি গুঁড়োয় অ্যালঝাইমার্স রোগের ঝুঁকি কমানোর মতো গুণ রয়েছে। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটারি গুণে ভরপুর এই মশলাটি। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এই মশলা স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণ করতেও সাহায্য করে। ঋতুস্রাবকালীন যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে অনেকেই এই মশলা খান। ত্বকের জৌলুস বাড়াতেও দারচিনি গুঁড়োর উপর নির্ভর করেন অনেকে। এতে থাকা ফাইবার হজমশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে বহু মানুষই ডায়েটের অংশ করে তোলেন দারচিনিকে। পাশাপাশি গ্যাস-অম্বলের সমস্যা থেকেও মুক্তি দেয় এই মশলা।
প্রসঙ্গত, এ বছর এপ্রিলে ভারতের জনপ্রিয় মশলা ব্র্যান্ড 'এমডিএইচ'-এর তিনটি এবং এভারেস্টের চারটি পণ্যে এথলিন অক্সাইড নামক কীটনাশকের উপস্থিতি পাওয়া গিয়েছিল। এর ফলে, ক্যান্সারের জন্ম দিতে সক্ষম এমন উপাদান (কার্সিনোজেনিক) আছে বলে সিঙ্গাপুর ও হংকং-এর খাদ্য নিয়ামক সংস্থা অভিযোগ তোলে। হংকং সরকারের একটি বিভাগ সেন্টার ফর ফুড সেফটি (সিএফএস) ভারতীয় মশলাগুলি পরীক্ষা করছিল। তার ভিত্তিতেই ৫ এপ্রিল সিএফএস-এর তরফে বলা হয়, ভারতের ব্র্যান্ড এমডিএইচ-এর মাদ্রাজ কারি পাউডার, সাম্বর মশলা পাউডার এবং কারি পাউডারে এথলিন অক্সাইড রয়েছে। এই কীটনাশক এভারেস্টের ফিশ কারি মশলাতেও পাওয়া গিয়েছিল। এরপরই সিএফএস এই মশলাগুলির বিক্রি বন্ধ করার নির্দেশ দেয়।
আরও পড়ুন- ভারতীয় মশলা মানেই বিষ? কেন একের পর এক দেশে জারি নিষেধাজ্ঞা?
এমডিএইচ এবং এভারেস্টের মশলাগুলি যেমন ভারতে ব্যাপক জনপ্রিয়, তেমনই ইউরোপ, এশিয়া এবং উত্তর আমেরিকাতেও নাম করেছিল। কিন্তু গবেষণার তথ্য সামনে আসার পর সিঙ্গাপুর, হংকং এবং নেপালের মতো দেশ ভারতের এই মশলাগুলি নিষিদ্ধ করেছিল। এথলিন অক্সাইড এমন একটি কীটনাশক যা কৃষি বা পণ্য জীবাণু সংক্রমণ রুখতে ব্যবহৃত হয়। এসএফএ জানিয়েছিল, খাবারে এর ব্যবহার অনুমোদিত নয়। মশলাগুলিতে অন্য দেশের নিষেধাজ্ঞার পরই নড়েচড়ে বসেছিল কেন্দ্র। তড়িঘড়ি মশলাগুলির গুণগত মান পরীক্ষার নির্দেশ দেওয়া হয়। তখন এমডিএইচ এবং এভারেস্ট ছাড়াও অন্যান্য কোম্পানির মশলাগুলির গুণগতমান পরীক্ষা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তবে এই দুই সংস্থা অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছে। সংস্থাগুলির তরফে বলা হয়েছিল, এই অভিযোগ মিথ্যে এবং এর পক্ষে কোনও সুনির্দিষ্ট প্রমাণ নেই। এভারেস্ট জানিয়েছিল, মশলাগুলি নিরাপদ এবং ভারতের মশলা বোর্ডের ল্যাব থেকে প্রয়োজনীয় ছাড়পত্র আর অনুমোদন পাওয়ার পরই সেগুলি রপ্তানি করা হয়।
গবেষণা যা বলছে তাতে এই মশলাগুলি অতিরিক্ত খেলে সমস্যা হতে পারে। সেক্ষেত্রে সতর্ক হওয়া জরুরি। তবে এসবের পরেও একটি প্রশ্ন থাকছেই! বারবার ভারতে তৈরি মশলাগুলির উপরই এমন অভিযোগ উঠছে কেন? তাহলে কি সঠিক নজরদারি ছাড়াই ছাড়পত্র পেয়ে যান ভারতের মশলাপ্রস্তুতকারকরা?