সর্ষের ভিতর ভূত না, সর্ষের মধ্যে সুখ পেয়েছে ভোজনবিলাসী বাঙালি ও ফরাসি
French Mustard: ফ্রেঞ্চ মাস্টার্ডের সঙ্গে সর্ষে বাটায় মাছ বা বাটি চচ্চড়ির মিল কম। বরং এ যেন কাসুন্দির তুতো-বোন। দু'টিই আচার।
যে কোনও রান্নায় একটু সর্ষেবাটা পড়লেই বাঙালি বাড়িতে যেন বিশেষ মেনু! ছোটবেলায় মাছ খাওয়ায় আমার অনীহা ছিল বলে মা এই 'বিশেষ আয়োজনের' স্ট্র্যাটেজি নিয়েছিল। "মাছ খাব না" বললেই বলত, "আজ কিন্তু সর্ষেবাটা হয়েছে!" এতে আমার মাছ খাওয়ার ইচ্ছা একটুও বাড়েনি, তবে ঝোলের লোভে ঠিক খেয়ে নিতাম।
ফ্রান্সে এসে দেখলাম, একইরকম ব্যাপার। যে কোনও খাবারে ছিটেফোঁটা সর্ষের হদিশ পেলেই এদেশি বন্ধুরা আহা-উহু করে ওঠে। একটা সাধারণ পাই, দক্ষিণ ফ্রান্সের প্রোভঁসের ঘরে ঘরে বানানো হয়, একটু এক্সপেরিমেন্ট করব বলে এক চামচ ফ্রেঞ্চ মাস্টার্ড বাড়তি যোগ করে বানিয়েছিলাম বন্ধুর বাড়ির পার্টির জন্য। সকলেই খেয়ে বলছে, "যেন একটু অন্যরকম, একটু স্পেশ্যাল। ঠিক রোজকার প্রোভঁসাল পাইয়ের মতো নয়।" অনেক জল্পনার পর যখন রেসিপি বলেছি, হইহই পড়ে গেছে পাইয়ে মাস্টার্ড শুনে! ফরাসি মাস্টার্ড আর বাঙালি সর্ষেবাটা যদিও এক নয়, সে কথায় পরে আসব। তবে সর্ষের ভিতর ভূত না পেলেও, সর্ষের ভিতর সুখ ঠিক খুঁজে পেয়েছে ভোজনবিলাসী বাঙালি ও ফরাসি।
ফ্রান্সে সর্ষের ইতিহাস অন্তত ১৫০০ বছরের পুরনো। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে মূলত সাদা বা হলুদ সর্ষের উৎপত্তি প্রাচীন মিশরে। সেখান থেকে গ্রিস, রোম ঘুরে ফ্রান্সে ঢোকে সর্ষে। গ্রিকরা সর্ষে ব্যবহার করত ওষুধ হিসেবে। ওদের বহু প্রাচীন চিকিৎসাশাস্ত্র 'হিপোক্রেটিক কর্পাস'-এ সর্ষের ঔষধি গুণের উল্লেখ রয়েছে। রোমানরা গ্রিকদের অনুকরণে হিস্টিরিয়া, সাপের কামড় এমনকী বিউবনিক প্লেগ থেকে আরোগ্যের উপায় হিসেবে সর্ষের ব্যবহার শুরু করে। সঙ্গে যোগ হয় রান্নায় সর্ষের ব্যবহার। অপরিপক্ব আঙুরের রস (যার নাম must), তার সঙ্গে সর্ষের গুঁড়ো (যাকে sinapis বলা হতো) মিশিয়ে তৈরি হতো mustum ardens, আক্ষরিক অর্থে 'burning must'। পঞ্চম শতাব্দীর শেষের দিকে লেখা রোমান রান্নার বই De re coquinaria-তে এই উপায়ে সর্ষের আচার বানানোর প্রণালী পাওয়া যায়। সর্ষে গুঁড়ো, গোলমরিচ, জোয়ান, ভাজা ধনে, সেলরি, থাইম, ওরেগানো, পেঁয়াজ, মধু, ভিনেগার, মাছের সস এবং তেল মিশিয়ে তৈরি এই পেস্টকে শুয়োরের উপর প্রলেপ দিয়ে রোস্ট করা হতো।
আরও পড়ুন- সালঁ, সেলুন আর খুর-কাঁচির কিসসা
জনপ্রিয় লেজঁ দ্য মুতার্দ (légende de moutarde) অনুযায়ী রোমানদের সঙ্গে সঙ্গে রান্নায় সর্ষের ব্যবহার এসে পৌঁছলো রোমান-গল, অর্থাৎ আধুনিক ফ্রান্সে। ঐতিহাসিক নথি অনুযায়ী, সাঁ-জার্মাঁ-দে-প্রে অ্যাবির সন্ন্যাসীরা (যা বর্তমানে প্যারিসে অবস্থিত) ১০ শতকের কোনও এক সময় সর্ষের দানা দিয়ে ঘন মিশ্রণ তৈরি করে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন। এইসব সন্ন্যাসীদের বলা হতো লে মুতার্দিয়ে (les moutardiers) বা সর্ষে প্রস্তুতকারক। ফ্রান্সে সর্ষের প্রথম রেসিপি লিখিতভাবে পাওয়া যায় ১৩ শতকে। একেবারে রোমানদের রীতি মেনে সর্ষের দানা পিষে তাতে আঙুরের রস (গ্রেপ মাস্ট) মিশিয়ে তৈরি হতো ফরাসি মাস্টার্ড। অভিনিওঁ তে বসবাসকারী পোপ জন XXII (১২৪৯–১৩৩৪) ভ্যাটিকানে একটি নতুন পদ তৈরি করেন – গ্রাঁ মুটার্ডিয়ার দু পাপ (পোপের মাস্টার্ড প্রস্তুতকারক)। এই পদে তিনি তাঁর বেকার, অলস ভাগ্নেকে নিযুক্ত করেন। ফরাসিতে এখনও একটি প্রবাদ চালু আছে- “Se croire le premier moutardier du pape”! এর আক্ষরিক অর্থ “যে নিজেকে পোপের প্রধান সর্ষে প্রস্তুতকারক ভাবে”। এটি ব্যঙ্গাত্মক অর্থে বোঝায় এমন একজনকে, যে নিজেকে তাঁর অবস্থানের চেয়ে বেশি উচ্চাভিলাষী বা অহংকারী ভাবে।
১৩৯০ সালে, ফরাসি সরকার মাস্টার্ড তৈরির নিয়মাবলী জারি করে। সেখানে বলা হয়েছে, “ভালো বীজ এবং মানানসই ভিনেগার” ছাড়া আর কিছু ব্যবহার করা যাবে না। ফরাসি রাজপরিবারের নিজস্ব মুতার্দিয়ে থাকত। বিশিষ্ট ফরাসি লেখক আলেকজান্ডার ডুমার মতে, লুই XI প্রায়শই তাঁর নিজের মাস্টার্ডের পাত্র সঙ্গে নিয়ে বন্ধুদের বাড়ি যেতেন। খানিক পানের ডিবে বয়ে বেড়ানোর মতো।
শোনা যায়, ফ্রান্সের বো শহরে রোমান রাজা শার্লেমায়োন সন্ন্যাসীদের দিয়ে সর্ষে চাষ এবং রাজপরিবারের জন্য সর্ষে গুঁড়ো করার কাজে নিযুক্ত করেছিলেন। এই সর্ষে গুঁড়ানোর জন্য ব্যবহৃত বিশাল বৃত্তাকার পাথরগুলো মিও শহরের খনি থেকে কাটা হতো। ফলত এই শহরগুলি কেন্দ্র করে ফ্রেঞ্চ মাস্টার্ডের ব্যাবসা বেড়ে ওঠে ঐতিহাসিক নিয়মে। যদিও, ফ্রেঞ্চ মাস্টার্ড বললে কেবল বার্গান্ডি অনভলের দিজঁ মাস্টার্ডের কথাই মনে হয়। দিজঁ মাস্টার্ড তৈরি করতে ভেরজু বা কাঁচা সবুজ আঙুরের রস ব্যবহার হয় বার্গান্ডি অঞ্চলে।
আরও পড়ুন- দুঃখবিলাসী বাঙালি, বেদনাবিলাসী ফরাসিরা যেভাবে খোঁজে হেমন্তকে
ফ্রান্সের বেশিরভাগ ওয়াইন উৎপাদনকারী অঞ্চল যেমন বর্দো বা লোয়া উপত্যকায় তৈরি হতো মাস্টার্ড। ওয়াইন থাকলেই একটু সর্ষে গুঁড়ো তাতে মিশিয়ে নিতে কতক্ষণ। ১৩ বা ১৪ শতকে বিশেষভাবে বার্গান্ডি অঞ্চল সর্ষের গুণগত মানের জন্য বিখ্যাত হয়ে ওঠে। এর পেছনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল মধ্যযুগীয় ফ্রান্সের স্বাধীন রাজ্যের শাসক বার্গান্ডির ডিউকদের। এরা রাজকীয় ভোজের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে ফ্রেঞ্চ মাস্টার্ডকে। কথিত আছে, ১৩৩৬ সালে বার্গান্ডির ডিউক আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে অতিথিরা ৩০০ লিটার ফ্রেঞ্চ অফ মাস্টার্ড ক্রিম খেয়েছিল। অর্থাৎ, কেবল রান্নার প্রণালী বা খাবারের পাতে আচার নয়, ফ্রেঞ্চ মাস্টার্ড হয়ে ওঠে ফরাসি প্রভাব প্রতিপত্তি ও বিত্তের প্রতীক। ১৯ শতকে বার্গান্ডি ফ্রান্সে সর্ষে উৎপাদনে শীর্ষস্থান দখল করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত, বার্গান্ডির বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল জুড়ে সর্ষে চাষ হতো। কাঠকয়লা পোড়ানোর জন্য নির্দিষ্ট জমিতে সর্ষের উৎপাদন বেশি বলে কাঠকয়লা গোলার মালিকরা বাড়তি উপার্জনের জন্য সর্ষে চাষ করত ফাঁকা জমিতে। ২০ শতকের মাঝামাঝি কাঠকয়লার চাহিদা কমে যাওয়ায় বার্গান্ডিতে সর্ষে উৎপাদন হ্রাস পায়। ফ্রেঞ্চ মাস্টার্ড বলে আজ যা খাই তার বেশিরভাগ সর্ষে আসে কানাডা থেকে! একথা অনেক ফরাসিরও অজানা।
বাঙালির রান্নাঘরে সর্ষের নেপথ্যে এত ঐতিহাসিক তথ্য আমি অন্তত খুঁজে পাইনি। আমরা এমনিতেই ডকুমেন্টেশনে কাঁচা, এ আমাদের সঙ্গে পশ্চিমের দার্শনিক ফারাক। তর্কে গিয়ে লাভ নেই। তবে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা বলছে, খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০–১৭০০ সালে সিন্ধু সভ্যতায় সর্ষের চাষ হতো! সিন্ধু উপত্যকায় প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ এই দাবি সমর্থনও করছে। খাদ্য ইতিহাসবিদরা বলছেন, আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ সালে সর্ষে চাষ শুরু করেছিল অধুনা ভারতবাসী। আয়ুর্বেদে সর্ষের ব্যবহার বহুমুখী। এত দিক থেকে এতরকম সার্কামস্ট্যান্সিয়াল সাক্ষী পেয়ে বিদ্বজ্জনেরা খানিক ঠাট্টা করে, আসলে গভীর বিশ্বাস রেখে বলে থাকেন, নিঃসন্দেহে, বিশ্বকে দেওয়া ভারতের অনন্য এক উপহার সরিষা! অনেক ঐতিহাসিক তথ্য এখন বলছে, ভারত এবং রোম বা গ্রিসের মধ্যে বাণিজ্য বহু, বহু পুরনো। হয়তো সময় বলবে, সেই পথেই দিজঁ-র পৃথিবী বিখ্যাত ফ্রেঞ্চ মাস্টার্ডের উৎস প্রাচীন ভারত কিনা।
ফ্রেঞ্চ মাস্টার্ডের সঙ্গে সর্ষে বাটায় মাছ বা বাটি চচ্চড়ির মিল কম। বরং এ যেন কাসুন্দির তুতো-বোন। দু'টিই আচার। দু'টিরই প্রস্তুতিতে আচারবিধি অপরিসীম।
বাঙালির আচার তৈরির নির্দিষ্ট ধারাবাহিকতা মেনে কুল, তেঁতুল, আমের পর সবশেষে বর্ষার আগে কাসুন্দি তৈরি হয়। দীর্ঘ শ্রমসাধ্য রীতিনীতি মেনে কাসুন্দি তৈরি শুরু হয় অক্ষয় তৃতীয়ার দিন। সর্ষে কাটা এবং শুকনোর মরশুম শেষে কাসুন্দি ফারমেন্টেশনের জন্য আদর্শ আবহাওয়া— এমন নাতিশীতোষ্ণ পরিবেশে কাসুন্দি তৈরিতে প্রায় হপ্তাখানেক সময় লাগে। প্রথমে কালো ও হলুদ সর্ষের বীজ ভালোভাবে ধুয়ে শুকনো হয়। বিবাহিত মহিলারা স্নান করে, পূর্বদিকে মুখ করে, ভেজা শাড়ি পরে সর্ষে ধুয়ে সচ্ছলতা, স্বাস্থ্য এবং কল্যাণের প্রার্থনা করেন। ধোওয়া সর্ষে ছেঁকে নেওয়ার জন্য পুরুষের ধুতি ব্যবহার করা হতো, মহিলার শাড়ি নয়। মহিলাদের যাবতীয় প্রয়োজন কেবল শ্রমে! রোদে শুকনোর পর চালুনি দিয়ে ছেঁকে (উলুধ্বনি ও প্রদীপ জ্বালিয়ে দেবতার উদ্দেশ্যে অনেক বস্তু পদার্থ নিবেদন ইত্যাদি করার পর) 'পরিমিত' মশলা যোগ করে মিহি কাসুন্দি তৈরি হয়। তারপর মসলিন কাপড় দিয়ে বয়ামের মুখ ঢেকে রাখা হয় ফারমেন্ট করার জন্য।
আরও পড়ুন- বাংলার কালীর সঙ্গে যেভাবে মিশে গেল ফ্রান্সের সারা-লা-কালী
দিজঁ-র মাস্টার্ডের যেমন রেসিপির হেরফের হবে না, বাঙালির কাসুন্দির ক্ষেত্রে বরং উলটো নিয়ম। কিছু পরিবার ১০টি মশলা ব্যবহার করে, অন্যরা ১৫টিরও বেশি। এই ১০ বা ১৫ মশলার তালিকা জানা নেই। সবাই কিছু না কিছু উপকরণ গোপনই রাখেন। কাসুন্দির সঠিক স্বাদ আসবে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া টিপ্পনী আর নৈপুণ্যের মাধ্যমে। দিজঁ বা গ্রেকো-রোমান মাস্টার্ডের লিখিত ডকুমেন্টেশনের সীমাবদ্ধতায় নয়। কাসুন্দির ক্ষেত্রে জরুরি অভিজ্ঞতা; মশলার মাত্রা সঠিক না হলে পুরোটা নষ্ট, যদিও কেউ কোনওদিন মশলার সঠিক মাত্রা 'পরিমাণমতো'-র বেশি লিখবে না।
সাংস্কৃতিক রীতিবিধিতে কাসুন্দি আর ফ্রেঞ্চ মুতার্দ-এর মিল নাই বা থাকল। একটি ঘোরতর ইম্পিরিয়াল ঐতিহ্য, অন্যটি শ্রেণিগত। ব্রাহ্মণ পরিবার ছাড়া আগে কাসুন্দি বানানোর নিয়ম ছিল না। অর্থাৎ দু'দিকেই আসলে বড়লোকের খেলা। সর্ষে দামি শস্য। বিত্তশালী ছাড়া কেউ খেতে পারে না। অতএব যে দেশে বা যে সময়েই হোক না কেন, সর্ষের ভিতর বসে আছে শ্রেণির ভূত; ফরাসি বিপ্লব এবং শিল্প বিপ্লবের পর পশ্চিমে যা সর্বসাধারাণের আয়ত্তে এসেছে। বাংলায় বাণিজ্যিক উৎপাদনের তাগিদে কাসুন্দি তৈরিতে কিছুটা হলেও গণতন্ত্রীকরণ ঘটেছে।
এসব তত্ত্বকথায় গিয়ে লাভ নেই। স্বাদের নিরিখে এগিয়ে কে? বাঙালি কাসুন্দি না ফ্রেঞ্চ মাস্টার্ড? এ বিষয়ে ইতিহাস ও সংস্কৃতিবিদ থেরেসা ভার্গিজ লিখেছেন, "আমি সর্ষের স্বাদ আগে নানাভাবে পেয়েছি— বার্গারের মধ্যে মিষ্টি আমেরিকান মাস্টার্ড, স্যান্ডউইচে ব্যবহৃত ইংলিশ মিষ্টি মাস্টার্ড, ফরাসি অ্যাপেটাইজার ওর দ্যুভ্র-এ ঝাঁঝাঁলো মাস্টার্ড। কিন্তু এখন আমি বলি; আপনি চাইলে দিজঁ-র প্রশংসা করুন, তবে বাঙালির কাসুন্দির চেয়ে বার্গান্ডির মাস্টার্ড অনেক পিছিয়ে।" (কলকাতার রাস্তার দোকানের ফিশফ্রাইয়ের সঙ্গে ছোট প্যাকেটে দেওয়া কাসুন্দি খাওয়ার পর লেখক এই উপলব্ধির কথা লেখেন গোয়া জার্নালে)