দেউলিয়া হয়ে ঘুরেছেন রাস্তায়! জনপ্রিয়তম তারকা-শেফ রণবীর ব্রারের গল্প যেন আস্ত রূপকথা
Ranveer Brar: বরাবরই গল্প বলতে ভালোবাসেন তিনি। বিভিন্ন রান্নার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ঐতিহ্য, তার নেপথ্যের গল্প খুঁজে এনে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে ভালোবাসেন।
অজ্ঞাতবাসের সময় পাচকের ছদ্মবেশ নিয়েছিলেন ভীম। বিরাট-রাজ্যে রীতিমতো দক্ষতার সঙ্গে রান্নাঘরের কাজকর্ম সামলেছেন এই পাণ্ডবপুত্র। সাধারণ ভাবে রান্নাবান্নার দায়িত্ব মেয়েদের ঘাড়ে ঠেলার প্রথা থাকলেও দীর্ঘদিন ধরেই হোটেল থেকে রেস্তরাঁ, বহু জায়গাতেই পুরুষ রাঁধুনী তথা শেফদের রমরমা দেখতে পাওয়া যায়। একটা সময় ছিল, ভারতীয় টেলিভিশনের জনপ্রিয়তম শেফ মুখ ছিলেন সঞ্জীব কপুর। পরবর্তী কালে রন্ধন প্রতিযোগিতার প্রতিদ্বন্দ্বীদের রীতিমতো বকাঝকা করে নজর কেড়েছিলেন ব্রিটিশ তারকা-শেফ গর্ডন ব়্যামসে। হাত বেঁকিয়ে নুন দেওয়ায় কায়দাতেও তাক লাগিয়েছিলেন তুর্কি শেফ সল্ট বে। ভারতীয় রন্ধন শিল্পের বাজারেও এমন বহু তারকা-শেফেরা এসেছেন, জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। তবে সাম্প্রতিক কালে জনপ্রিয়তায় মাত দিয়েছেন যিনি, তিনি ভারতীয় তারকা-শেফ রণবীর ব্রার। নিজস্ব ঢঙে, স্বকীয়তার সঙ্গে তরুণ প্রজন্মের কাছে পৌঁছেছেন তিনি, ঢুকে পড়েছেন তাঁদের পছন্দের গণ্ডিতে। এখন বিজ্ঞাপন খুললেই পরিচিততম মুখ রণবীর। তবে আজকের এই জায়গায় পৌঁছনো মোটেই সহজ ছিল না তাঁর জন্য। পুড়িয়েছেন ঢের কাঠখড়।
রান্নাবান্নার প্রতি তাঁর আগ্রহ কিংবা ভালোবাসার শুরুটা হয়েছিস ছোটবেলাতেই। রান্নাঘরে ঠাকুমাকে হাতে হাতে সাহায্য করা ছিল তাঁর ছোটবেলার খেলাগুলির একটি। রণবীরের জন্ম লখনউতে। যখন বছর তেরো বয়স, তখন থেকেই স্থানীয় গুরুদ্বারগুলিতে মিষ্টি ভাত রান্না করে বেড়াতেন তিনি। এমনকী এক কাবাব-মাস্টারের সহযোগী হিসেবেও কাজ করেন। রান্নাবান্নার সঙ্গে জড়িয়ে থাকতে তখন থেকেই ভালো লাগত তাঁর। সাহস করে একদিন বাড়িতে জানিয়েও ফেললেন যে বড় হয়ে রাঁধুনি হতে চান তিনি। কিন্তু সেই ইচ্ছার কথা বাড়িতে জানাতেই আকাশ ভাঙল মাথায়। স্বাভাবিক ভাবেই কেউ-ই তেমন ভাবে সহমত পোষণ করলেন না রণবীরের সঙ্গে। এর পর বাকিদের ক্ষেত্রে যেমনটা হয়, তেমনটাই হল রণবীরের সঙ্গে। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন রকম পেশায় নিজেকে খাপ খাইয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে গেলেন তিনি। পেলেন চাকরিও। কিন্তু কোনও কাজেই ঠিক তেমন মজা পাচ্ছিলেন না।
আরও পড়ুন: মুঘল নয়, খোদ সংস্কৃতে উল্লেখ রয়েছে বিরিয়ানির! জিভে জল আনা এই পদ আসলে কতটা প্রাচীন?
লখলউয়ের রাস্তাঘাট, সেখানকার সংস্কৃতি, খাবারের সুবাসই যেন ঠিক করে দিয়েছিল রণবীরের ভাগ্যরেখা। কিন্তু তখনও শেফের কাজকে নিরাপদ বা আদর্শ চাকুরী হিসেবে গণ্য করা হয় না। ফলে পরিবারের থেকে বাধা আসাটা অস্বাভাবিক ছিল না। কিন্তু ততদিনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন তিনি। হতে হলে শেফই হবেন। মাত্র ২৫ বছর বয়সে দেশের সর্বকনিষ্ঠ এগজিকিউটিভ শেফ হয়ে আশপাশের সকলের ভুল ভাঙলেন রণবীর। কিন্তু সেটা ছিল লড়াইয়ের শুরু মাত্র।
নিজের প্রথম রেস্তরাঁ খোলার স্বপ্ন বুকে নিয়ে আমেরিকা পাড়ি দিলেন রণবীর। কিন্তু মুখ থুবড়ে পড়ল সব চেষ্টা। সেই রেস্তরাঁর স্বপ্ন দেউলিয়া করে দিয়েছিল তাঁকে। ঘরবাড়ি, সম্পদশূন্য হয়ে কার্যত রাস্তায় এসে দাঁড়াতে হল। সেটা ছিল এক ঘোরতর অন্ধকার সময়। তবে হাল ছাড়েননি রণবীর। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে ঘুরে দাঁড়াতেই হয়, এই আপ্তবাক্য মাথায় নিয়েই ময়দানে ফিরলেন রণবীর। আমেরিকা ও কানাডায় খুললেন নতুন রেস্তরাঁ।

ভালোই চলছিল সব। ২০১২ সালে বাবার ধরা পড়ল মারণ কর্কট রোগ। দেশে ফিরতেই হল রণবীরকে। আবার নতুন লড়াই। সেই সময় এক অন্য ধরনের কাজের সুযোগ এল তাঁর কাছে। কুকিং শো হোস্টিংয়ের কাজ। সেটাই বোধহয় ছিল রণবীরের শেফ-জীবনের সবচেয়ে বড় মোড়। মাস্টার শেফ ইন্ডিয়া ততদিনে বেশ জনপ্রিয়। মানুষের মুখে মুখে ফেরে এই টিভি শোটির নাম। সেই শো-তে প্রথমে সঞ্চালনা, এবং পরে বিচারকের দায়িত্ব পেলেন রণবীর। সেই থেকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি রণবীরকে।
বরাবরই গল্প বলতে ভালোবাসেন তিনি। বিভিন্ন রান্নার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ঐতিহ্য, তার নেপথ্যের গল্প খুঁজে এনে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে ভালোবাসেন। সেই ভালোবাসাই তাঁকে পৃথিবী বিখ্যাত করে তুলল, যখন করিনা কপুরের সঙ্গে 'বাকিংহাম মার্ডারস'-এ স্ক্রিন শেয়ার করার সুযোগ পেলেন রণবীর। তার পর একের পর এক শো, বিজ্ঞাপন, তার সাফল্যের সোপান এরপর তড়তড়িয়ে এগিয়েছে। ইউটিউবে নিজের শোয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন শো হোস্ট করেন তিনি। ডাক পান একাধিক রিয়েলিটি শো-তেও।
আরও পড়ুন:ঠিক কবে থেকে মানুষ রান্না করতে শিখল? এই দুর্দান্ত তথ্য চমকে দিয়েছে বিশ্বকে
লখনউয়ের গলি থেকে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল একদিন মাটির গন্ধ নিয়ে, সেই ঘ্রাণ পৌঁছে গিয়েছে আজ ভারতের প্রতিটি রন্ধনপ্রিয় দর্শকের কাছে। রণবীর ব্রার তাঁদের কাছে এর রূপকথার নাম। সহজ গল্পের ছলে যে প্রতিটি রান্না, প্রতিটি রেসিপিকে করে তোলেন আরও কাছের, আরও প্রিয়। কার্যত রণবীরের লড়াই মনে করিয়ে দেয় শাহরুখ খানের সেই জনপ্রিয়তম সংলাপ— “আগর কিসি চিজ কো দিল চাহো, তো পুরি কায়ানাত উসে তুমসে মিলানে কি কওশিশ মে লাগ যাতি হ্যায়।”
রণবীর ব্রার চেয়েছিলেন, আর তা তিনি পেয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন।

Whatsapp
