রথের মেলায় জিলিপি, পাঁপড়, ডালের বড়া, ঘরে শুঁটকিমাছের তেতোচচ্চড়ি

কাল রথ বলে কতা, বুড়ি এখন চানটান করে ডাল ঝেড়ে বেছে রাখবে এখন। কাল বুড়ো একখান দোকান দেবে, সে অবিশ্যি পেত্যেকবারই দিয়ে থাকে। জিলিপি, পাঁপড় আর ডালের বড়া।

আকাশে আকাশে মেঘেরা কেবল ঘুরে-ফিরে যায় সকাল-বিকেল। জল তেমন নাই গো। এমন দিনে জল না হলি কি হয়? ছেলেরা-বুড়োরা মাঠে মাঠে চাষ দেবে না? বর্ষার চাষেও যদি জল কিনতি হয়, তাহলে লোকে পারে ক্যামনে! ‘সময় গেলে সাধন হবে না’… এসব গান গুনগুনাতে গুনগুনাতে কেষ্টখুড়ো বীজতলার খুঁটিতে পেলাস্টিক বাঁধছে পাখির জ্বালায়, ঘুঘুর জ্বালায়। খুড়োর গোড়ালিভর্তি কাদা, গলায় কণ্ঠি, দাঁতে মিশি। এই এমন দিনে খুড়োর বাড়িতে কত যে লোক হতো! নাতি-নাতনি সবারে নে বুড়ো চলত রথের মেলায়। তা মেয়েরা টানেসপার হয়ে চলে গেছে সেই কোথায়, ব্যাটাও আজকাল কাজ ফেলে একদিনের জন্য আসতে চায় না এত দূর উবজে। বুড়ো তাই একা একাই গান গায় আর আকাশ দেখে। আকাশ দেখা বুড়োর বাড়িতে বুড়িও তো আছে! তা সে বুড়ি কী করে, তার খেয়াল আছে তোমাদের?

একটু রোদ ফুটতে পেরেছে কি পারেনি, আমাদের বুড়ি পায়ে করে সেদ্ধ ধান এলে দিচ্ছে। দুই সেদ্ধ ধান ভালো করে শুইকে ভাঙাতে পারলি, আবার বেশ কিছুদিন নিশ্চিন্তি। এখন আর একবারে বেশি করে করতে পারে না। শরীরে দেয় না। ধান এলে দিলিপ্পর বুড়ির খানিক জিরেন লাগে। লাগবে না-ই বা কেন বলো! তামুক-বিড়ির নেশা তো বুড়ির নেই, ওই ভেলিগুড় দে এক বাটি চা। বুড়ি সুরুক সুরুক করে চায়ে চুমুক দেয়। দু’খান বাসি রুটি পাইকে নে চায়ে চুবিয়ে চুবিয়ে বুড়ি খাবে এখন। চিনির চায়ে বুড়ির সোয়াদ লাগে না। চা-রুটি খাওয়া হলে বুড়ি মাজাখান অনেক কষ্টে তুলবে। ছাগল দুটোরে খানিক আলের ঘাস খাওয়াতে সাধ যায় বুড়ির, কিন্তু সে পরে হবেক্ষণ, আজ গুষ্টির কাজ পড়ে রয়েচে।

অন্যদিন নেত্যসেবা দিলেই চলে, রথের দিনে খানিক আয়োজন না করলি চলে না। এ-বাড়ির নিয়ম মেনে সামান্য হলেও খানিক ফল-ফলাদির জলপানি দিতি হয় নারায়ণরে। সে হবে এখন কাল। বুড়ি এখন বটি পেতে বসেছে। চিকন চিকন করে আলু আর উস্তা কুটতেচে। আলু আর উস্তায় আজ ভাজা হবে। বর্ষার দিনে বৃষ্টি না হলে কী হবে, বৃষ্টির ভাবখানা তো আছে! বুড়ির তাই চিংড়ি-শুঁটকি খেতে মন যায়। প্যাকেট হাতড়ে বুড়ি একমুঠো শুঁটকি বের করে আনে। ফালি ফালি করে মরিচ কেটে নেয়, তেল গরম হলিপ্পর মরিচের বাগাড় দে শুঁটকি ছড়িয়ে দেয় বুড়ি। আহা্‌ শুঁটকি দে তেতোচচ্চড়ি খেতে যা সুখ! বুড়ি সেই সুখের মাঝে তলিয়ে যেতে চায় কেবল। নাক টেনে খুন্তির বাস নেয় প্রাণ ভরে। নেবে না-ই বা কেন! মানবজীবনের এমন উপচে পড়া খুশির মধ্যে তলিয়ে যেতে কে না চায় বলুন! তেতোচচ্চড়ি নাইমে বুড়ি কাঠখোলায় দু'মুঠো কাঁঠালের বীজ পুইড়ে নেয়। শুকনো মরিচ ডলে মাখবে ওইক'খান, বুড়োর ভারি পছন্দ এসব। তবে এইটুকু রান্নায় বুড়ির মন ভরে না। বুড়ি তাই ওই দক্ষিণ ধারের মাচার পানে হাঁটা লাগায়। ঝুড়ি হাতে বুড়ি চলেছে ওই, বিবাগী মানুষ যেমন হাঁটা দেয়, তেমন ভঙ্গিখানা ওর। বগবগিয়ে ভাত ফুটছে, সেসব ফেলে রেখে চলে যাচ্ছে ওই। ওই আমাদের বুড়ি। কিন্তু বুড়ি তো আর বিবাগী মানুষ নয়, বুড়ি এখন মাচা থেকে কচি দেখে দেখে চিচিঙ্গার পাতা তুলবে। চিচিঙ্গার পাতা বাটা করবে বুড়ি আমাদের।

আরও পড়ুন: অম্বুবাচীর বিকেলে খিচুড়ি আর মাছের চচ্চড়ির গন্ধ

সবুজ লতায় কুরুশের মতো বোনা ফুল ফুটেছে চিচিঙ্গার, আহা কে যেন কুরুশ কাঠি দে অমন করে ফুলের নকশা বুনে দেছে গো! এমন ফুলের সামনে দাঁড়ালে আমাদের নিতান্ত সংসারী বুড়িরও মৌতাত লেগে যায়। গৃহী মানুষের অমন মৌতাত ভালো নয় গো, ভালো নয়। বুড়ি তাই ঝুড়িভরে পাতা তুলে পিছন ফেরে এবার। পিছনে এলিয়ে আছে ওই চিচিঙ্গার মাচা। দিনমানে এমন তারা ফুটিয়ে রাখতে জানে ক’জন বলো! নাহ্‌, আমাদের বুড়ির এসব আদিখ্যেতা পোষাবে না, খেটে খাওয়া মানুষের জন্য জাফরিকাটা জানলা আর কুরুশবোনা ফুল কে কবে বরাদ্দ করেছে বলো?

চিচিঙ্গা বাটা নেড়ে নিচ্ছে বুড়ি কড়াইয়ে। ওই ফাটা গোড়ালি চেপে বসে গেছে নরম মাটিতে। মাজাখান খানিক তুলে বুড়ি খুন্তি দে পাতাবাটা নাড়তেচে ঘনঘন। এসব হলিপ্পর বুড়ি আবার খানিক ধান এলে দে আসবে'খন। সেদ্ধ ধানের গন্ধে বুড়ির মৌতাত লাগতে চাইবে আবার কিন্তু বুড়ি ওসব অপার্থিব টানে গা ভাসাতে চাইবে কেন? কাল রথ বলে কতা, বুড়ি এখন চানটান করে ডাল ঝেড়ে বেছে রাখবে এখন। কাল বুড়ো একখান দোকান দেবে, সে অবিশ্যি পেত্যেকবারই দিয়ে থাকে। জিলিপি, পাঁপড় আর ডালের বড়া। এত ডাল কি আর বাটা যায়! বুড়ির মাজা ধরে যায় একেক সময়, কিন্তু বুড়োর নেশা ওই দোকানদারিতে। এই দেখো না, হপ্তাখানেক আগের তে ডাল, পাঁপড়, তেল সব কিনে নে এয়েচে। সেই ডাল বেছে, ঝেড়ে তবে না ভিজোতে পারে মানুষ! এ তো আর কেবল সওদা নয়, রথের দিনে মানুষরে এসব খাওয়াতে পারলেও পুণ্যি।

বুড়োর না হলেও আমাদের বুড়ির কিন্তু পুণ্যির লোভ আছে। তেমন লোভ আছে বলেই না বুড়ি আমাদের কলাই ডাল, খেসারির ডাল এমন যত্ন করে ধুয়ে বেছে রাখে! চিনির সিরা হবে এক কড়াই। বুড়ি তাই কড়াই, গামলা সব বের করেছে। এমন পার্বণের দিনে নাতিপুতিদের হাত ধরে বুড়ো কেমন দোকানদারি সাজিয়ে বসত, সেসব ভেবে কি বুড়ির চোখ খানিক ভিজে আসে? আসতেও পারে, মানুষের মন তো! চান সেরে ঠাকুর নমো করে বুড়ো-বুড়ি খেতে বসেছে ওই। তিতা-চচ্চড়ি দিয়ে ভাত মেখে গরাস তুলছে ভারি আরামে, ওই আমাদের বুড়ি। বুড়োর খাওয়া অত গোছানো নয়। এমন অগোছালো খাওয়া দেখলে বুড়ির বিরক্ত লাগে। সে আর বিরক্ত লাগলে কী হবে বলো! এসব পার্থিব বিরক্তি গৃহী মানুষ ক্যামন করে ত্যাগ দেয়! এ তো আর সুভদ্রা সুন্দরীর মতো নয় যে, দাদাদের কোল ঘেঁষে মাসির বাড়ি বেড়িয়ে আসা যাবে একচক্কর! সেসব ছেলেবেলা কবেকার কোন আষাঢ়ের বৃষ্টিতে ধুয়ে মুছে গেছে। সে যাক গে, বুড়ো তো আছে! রথের মেলা তো আছে! বুড়ির ভেজা চুল বেয়ে তাই জল গড়িয়ে পড়ে আষাঢ়ের মেঘ হয়ে। এই কি কম হলো?

More Articles