না-গঙ্গার দেশে ভাতের পাতে মেঘের ছায়া

চষা মাটির ভেতর ঠেলে বেড়িয়ে আসছে পিরথিবির বুকের ওম। পিপাসা লাগছে অর। লাগবই তো। বৃষ্টি নাবল কি দু'-চার ফোঁটা?

মাঠে মাঠে এখন চাষ দিতে লেগেছে মানুষ। এই দেখ, দশহরার দিনে সকাল থেকে কেমন মেঘ নেবেছে মাঠের ওপারে। চষা মাটির ভেতর ঠেলে কেমন ভাপ বেরিয়ে আসছে দ্যাখো! পিরথিবির ভেতরটো তেতেপুড়ে আছে গো। তারও তো খানিক খানিক পিপাসা লাগে, লয়?

তা জল হলে তবে তো! এ তো আর তোমার জলের দেশ লয়, এখেনে মানুষ জলের কাঙাল। নদীর বুকে দ্যাখো না কেমন বালি জমে তাল হয়ে রয়েছে! মানুষে ওই বালি ঠেলে ঠেলে এদিকে যায়, ওদিকে যায়। বন্যার বালি জমে বালির খাদান হয় একেকখানে। এখেনের মানুষ তাই জলের পিপাসায় বড় ব্যাকুল। এই তো দেখো না কেন, কাল এপাড়ার ছেলে-বুড়ো সব বাস ভাড়া করে সেই গঙ্গা চানে গেল। সে কী ঘটা গো! সেবার তো হাওড়া অবধিও গেছিল সব। তা এবেরে সব বললে, কলকেতায় গ্যাঞ্জাম কত! তারচে উদ্ধারণপুরেই চল কেনে! এপাড়ার মেয়ে-বউরা তাই উপোস গেল সারা দিন। ব্যাটাছেলেদের উপোস না গেলেও ক্ষতি নাই। ছেলেরা কি না খেয়ে পারে বাপু! সন্তুর বাপে তো চারটে মুড়ি ছাতু খেয়ে নিলে সক্কাল সক্কাল। দানা দানা আকের গুড় দে ছাতু-মুড়ি খাওনি তো! খেলে বুঝতে শান্তি কেমন। পেট ঠান্ডা একেবেরে।

তা গঙ্গা চানের পর খানিক খানিক মুড়ি খাওয়া হলো। তা বাপু ভিড় কত! দশহরা বলে কতা! উদ্ধারণপুরের ঘাট যেন উবজে পড়ছে। তা ঘরে ফিরে তো আর দড়াম করে শুয়ে পড়লে চলে না! সেই রান্না-খাওয়া সেরে তবে চাট্টি অব্‌সর হলো। তবু তা হলি কী হয়, গঙ্গা চানে এসে কিন্তু তুমি সেদ্ধ চালের ভাত খেতে পাবে না। তোমায় আলো চাল খেতে হবে। তা সে চালে ধম্ম হয়, তবু পেট কি ভরে গো! ভরে না। তার উপর এই দশহরায় আবার উপোস থাকো! সেই পুজো না হলে তুমি খেতে পাবে না। মনসাতলা নিকিয়ে মনসাগাছের ডাল পুঁতে পুজোর জোগাড়ে লেগেছে বুন আর মেয়ে। এই ফাঁকে খানিক খানিক চিনির পানা করে নিতি হবে। না, না নুন দিলি চলবিই না। পুজো না হলি 'পর তুমি নুন খেতে পাবে না আজ। আর যে নাগপঞ্চমী রাখবে, সে সারা সারা দিন খেতে পাবে না। তা এবারে অন্য শরিকের পালা পড়েছে, তাই খানিক সোয়াস্তি দেছে।

আরও পড়ুন: লীলাবতী, কালো বিড়াল আর জামাইষষ্ঠীর হাট

এই দিনে লোকে তো বলে বিষ্টি হয়! তা কালে কালে কত কী যে হচে, কত কী যে না হচে, দ্যাখো কেনে! এই যে আমাদের রতন ওই মোড়ের মাথায় চায়ের দোকান খুলে বসেছে, ওকে নেমন্তন্ন করতে গেছিল তো সন্তুর বাবা। পেত্যেক দিন ওর দোকানে চা খাওয়া হয়, গল্পগাছা চলে, তা ওরে না বললি কী হয়! তা নেমন্তন্নর কথায় ফস করে দেশলাই চেয়ে বসে রতন। বলে, কাকা ম্যাচলাইটটা দ্যান তো। তা সে মনসাপুজোয় কী ধুম, কী ধুম আমাগো দ্যাশে। রায়নি শুনতে ভিড় কত! সে যদি তোমারে দ্যাখাতে পারতাম কাকা! মেয়ে, বুইনে, পাড়ার মাইয়ায়- সব মিলে সে যা ঘটা! দ্যাশে থাকতি সেসব দিন কী আছিল!

গল্পে গল্পে রতনের নিশ্বাস পড়ে। খাল-বিলের দ্যাশের থিক্কা কোথায় যে আইস্যা পড়সে! এমন বালি-জমা নদী হ্যায় জীবনে দ্যাহে নাই। কিন্তু মাইনষে আর কী করে! প্যাটের ধান্দায় আইস্যা পড়সে এই না-গঙ্গার দ্যাশে। ওই বালিখাদানের ওই ওপারে বাঙালপাড়া। সন্তুর বাপে জানে এসব, ঘরের লোককে তাই বলেই দিয়েছে, রতনের কথায় অবাক যেও না, বুঝলে! ওরা বাঙাল বটে। এহেন রতন আজ গঙ্গাপুজোয় না-গঙ্গার দ্যাশে পাত পেড়ে প্রসাদ পাবে, এই না কত! ফল, মণ্ডা, রঙিণ মঠ খেতে খেতে রতনের কি খানিক খানিক মন খারাপ হবে? অর বুইনে রথের মেলায় কেমন গোলাপি মঠ কিনত, সেই কি মনে পড়বে ওর? পড়তেও পারে, মাইনষের মন তো। ভূগোলরে সে মানতে চায় না।

এই তো গেলবারে শেতলষষ্ঠীর দিনে, সন্তুর বাপে কোটোয় ভরে কলাইসেদ্ধ এনে দিসিল। তা রতন কয় কী, এমন কলাইসেদ্ধ আগে খাই নাই কাকা। বেশ লাগসে। সন্তুর বাপে তাই এবারে বাড়িতেই ডাকসে অরে। রতন এখন এক মনে পরসাদ খায়। পরসাদ খাওয়া হলে সন্তুর পিসি বলে, ভাই আমাদের সঙ্গে খানিক আলোচালের ভাত খাও কেনে! লজ্জা লজ্জা! মুখ-হাত-পা ধুয়ে রতন তাই বসে পড়েছে ওই। ওই যে, কলকে ফুলের ওপাশে, নিকোনো দাওয়া! ওইখেনে। এমন দাওয়ায় বসে ও কতকাল ভাত খায় না ভাই-বুনেদের সঙ্গে। ভাতের মধ্যে দেখে ডাঁটা দেছে, ডিংলি দেছে, ঘি-করলা দেছে, মায় পটলও দেছে। সন্তুর ঠাকুমায় বলে কী, ছেলেটাকে বেলপাতা দে জ্বাল দেওয়া খানিক ঘি দাও না বউমা! সন্তুর মায়ে তাই ওই ঘরে গেছে, গন্ধ ছড়ানো ঘি আনতে।

না-গঙ্গার দ্যাশে এমন ভাতের পাতে যখন ম্যাঘের ছায়া নামে তখন রতন আর কী করতে পারে? তার ঠাকমায় কইত, এমন কইর‍্যাই তো। কইত, ও মনু খাইসো? খাইসো নি? অরে বাত দিবা না বউমা? বালাম চাউলের বাতে লাল টুকটুকে কুমড়াসেদ্ধ দিয়ে খাইতে যা সুখ! সে তোমারে কইবারে পারি না কাকা! রতনের এমন কথায় রতনের কাকা, আমাদের সন্তুর বাপে হাসে। বলে, এই তো জষ্টির মাঝামাঝি হয়ে গেল। ঘর ডিংলি লাগাও কেন! এ হলো গে তোমার ভাদুরে কুমড়ো। রতন এমন কথায় না হেসে পারে না। কয়, কাকা আমার আর জমি-জিরেত কই! সব তো গ্যাসে গিয়া। কাকা তবু খানিক খানিক বীজ দেছে অরে। বালির খাদান পেরিয়ে ওই নাবাল ঢালু জমির ওপারে একমুঠো গোবর সার দে, রতন ডিংলির বীজ রুইছে। রুইতে রুইতে মেঘ নামছে মাঠের ওপারে। চষা মাটির ভেতর ঠেলে বেড়িয়ে আসছে পিরথিবির বুকের ওম। পিপাসা লাগছে অর। লাগবই তো। বৃষ্টি নাবল কি দু'-চার ফোঁটা? মাটির গন্ধ পাইতেসেন আপনেরা? রতনরে জিগান, ও কইব- বালাম চাউলের গন্ধ পাচ্ছেননি কত্তা?

More Articles