মুরগির সালন, কলিজার ভুনা, চিংড়ির টক... রান্নার গন্ধে মিশে থাকা গল্প
ফুপাতো বুনের মেয়ে সে যে কী সুন্দর মুরগির সালন রান্ধে! তবে যতই তোমরা এখন প্যাঁজ দে ভরিয়ে দাও কেন, আগের মতো বাস নেই গো রান্নায়। এমন ফেলে আসা জীবনের গন্ধে আবার সবাই নড়েচড়ে বসে।
মানুষের মনের মধ্যি একখান বাড়ি আছে। সেকথা জানলি পরে এই আপনিও চমকে যাবেন, জানলেন! সেখানে কাপড়খান টান টান করে বাঁশের খুটিতে মেলা থাকে। সে ঘরে রান্ধাবাড়ার গন্ধ ছড়ায়। ছড়াতেই হবে যে। এই না হলে জীবন! সে জীবনের সঙ্গে কখন যে কোথায় দেখা হয়ে যায়, কে জানে! এই যে চলেছে মহিলা কামরার একটেরে জীবন, এই জীবনে থেকে থেকে উঁকি দিচ্ছে হেঁশেলের জানলা। সেই জানলা দিয়ে মুখ বাড়ালে দেখা যায় গেরামঘরের ছবি। দেখবেন নাকি আপনেরা?
ওই একধারে টেরেনের মেঝেতে চট পেতে বসেছে হরিদাসী বোষ্টমী। তার রসকলিখান শুকিয়ে গেছে গো। বেচারার মুখখানও শুকিয়ে এতটুকু। গিয়েছিল সেই নীলাচলে। উলটো রথ ফুরোতে এই ফিরতি যাত্রা। সঙ্গে যা ছিল, সেসব ফুরিয়ে ঝুলি ফাঁকা। তাই বুঝি খিদেয় মুখখানা শুকিয়ে অমন গো! তা খাও না কেন? মুড়ি খাবে বউ? বোষ্টমী ঘাড় নাড়ে। আম এনেছিল ঝুলি ভরে, চিঁড়েতে-আমেতে খেয়ে রাস্তায় রাস্তায় কেটেছে ক'দিন। তা বলে গুষ্টির ছোঁয়া খাবার খাবে হরিদাসী? মোট্টে না, মোট্টে না। হরিদাসী তাই জানলা দিয়ে চলে যাওয়া জীবন দেখে, আর গুনগুনিয়ে কীর্তন ভাঁজে। সেই গানের সুর চাপা পড়ে যায় রেলগাড়ির শব্দে কি মহিলা কামরার কলকলানিতে, বোঝা ভার। আসমা বিবি একাই অবশ্য জমিয়ে রেখেছে আসরখানা। ইদে সে গিয়েছিল ফুপাতো বুনের বাড়ি, কলকেতায়। জেবনখানি তার ব্যস্ত হয়ে পড়েছে তাই। মনখানা তার পড়ে আছে গাঁওঘরের উঠোনে। জানলা দিয়ে দেখা যায় ক্ষেতখামারি। লাল টুকটুকে হয়ে আছে শাকের জমি। আসমা বিবি হাত দেখিয়ে বলে– ওই কী রে দিদি? লাল শাক, না? আহ্ শুকনা মরিচে রসুন কালাজিরা ফোড়ন দিয়ে ভাজলে ওই দে খাওয়া হয়ে যায়। নয় রে বুন?
লালশাকের ক্ষেত পেরোলে মাঠে মাঠে দেখা যায় পাটের ক্ষেত। এই লম্বা লম্বা পাটের পাতা দেখে আসমা বিবির তখন পাটের পাতা দে বুটের ডাল রাঁনতে ইচ্ছে করে। সেকথা শুনে ফরিদা বিবি মুখ বেঁকায়। রসুন দে লালতে শাকের ঝোল খাওনি তো! একথায় নড়ে চড়ে বসে আসমা বিবি। ফরিদা বিবির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, লালতে শাক কী রে বুন? ও মা লালতে শাক দেখেননি! তা সে আমাদের ওদিকে হয় একরকম। একথার পরে আর তো কথা চলে না, আসমা বিবি তবু বলে বসে সকালে ভাত খাওয়া হয়েছে? জনে জনে মহিলা কামরায় এই প্রশ্ন পাক খেয়ে বেড়ায়। ভাত খাওয়া হয়েছে? তাহলে শুধু হরিদাসী না, আসমা বিবিরও ভাতের খিদা লেগেছে, কী বলেন? তা দুপুরবেলা মানষের ভাতের খিদে লাগবে না? কী যে বলেন আপনেরা!
আরও পড়ুন: পরবের খুশিতে মিশে থাকে মটর ডাল, বেগুনভাজার সুবাস
ওহ্, ফুপাতো বুনের মেয়ে সে যে কী সুন্দর মুরগির সালন রান্ধে! তবে যতই তোমরা এখন প্যাঁজ দে ভরিয়ে দাও কেন, আগের মতো বাস নেই গো রান্নায়। এমন ফেলে আসা জীবনের গন্ধে আবার সবাই নড়েচড়ে বসে। তারাপীঠ যাচ্ছে, ওই আমাদের বৃহস্পতি। সেও হাতের তাগাখান টাইট করে নে গল্পের মধ্যে ঢুকে পড়ে। বৃহস্পতির বউমা, মানে বড় ব্যাটার বউ নাকি সব রান্নাতের রসুন দে একাক্কার করে। কত করে তাকে বলি গো, রসুনের গন্দ কি সবটাতে যায় রে? তা সে বউ শিকলে তো! সত্যি তো আগে মুরগি রাঁনলে সারা পাড়ায় কেমন গন্ধ ছড়িয়ে যেত! গাদা গাদা প্যাঁজ দিলিই কি আর রান্না জুতের হয় রে?
এমন রান্নার গল্পে খানিক খানিক জীবনের গন্ধ ঢুকে পড়ে বই কি! গাঁ-ঘরের সে গন্ধে মাঠঘাট আর পুকুরপাড়ের কত যে ছবি এসে জড়ো হয়! আর সেসব জড়ো হতে হতে আসমা বিবির মুখখানা খুশিতে ফেটে পড়তে চায়। আহা, আমরা কেমন রান্নার গল্প করছি বল দিদি! এই গল্পগুলো মোবাইলে ভিডিও কর না কেন! বলতে বলতে নিজেও সে তালি দিয়ে হেসে গড়িয়ে পড়ে। বাকিরাও কি না হেসে পারে? আসমা বিবির মোবাইল নেই তো কী হয়েছে? সব কি সবার থাকে? এই যে আমাদের আসমা বিবি, ওর বর তো গরম ভাত ফুটিয়ে দেয় এই বুড়ো বয়সেও! পানিটুকুও গড়িয়ে খেতে দেয় না বউরে। এই কি সবার থাকে?
বলতে বলতে ট্রেনের জানলায় এসে ভিড় করে নুয়ে পড়া বাঁশঝাড়। সেদিকে চোখ যেতেই , আবার প্রশ্নে ডুবে যায় আমাদের গল্প বুড়ি। বলে, বুন তোরা কেউ বাঁশের ফুল দেখিছিস? বাঁশের কোড় খেইচিস? এসব প্রশ্ন করে আসমা বিবি উত্তরের প্রত্যাশা করে না কখনও। নিজে নিজেই বলে। বলেই চলে। কোড় বেরলি পর একখান গোল মেটে হাঁড়ি ওতে চাপা দে দিতি হবে। তারপরে বেশ গোলমতো হয়ে গেলিপ্পর তুলে এনে খাতি হবে। ওহ্ জিরাবাটা গরম মশলা দে রাঁধলি খাতি যা স্বাদ না দিদি! বলতে বলতে খিদে খানিক বেড়ে যায় বুঝি বুড়ির। বৃহস্পতি চিকচিকি খুলে একখান পাকা পেয়ারা বের করে দেয়। ন্যাও খাও দিদি। নড়া দাঁতে এক পাশ দিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে নরম পেয়ারা খায় আসমা বিবি। খেতে খেতে মহিলা কামরায় ওর গল্প ঘুরে ফিরে বেড়ায়। সে গল্পে কলিজার ভুনা থেকে পুরনো তেঁতুল দিয়ে চিংড়ির টক, কাঁঠালের ভুতুড়ির গন্ধ ম ম করতে থাকে।
ফুপাতো বুনের মেয়ে মুরগির সালন রান্ধে ভালো, যতনও করেছে খুব। কিন্তু কী জানলি বুন, আমার উঠানের চুলার আঁচে মনখানা পড়ে আছে তো, সেখান খালি পুড়ায় রে। খালি পুড়ায়। এমন কথায় হরিদাসীও খানিক উদাস হয়ে যায়। নীলাচলের চেয়ে ওর আখড়া ঢের ঢের ভালো। এমন খিদে চেপে মানুষ কি পারে গো? আখড়ার খুচুড়ি তো খাওনি গো তোমরা!
নাহ্, গল্প আর ফুরোয় না। টেরেন এবারে বর্ধমান ঢুকচে। তা বলি ও আসমা বিবি? ও মাসি? তুমি যাবে কনে? তা মা যাব সেই কেষ্টনগর। এই তো হাওড়ার তে বর্ধমান এলাম, এখান তে ব্যান্ডেল যাব, সেখান তে নৈহাটি, সেখান তে কেষ্টনগর। এমন কথায় মহিলা কামরা হই হই করে ওঠে। সক্কলে বলে, সে কী গো? শিয়েলদার তে কেষ্টনগরের টেরেন ধরলে না কেন? কেউ বলে ব্যান্ডেল লোকাল ধরলে না কেন? আসমা বিবি, আবার খানিক হাসে। ওর হাসিতে মেটে হাঁড়ির ভাত ফোটার গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। আসমা বিবি কেবল নেমে যেতে বলে যায়, ও রাস্তা আমি চিনি নে বুন। ও রাস্তা আমি চিনি নে।