বাষট্টিতে এসে নতুন উড়ান, যে ভাবে জীবন আমূল পাল্টে দিয়েছিল একটুকরো চকলেট

Success story: ছোট থেকে জেন একেবারেই চকলেটের ভক্ত ছিলেন না। তবে এই চকলেটগুলি খেয়ে চমকে খেয়ে উঠেছিলেন তিনি।

বাচ্চাদের অন্য়তম প্রিয় খাবার চকলেট। তবে এই জনপ্রিয়তা যে শুধুমাত্র ছোটদের মধ্যেই আটকে, তা কিন্তু নয়। বড়রাও অনেকে নিদারুণ চকলেটের ভক্ত। এই চকলেটের কিন্তু বেশ কিছু জাদুকরী গুণ রয়েছে। শরীরের সঙ্গে মনও ভালো রাখতে সাহায্য করে এই স্বাদু বস্তুটি। তবে ৬২ বছর বয়সী জেন সোয়াইনের জীবনটাকে কীভাবে পাল্টে দিয়েছে এই চকলেট, আসুন সেই গল্পই বলা যাক আজ। 

জেন আর চকোলেটের গল্পটা শুরু হয়েছিল আর পাঁচ জনের মতোই। সেটা ২০১৩ সালের কথা হবে। হেগে চাকুরিরতা মেয়েকে দেখতে গিয়ে স্বামীর জন্য উপহারস্বরূপ এক বাক্স চকলেট নিয়ে যান জেন। প্রসঙ্গত, সমারসেটে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় কাজ করেন তাঁর স্বামী। তাঁর জন্য যে চকলেট নিয়ে গিয়েছিলেন জেন, তা তিনি কিনেছিলেন স্থানীয় এক চকোলেটিয়ারের কাছ থেকে। যিনি কিনা সমুদ্রের লবণ আর ট্যারাগন মিশিয়ে ওই আশ্চর্য চকলেটগুলো বানাতেন। অবাক করার মতো কথা হল, ছোট থেকে জেন একেবারেই চকলেটের ভক্ত ছিলেন না। তবে এই চকলেটগুলি খেয়ে চমকে খেয়ে উঠেছিলেন তিনি। এতটাই ভালো লেগে যায় তাঁর, যে এমন চকলেট বানিয়ে ফেলতে নিজেই উঠেপড়ে লাগলেন।

জেনের এই আগ্রহ দেখে ভারী খুশি হয়েছিলেন তাঁর স্বামী। উৎসাহ জোগাতে কার্পণ্য করেননি তিনিও। আসলে জেন বরাবরই রাঁধতে ভালোবাসেন। কিন্তু তা-ই বলে চকলেট বানানোর ইচ্ছা তার কস্মিন কালেও হয়নি। তবে সেই কাজটাই তাঁকে করতে এবার বাধ্য করল আশ্চর্য সেই চকলেটের বাক্স। তবে কাজে হাত দিয়ে জেন বুঝলেন, উহু, চকলেট বানানো মোটেই সহজ কাজ নয়। যথেষ্ট পরিশ্রমের কাজ এটা, বিশেষত ট্যারাগনের মতো তাজা ভেষজ ব্যবহার করে চকলেট বানানো তো বেশ কঠিন।

আরও পড়ুন: গোপনে প্রস্তুত করা হয় চকলেট, ৭৭ বছর পেরিয়ে এসেও যেভাবে বাজার ধরে রাখল ‘ফেরেরো রোচার’

সারা জীবন নানা রকম কাজের মধ্যে থেকেছেন জেন। নিজের শখকে সবসময় গুরুত্ব দিয়ে এসেছেন তিনি, এমনকী সেসবকে পেশায় পরিণত করতেও দু'বার ভাবেননি জেন। এর আগে কাজ করেছেন ডান্স থেরাপিতে। শুধু কি তাই, তার আগে ইংরেজি ও নাটকের শিক্ষক হিসেবে প্রশিক্ষণ নেন তিনি। ২০০৩ সালে যুদ্ধোত্তর কসোভোতে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের জন্য একটি গ্রীষ্মকালীন স্কুলও তৈরি করেন জেন। ফলে এত সব কাজ সামলে চকলেট বানানোর কাজে মনোনিবেশ করার কাজ ক্রমেই কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছিল।

এরই মধ্যে স্কটল্যান্ডের পিবলসে থাকতে থাকতেই একটি ক্যাফেতে একটি বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে জেনের। মাস্টার চকোলেটিয়ার রুথ হিঙ্কস পরিচালিত চকলেট তৈরির কোর্সের কথা জানতে পারেন। মাথায় ফের চকলেট তৈরি করার পোকাটা নড়েচড়ে ওঠে জেনের। যেমন ভাবা তেমন কাজ। তিন দিনে কোর্সে ভর্তি হয়ে গেলেন তিনি তড়িঘড়ি। মোল্ডেড চকলেট তৈরির কোর্স। তবে সেখান থেকে পাওয়া শিক্ষাটুকু যথেষ্ট নয়, অচিরেই বুঝতে পারেন জেন। হ্যাঁ, একটা বুনিয়াদি ধারণা তো সেই কোর্স করে পেয়েইছিলেন জেন। তবে তিনি যে চকলেটটি বানাতে চাইছিলেন, তা যে সে চকলেট নয়। সেটি বানানোর মতো রসায়নের উচ্চ জ্ঞান তাঁর ছিল না। তবে হাল ছাড়লেন না।

একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় চকলেটকে গরম করা, তার পর সেটিকে ঠান্ডা করে তাকে মিষ্টত্ব দেওয়া, সবটাই রুথের হাত ধরে আস্তে আস্তে শিখে গেলেন জেন। যাই হোক, কোর্স শেষ হল এসবেই। বাড়ি ফিরলেন জেন। তখনও কিন্তু মাথায় নড়ছে চকলেট বানানোর পোকা। নিজের অব্যবহৃত শস্যাগারের একটি কোণকে সাজিয়েগুজিয়ে তৈরি করে ফেললেন চকলেট তৈরির একটি ওয়ার্কশপ। এই পর্যায়ে প্রচুর বইপত্তর পড়েছেন জেন। নিকি সেগনিটেরের ফ্লেভার থিসোরাস বইটি প্রচুর সাহায্য করেছে তাকে। শুরু হয় পরীক্ষানিরিক্ষা। চকলেটের বেস তৈরির জন্য জেন বেছে নেন সমারসেট সিডার ব্র্যান্ডি কোম্পানির অ্যালকোহলযুক্ত পানীয়। তার পর তার মধ্যে এলাচ, কফি ও চেরি মিশিয়ে বানিয়ে ফেলেছিলেন একটা অন্যরকমের চকলেটের।

সেগুলি বেশ কয়েক জনকে দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে জেন বোঝেন, মন্দ হচ্ছে না ব্যাপারটা। কিন্তু এর চেয়ে বড় স্কেলে বিষয়টাকে নিয়ে যেতে হলে, তাঁর প্রয়োজন আরও বড় জায়গা। ক্রমে গোটা শস্যাগারটিকেই সাজিয়েগুজিয়ে চকলেট তৈরির কারখানা করার সিদ্ধান্ত নিলেন জেন। ইতিমধ্যে বেশ কিছু অর্ডার আসাও শুরু হয়েছে তাঁর কাছে। এই ব্যবসার মূলধন হিসেবে প্রচুর অর্থ খরচ করতে হয়েছে জেনকে। কিন্তু মানুষ যখন তাঁর চকলেট খেয়ে খুশি হয়েছে, তখন যেন সমস্ত পরিশ্রম সার্থক মনে হয়েছে জেনের। ক্রমে চকলেট বানিয়ে লাভের মুখ দেখতে শুরু করেন জেন। এবং সেই লাভের থেকে খানিকটা করে অর্থ নিজের দাতব্য প্রতিষ্ঠানেও দান করতে থাকেন জেন। বাকিটা যেন ব্যবসার সম্প্রসারণে।

২০১৬ সাল নাগাদ তাঁর সঙ্গে একটি হোটেল কর্তৃপক্ষ যোগাযোগ করেন, যাতে সেখানকার শেফদের এই চকলেট বানানো শেখান জেন। হবে না-ই বা কেন। এতগুলো বছরে জেনের চকলেট রকমফেরে বেড়েছে বেশ খানিকা। অন্তত ২২ রকম স্বাদের ১৬০ ধরনের মোল্ডে চকলেট বানিয়ে থাকেন জেন। ক্রিসমাসের সময় দম ফেলার সময় থাকে না তাঁর। সপ্তাহে অন্তত ৫ হাজার চকলেট তৈরি হয় তাঁর। ভোর পাঁচটা থেকে রাত ৯টা অবধি সেসময়টা রান্নাঘরে কেটে যায় জেনের। না, তাঁর চকলেট কারখানায় আরও অনেক কর্মীরা রয়েছেন। তবু জেন ছাড়া চকলেটে যেন স্বাদ লাগে না তেমন।

আরও পড়ুন: ২০০ বছর আগেও ছিল ‘চকলেট ডে’-এর রেওয়াজ, ইতিহাস জানলে অবাক হবেন আপনিও

বয়স ৭৩ পেরিয়েছে। তবে কাজের থেকে অবসরের ভাবনা নেই জেনের। বরং আরও দ্বিগুণ গতিতে কাজ করে যেতে চান তিনি। আরও মানুষকে তাঁর এই মহাযজ্ঞে সামিল করতে চান, আরও বেশি করে মন দিতে চান কর্মশালা করানোয়। ছোটবেলায় যে জেন চকলেট ছুঁয়ে পর্য়ন্ত দেখেননি, সেই জেন আজ নিজেকে দেখে তাজ্জব বনে যান মাঝেমধ্যে। জীবনে হঠাৎ আসা একটুকরো চকলেট যে তাঁর বাষট্টি বছরের জীবনে এসে জীবনটাই উল্টেপাল্টে দেবে, তা কি কখনও ভেবেছিলেন তিনি। আসলে বয়স তো সংখ্যামাত্র। যে কোনও বয়সে এসে নতুন স্বপ্ন দেখতে পারে মানুষ। আর যে কোনও বয়সে দাঁড়িয়ে সেই স্বপ্নকে তাড়া করে সাফল্যের মিনার ছুঁয়ে ফেলতে পারে যে কেউ, তার জ্বলন্ত প্রমাণ বোধহয় জেন।

More Articles