মৎস্যপ্রেমে বাঙালিকেও হার মানাবে মেছো ফরাসিরা

French Fish Recipe: রান্না নামানোর আগে যেমন আমরা ভাজা মশলা গুঁড়ো ছড়িয়ে দিই, ফরাসিরা একটু অঁচোভি বা সারডিন ভাজা ছড়িয়ে দেয়।

বাঙালি হয়ে জন্মে মাছে অরুচি, এই কারণে সারাজীবন প্রচুর হেনস্থা হয়েছি। মাছ খাই না শুনেও পাতে লাউ-চিংড়ি পড়েছে, এই বলে যে ওতে আর মাছ কোথায়, স্বাদ বাড়ানোর ছুতো মাত্র! লাউটাই আসল! মাছ খাই না শুনে অবাক হয়ে দার্শনিকসুলভ 'পজ' নিয়ে অনেকেই জিজ্ঞেস করেছে, "ইলিশটা খাও তো?" অতএব মাছে-ভাতে বাঙালি সমাজে আমি ব্রাত্য! তবে, সুদূর ফ্রান্সে এসেও যে একই পরিস্থিতি হবে, তা জানা ছিল না। ক্রিসমাসের ছুটি কাটাতে গেছি বন্ধুর বাড়িতে। স্যালাদের পাশে সেদ্ধ করা কুচো চিংড়ির বাটি। বন্ধু বলছে, "একটু চিংড়ি ছড়িয়ে নাও, নয়তো শুধু ঘাসপাতাই খেতে হবে।" আমার শুধু ঘাসপাতাই ভালো শুনে ও বলল, "চিংড়িটা খাবে না? একদম ফ্রেশ মাছ, কোনও গন্ধ নেই, খেয়ে দেখতে পারো।" হুবহু এক কথোপকথন প্রতিদিন খাওয়ার টেবিলে হতো আমার শ্বশুরমশাইয়ের সঙ্গে। শ্বশুরমশাই রোজ ভোরবেলা পাতিপুকুর মাছবাজারে অন্তত দু’বার যেতেন। এক এক সময়ে এক এক মাছ ভালো ওঠে, সেই হিসাবে ঘণ্টা বেঁধে বাজার থেকে বাছাই মাছ আসত বাড়িতে। দুপুরে খেতে বসে রোজ আমাকে বলতেন, "তুমি তো মাছ খাও না, সে কথা জানি। তবে আজকে যেগুলো এনেছি সব ফ্রেশ। একটু খেয়ে দেখতে পারো। কোনও গন্ধ পাবে না!"

ভূমধ্যসাগরের বুকে লুকিয়ে থাকা রত্নের মতোই, ফ্রান্সের উপকূলীয় অঞ্চলগুলো— বিশেষ করে ফ্রেঞ্চ রিভিয়েরা, মার্সেই, নরম্যান্ডি আর ব্রিটানি— সামুদ্রিক মাছ এবং অন্যান্য সিফুড ঐতিহ্যের জন্য বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। বিলাসবহুল ইয়ট থেকে শুরু করে সাধারণ কাঠের নৌকা, সকলের গন্তব্য এক— সাগরের তল থেকে তাজা রত্ন তুলে ফরাসি রান্নার জাদুতে নবরূপ দেওয়া। ফ্রান্সে মাছ রান্না শুধু খাবারের জন্য নয়, সংস্কৃতি, ইতিহাস আর আতিথেয়তার নিখুঁত প্রকাশ। কী, মিল পাওয়া যাচ্ছে না?

আরও পড়ুন- বাজার করা একটা আর্ট! কাঁচা সবজির বাজারে যেভাবে মিলে যায় বঙ্গ-ফরাসি মন

ফরাসি বাড়ি বা রেস্তোরাঁয় মাছ পরিবেশন করার পর দেখা যায়, পাতে শুধুই মাছ, কেবল মাছ, গোটা একটা মাছ! ছুরি-কাঁটার নিপুণ কায়দায় মাছ ছাড়িয়ে খেতে শেখা সাগরের উপহারকে সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করার অপর নাম, ঠিকমতো করতে পারলে একজন রসিক রসনাবিদ হিসেবে ফরাসি আপনাকে মনে রাখবে। কথিত আছে, এখানে শিশুদের শেখানো হয়, সমুদ্র এবং উপকূল অঞ্চলের পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে ঢুকে পড়লে মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ। তখন কেবল মাছ, ঝিনুক, অক্টোপাস ইত্যাদি দিয়ে দিনযাপন। বাঙালি যেমন প্রতিদিনের ধরা মাছ পরিষ্কার করে কুটে কেটে ছাড়িয়ে রান্না করে, ফরাসিদের সেসবের বালাই নেই। কোত ব্লু উপকূলে হাইকিং শেষে ছোট রেস্তোরাঁয় খেতে ঢুকেছি, মেনুতে লেখা, যেদিন যে মাছ ধরা হবে সেটাই পরিবেশন করা হবে। হলো-ও তাই। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকা গোটা একটা মাছ এল প্লেটে (আমার প্লেটে নয়)। মার্কিনি লেখিকা লুইস ডেনেগ্রে প্যারিসের একটি রেস্তোরাঁয় ডিনার করতে গিয়ে এমনই এক অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন। লুইস বলছেন,

ওয়েটার গর্বভরে আমার সামনে এক বড়সড় হাস্যোজ্জ্বল মাছের প্লেট রেখে গেল। আমি একটু ঘাবড়ে গেলাম। আমি 'দোরাদ' (daurade) অর্ডার করেছিলাম, কিন্তু ফরাসি রীতি অনুযায়ী পুরো মাছটা পরিবেশন করা হবে – সেটা ভুলেই গিয়েছিলাম! সেই প্রথম আমি “glassy-eyed” শব্দটার অর্থ বুঝলাম। মাছটা এমনভাবে তাকিয়ে ছিল যেন চোখ নামানোই যাচ্ছে না।

মাছের অমন ড্যাবড্যাবে মেঘাচ্ছন্ন চোখ দেখে আমার মৎস্যপ্রেমী বাঙালি সঙ্গীর চোখ ঝলমল করে উঠেছে। সঙ্গে আঞ্চলিক ভিনইয়ার্ডে বানানো এক বোতল ঠান্ডা হোয়াইট ওয়াইন। তার বাঙালি হৃদয়ে তখন ফরাসি সুখ! আমি এসব অন্য টেবিল থেকে দেখি।
দক্ষিণ ফ্রান্সে মার্সেই শহরে আমি থাকি। এখান থেকেই ফ্রেঞ্চ রিভিয়েরা শুরু হলো বলা যায়। ফ্রেঞ্চ রিভিয়েরা— চকচকে সূর্য, নীল সমুদ্র আর পরিপাটি রেস্তোরাঁর দেশ। এখানে এলটু ঘোরাফেরা করলে সহজেই পাওয়া যাবে মাছ ও সিফুডের বাজার। এই লেখাটি লিখতে বসেছি মার্সেই পুরনো বন্দরের ধারে। এক এক করে জেলেডিঙ্গি ঢুকছে বন্দরে, জালে যা ধরা পড়েছে, পাড় লাগোয়া দোকানগুলোর সামনে উপুড় করে তারা আবার পাড়ি দিচ্ছে সমুদ্রে। খদ্দেরের দল হামলে পড়ে মাছের পেট টিপে, কানকো উল্টে দরাদরি করছে। সেখানেই আলোচনা সেরে নিচ্ছে কোন মাছ দিয়ে কী রেসিপি বানানো হবে। কেবল রবিবার সকালের নয়, এ দৃশ্য মার্সেই বন্দরের অস্থায়ী মাছবাজারে নিত্যদিনের। এই সদ্য ধরা সিফুড আকর্ষণ করে বিশ্বের সেরা শেফদের। চমৎকার এই উপকূলজুড়ে কেন এতগুলো মিশেলিন তারকাপ্রাপ্ত রেস্তোরাঁ রয়েছে, তা স্পষ্ট হয় মাছবাজারগুলো দেখলে। এসব দৃশ্য আমি অনেক দূরে দাঁড়িয়ে দেখি!

ফ্রান্সের উত্তর দক্ষিণ জুড়ে রয়েছে উপকূল অঞ্চল। এখানে মাছের উপদ্রব থাকবে এটাই স্বাভাবিক। অঞ্চলভেদে রেসিপির বৈশিষ্ট্য ভিন্ন, তাদের সঙ্গে জুড়ে আছে মজাদার সব লোককথা। যেমন ওপাল উপকূলের ম্যাসেলস ও হারিং। এক তাজা ভাজা বার্ষিক ভোজ। প্রতি বছর ফ্রান্সের লিল শহরে অনুষ্ঠিত ‘ব্রাদরি দ্য লিল’ উৎসবে সেপ্টেম্বরের শুরুতেই মাত্র এক সপ্তাহান্তে টন কে টন ম্যাসেলস বা ঝিনুক ও আলুভাজা খাওয়া হয়। এই সময় থেকেই শুরু হয় সামুদ্রিক খাবারের মরশুম, যদিও এই মরশুম প্রায় গোটা বছর বিস্তৃত! মাসের নামের মধ্যে ‘R’ থাকলেই বুঝতে হবে সিফুড খাওয়ার সবচেয়ে ভালো সময়! নরম্যান্ডিতে যেমন বিখ্যাত ঝিনুক, ‘বুশো ম্যাসেলস’ যার নামকরণ হয়েছে বুশো নামক কাঠের খুঁটির নামে যেখানে এই ঝিনুকগুলি আটকে থাকে। ঝিনুক চাষের পার্কগুলো বেলজিয়ান সীমান্ত থেকে শুরু করে মন সাঁ মিশেল পর্যন্ত বিস্তৃত। ‘বুশো ম্যাসেলস’ ফ্রান্সের প্রথম সামুদ্রিক খাদ্য যা ২০১৩ সালে পেয়েছিল ‘স্পেশালিতে ত্রাদিসিওনেল গারঁতি’ (STG) সনদ। এদের চেনার উপায়? চকচকে কালো খোলস, ক্রিম থেকে কমলা-হলুদ বর্ণের নরম মাংস, আর ম্যারিনারা, ক্রিম, রসুন দিয়ে সাধারণ অথচ নিখুঁত রান্না!

আরও পড়ুন- ভুল করে মিষ্টি পুড়িয়ে ফেলেই জন্ম বিখ্যাত ডেজার্টের! শেষপাতে মিষ্টিমুখের শিকড় ফ্রান্সেই?

ঝিনুকের প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য অয়েস্টার। ফরাসি রেস্তোরাঁগুলোতে ঝিনুকের আকার, গঠন ও উৎপত্তিস্থানের ভিত্তিতে নানা ধরনের ঝিনুক পরিবেশন করা হয়। এমনকী, পরিবারের মধ্যেও চলে অয়েস্টার নিয়ে প্রতিযোগিতা। ক্রিসমাসের সকালে অয়েস্টার এবং শ্যাম্পেন দিয়ে উৎসব শুরু হয়। প্রতিযোগিতার প্রথম বিষয়, কার বাজারে কত বড় অয়েস্টার উঠেছে! দ্বিতীয় প্রতিযোগিতা, কে কত নিপুণভাবে অয়েস্টারের খোলস খুলতে পারে। অয়েস্টার খোলার বিশেষ ছুরি হয়, এক একজন পকেট থেকে নিজস্ব ছুরি বের করে খেলা শুরু করে। কার স্ট্র্যাটেজি কত উন্নত সেই নিয়ে তর্ক চলে। শেষ প্রতিযোগিতা, কে কতটা অয়েস্টার খেতে পারে! দু-তিন ফোঁটা শ্যালট ভেজানো ভিনেগার দিয়ে সুড়ুৎ সুড়ুৎ করে অয়েস্টার খাওয়া চলে মাঝদুপুর পর্যন্ত! এমন আজব ব্যাপার প্রত্যক্ষ না দেখলে বিশ্বাস হয় না!

আরেকটি বিখ্যাত সামুদ্রিক খাবার হচ্ছে নীল-সবুজ রঙের রুপোলি পেটের হারিং — একে বলা হয় 'রাজা মাছ'। যুগ যুগ ধরে বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িয়ে এই মাছ রান্নার পদ্ধতির শেষ নেই। ডানকার্ক কার্নিভ্যালে প্রতিবছর টাউন হলের ব্যালকনি থেকে ডজন ডজন হারিং ছুড়ে ফেলা হয় হরির লুটের মতো — উৎসবের ঐতিহ্য।

অক্টোবরের ১ থেকে মে মাসের ১৫ তারিখ পর্যন্ত নরম্যান্ডিতে তটবর্তী রাজকন্যা স্ক্যালপস। বন্ধ অবস্থায় যেন পাখার মতো দেখতে, ভিতরে মিষ্টি ও সুস্বাদু মাংসল অংশ — আঞ্চলিক নাম ‘কোকিয়্য সাঁ জাক’। এগুলি ধরার নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করা আছে, কড়া নিয়ম পালন করে এগুলি ধরা হয় — ন্যূনতম আকার নির্দিষ্ট, তার ছোট বা বড়গুলিকে ধরা যাবে না। লেবেল রুজ-প্রাপ্ত নরম্যান্ডির স্ক্যালপ সামান্য লেবুর রসে হালকাভাবে রান্না করে খাওয়া হয়। কোকিয়্য সাঁ জাক তীরে উঠলে এক একটি বন্দর জুড়ে শুরু হয় রঙিন উৎসব!
ফ্রান্সে সবচেয়ে মূল্যবান সিফুডগুলোর একটি হলো লবস্টার বা হোমার। যদিও এই সুস্বাদু খাবার পরিবেশনের অনেক উপায় রয়েছে, সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী পদ সম্ভবত লবস্টার থারমিডোর। এতে লবস্টারকে ওয়াইন বা ব্র্যান্ডিতে হালকা ভেজে, ক্রিমি সসের সঙ্গে মিশিয়ে আবার তার খোলের ভেতরেই পরিবেশন করা হয়। এই ক্লাসিক ফরাসি খাবারটি ঠিক যতটা রাজকীয় শোনায়, স্বাদেও ততটাই বিলাসবহুল! গলদা চিংড়ির মালাইকারি দিয়ে হুশহাশ ভাত খাওয়া বাঙালির মতোই লবস্টার থারমিডোর ফরাসি রসনার তৃপ্তি।

বলাই বাহুল্য যে, এসব থেকে দূরে থাকা রপ্ত করে বন্ধুবান্ধবদের মাছপ্রীতি সহ্য করে এবং তারা আমার মাছে অনীহা সহ্য করে রিভিয়েরাতে বছর তিনেক কাটানো রীতিমতো বিপজ্জনক! কারণ মাঝেমধ্যে মেছো আক্রমণ গেরিলা পদ্ধতিতে লুকিয়ে আসে। নিরামিষাশী শুনলেই, বাঙালির মতো, ফরাসিরাও করুণাপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। একবার একজন বলেই ফেলেছিল, আহারে, তোমার কী দুঃখ! অফিসের লাঞ্চে বা বন্ধুদের বাড়িতে আমি (এবং আমার অন্যান্য নিরামিষাশী বন্ধুরা) কী খাব সেই নিয়ে নানা জল্পনা চলে। তারপর দেখা যায়, আমাদের জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে সালাদ নিসোয়াজ। নিস শহর থেকে উঠে আসা টমেটো, সেদ্ধ ডিম, আলু, জলপাই, আর্টিচোক আর অলিভ অয়েলের সহজ সরল একটি সালাদে লুকিয়ে থাকে অঁচোভি মাছ! এক এক সময় এতে যোগ হয় টুনা মাছ! নিরামিষাশী মানুষদের জন্য এই সালাদ পরিবেশনের পেছনে কোনও দুষ্টুমি নেই, আছে নিখাদ ভালোবাসা এবং অকপট যুক্তি — নিরামিষ খায় মানেই মাছও খাবে! এদের মতে অঁচোভি এমন এক রুপোলি রত্ন যে কোনও খাবারের উপর ম্যাজিক ডাস্টের মতো একটু ছড়িয়ে দিলেই সাধারণ খাবার অসাধারণ হয়ে উঠবে। এই রুপোলি মাছটি দেখতে সারডিনের মতো, তার লালচে মাংসও স্বাদে নাকি অসাধারণ! লবণাক্ত অঁচোভি, ব্রাইন-এ রাখা ফিলেট, আর তেলে রাখা ফিলেট — ছিমছামভাবে সংরক্ষণ করা অঁচোভিকে এখানে দেখা হয় গার্নিশিং উপকরণ হিসেবে। রান্না নামানোর আগে যেমন আমরা ভাজা মশলা গুঁড়ো ছড়িয়ে দিই, এরা একটু অঁচোভি বা সারডিন ভাজা ছড়িয়ে দেয়। দিগ্বিদিকজ্ঞান শূন্য করে দেওয়া এই চরম মেছো পদার্থটির হাতে আমি বহুবার নিঃশব্দে কাবু হয়েছি। প্রোভঁস-এর এক গ্রামে বেড়াতে গিয়ে কোনও নিরামিষ খাবারের হদিস না পেয়ে রবিবারের হাটে গেলাম। অপূর্ব একটা রুটির দোকানে কেনা হলো ফোকাচ্চা। জলপাই আর টমেটো মেশানো নিরীহ রুটিতে এক কামড় দিয়ে আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত! শুনলাম এ অঞ্চলে ফোকাচ্চার স্বাদ বাড়ানোর জন্য গরম রুটির উপর মাখন মাখানোর মতো একটু অঁচোভির আচার মাখিয়ে পরিবেশন করা হয়। সেই যাত্রায় ফল আর কাঁচা লেটুস খেয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম!

আরও পড়ুন- ‘ওগো আমার শুয়োর’! ফরাসিদের বিচিত্র ডাকনামের আজব কিসসা

মেছোপনার যদি কোনও ইনডেক্স থাকে তাহলে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে সোনার মেডেল জিতে নেবে প্রোভঁস-এর বুইইয়াবেস (Bouillabaisse)। সেই গল্প দিয়ে আজকের লেখা শেষ করব। যে পাড়ায় বসে এখন এই লেখা লিখছি, তার চারদিকে রেস্তোরাঁর বাইরে বড় বড় অক্ষরে লেখা রয়েছে "এখানে বুইইয়াবেস পাওয়া যায়"। মার্সেই ও প্রোভঁস অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী মাছের ঝোল বা স্ট্যু ‘বুইইয়াবেস’। ঐতিহ্যবাহী ফরাসি এই খাবারটির জন্ম মার্সেইয়ের জেলেদের হাত ধরে, যারা বাজারে বিক্রি করতে না পারা কাঁটাযুক্ত রকফিশ দিয়ে এটি তৈরি করতেন। আমাদের রান্নাঘরে যেমন মাছের কাঁটা, তেল না ফেলে চচ্চড়ি হয়, ঠিক সেরকম। রেসিপিতে চাই অন্তত ১ থেকে ৩ কেজি বিভিন্ন ধরনের ‘মেডিটারেনিয়ান রক ফিশ’ যেমন স্করপিয়ন মাছ, গিরেল, গ্যালিনেত, সাঁ-পিয়ের, রেড মুলেট, সার, মোরে, মঙ্কফিশ বা কঙ্গার মাথা, কখনও ঝিনুক, লবস্টারও দেওয়া হয়। জাফরান, মৌরি ও পাস্তিস (লিকোরিস স্বাদের এক ধরনের অ্যাপেরিটিফ) দিয়ে অনেক ঘণ্টা ধরে ফুটিয়ে তৈরি হয় এই স্ট্যু। পরিবারে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে আসা রেসিপি, ঝোল ফুটে উঠলে আগুন কমাতে হবে, আর পরিবেশন হয় দুই থালায়: একটিতে মাছ, অন্যটিতে ঝোল। এই ব্রথের সঙ্গে পরিবেশন করা হয় রুইয়্যি (rouille) নামের মরিচ, রসুন, ব্রেড ক্রাম্ব ও অলিভ অয়েল দিয়ে বানানো এক ধরনের ঝাল মায়োনেজের সস। আগে এটি ছিল গরিব মানুষের খাবার, এখন স্বাদে অভিজাত এবং পর্যটকদের লিস্টে ‘মাস্ট-ইট’ নাম। আমি দেখি সামনে বিশাল বাটিতে বুইইয়াবেস নিয়ে হাসিখুশি পর্যটকরা আমার পাড়ায় দুপুরের আহার সারছে।

কলকাতা হোক বা মার্সেই, সব দেশের মাছের বাজার, মাছের নানা পদ, আঙুল চেটে তৃপ্তি করে খাওয়া মাছ-বিলাসী মানুষদের আমি কেবল দূর থেকে দেখি… অবাক হয়ে দার্শনিকসুলভ 'পজ' নিয়ে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা হয়, "মাছ… কেন খাও ?"

More Articles