সাদা কাপড়ে এক ছিটে কালি, কেন ঝালদায় গো-হারা হারতে হল তৃণমূলকে?
কোনও নির্বাচনে এমন লজ্জাজনক পরাজয়ের ইতিহাস তৃণমূলের যেমন নেই, তেমনই হেরে যাওয়ার পর তৃণমূলের কোনও প্রার্থীও এতদিন এতখানি চড়া সুরে দলের একাংশর বিরুদ্ধেই এভাবে তোপও দাগেননি।
দলের 'ভরা কোটালে' তৃণমূল প্রার্থীর ঝুলিতে মাত্র ১৫২ ভোট! ২০১১-র পর বাংলায় এমন ঘটনা সম্ভবত এটাই প্রথম।
শাসক দলের ব্যাখ্যা হতে পারে, ওয়ার্ডটি ছিল কংগ্রেসের হাতে। গত পুর-নির্বাচনে জয়ী কংগ্রেস প্রার্থী তপন কান্দু চলতি বছরের মার্চ মাসে খুন হওয়ার কারণেই পুরুলিয়ার ঝালদা পুরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডে উপনির্বাচন হয়। এখানে কংগ্রেস প্রার্থী করে নিহত তপন কান্দু-র ভাইপো মিঠুন কান্দু-কে। ফলে একটা 'সিমপ্যাথি ওয়েভ' কাজ করেছে।
সহানুভূতির হাওয়া অবশ্যই ছিল। কিন্তু ওই হাওয়ার বেগ কি এতটাই ছিল যে, মোট প্রদত্ত ভোটের প্রায় ৯০ শতাংশই চলে যাবে কংগ্রেসের বাক্সে?
আরও পড়ুন: দশ বছর পর পাহাড়ে ভোট, গোর্খারা পেতে চলেছে নতুন নেতা?
ঝালদা পুরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডে মোট ভোটার সংখ্যা ১১৭৯ জন। ভোট দিয়েছেন ১১২০ জন। আর এই ১১২০ জনের মধ্যে ৯৩০ জনই ভোট দিয়েছেন কংগ্রেস প্রার্থীকে। কংগ্রেস প্রার্থী মিঠুন কান্দু ৭৭৮ ভোটে পরাজিত করেছেন নিকটতম তৃণমূল প্রার্থী জগন্নাথ রজককে। ঘাসফুলের প্রতীকে ছাপ দিয়েছেন মাত্র ১৫২ জন। বিজেপি প্রার্থী অবশ্য একজন ছিলেন, পেয়েছেন হাতে গোনা ৩৩ ভোট।
এই ফল প্রকাশ্যে আসার পর বেনজির ব্যবধান নিয়ে ইতিমধ্যেই রাজনৈতিক মহলে চর্চা শুরু হয়ে গিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, এই রাজ্যের একটি ওয়ার্ডে তৃণমূলের ভোটার মাত্র ১৫২ জন? এর উত্তর স্রেফ 'সহানুভূতি হাওয়া' বলে এড়ানো যায় না। পরাজিত তৃণমূল প্রার্থী কিন্তু বিষয়টি এড়িয়ে যাননি। ফল প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে অন্তর্ঘাতের অভিযোগ এনে তৃণমূল প্রার্থী জগন্নাথ রজক বলেছেন, “জয় প্রত্যাশিত ছিল। পিছন থেকে ছুরি মারা হলো। ঝালদা শহর তৃণমূল কংগ্রেস এই কাজ করল। এরাই অন্তর্ঘাতের পিছনে রয়েছে।"
কোনও নির্বাচনে এমন লজ্জাজনক পরাজয়ের ইতিহাস তৃণমূলের যেমন নেই, তেমনই হেরে যাওয়ার পর তৃণমূলের কোনও প্রার্থীও এতদিন এতখানি চড়া সুরে দলের একাংশর বিরুদ্ধেই এভাবে তোপও দাগেননি। এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, দলের শীর্ষ নেতৃত্ব এই বিষয়টি আর আগে এগোতে দেবে না। দলীয় স্তরে হয়তো খোঁজখবর নেওয়া হবে। তারপর এক সময়ে সবাই সবকিছু ভুলেও যাবে। তৃণমূলের একাংশই দলীয় প্রার্থীর জয়ের পথে কাঁটা ছড়িয়েছিলেন কি না, তার স্পষ্ট কোনও প্রমাণ বা তথ্য এখনও সামনে আসেনি। তাই অন্তর্ঘাতের বিষয়টি সামনে এনে কংগ্রেসের জয়কে খাটো করা অযৌক্তিক। তবে অন্তর্ঘাত যদি হয়েই থাকে, তার কারণ হতে পারে প্রার্থী বাছাই। হয়তো দলের স্থানীয় স্তরের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা-কর্মী এই প্রার্থীকে পছন্দই করেননি। তাঁদের হাতে হয়তো বিকল্প নাম ছিল। কিন্তু দলীয় অনুশাসন মেনে দল অনুমোদিত প্রার্থীকে মেনে নেন। এমন ক্ষেত্রে সাধারণভাবে দেখা যায়, দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে এক বা একাধিক 'নির্দল' প্রার্থী দাঁড়িয়ে যান। কিন্তু ঝালদা পুরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডে এমন কাণ্ড ঘটেনি। আপাতভাবে সব পক্ষই প্রার্থীর সমর্থনে 'নেমে পড়ে'। আর দলীয় পরাজিত প্রার্থীর অভিযোগ বলছে, এই 'নেমে পড়া'-র অর্থ, 'পিছন থেকে ছুরি মারা'। এমন হওয়ার আশঙ্কা পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কী এমন ঘটনা ঘটল যে, শাসক দলের এক প্রার্থীকে মাত্র ১৫২টি ভোট পেয়ে দৌড় শেষ করতে হলো? বিষয়টি স্বাভাবিক নয়৷
আর যদি তথাকথিত 'অন্তর্ঘাত' না হয়ে থাকে, যদি গোটা দল এক হয়ে ভোট করতে নামার পরেও এই ফল হয়ে থাকে, তাহলে বলতেই হয় দেওয়ালের লিখন অন্য বার্তা দিচ্ছে।
সেক্ষেত্রে এমন ধরে নেওয়া অসংগত হবে না যে, জঙ্গলমহলের জেলাগুলিতে শাসক দলবিরোধী একটা চোরাস্রোত বয়ে চলেছে। এই ইঙ্গিত কখনওই শাসক দলের পক্ষে সুখকর নয়। ঝালদা পুরসভায় মোট ১২টি ওয়ার্ড। গত পুরভোটে ৫টি করে ওয়ার্ডে জিতেছিল তৃণমূল কংগ্রেস এবং কংগ্রেস। দু'টি আসনে জিতেছিল নির্দল। ফলে কোনও দলেরই সংখ্যাগরিষ্ঠতা মেলেনি। এরপরই কংগ্রেস কাউন্সিলর তপন কান্দু খুন হয়ে যান। এই উপনির্বাচনে তৃণমূল যদি জয়ী হতো, তাহলে বোর্ড গঠনের কাছাকাছি চলে যেতে পারত। কংগ্রেস নিজের আসন ধরে রেখে ফের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এল।
চন্দননগরে পুরনিগমের ১৭ নং ওয়ার্ডেও ওই একই দিনে উপনির্বাচন হয়েছে। ফলপ্রকাশের পর দেখা যাচ্ছে, ওই ওয়ার্ডে সিপিএম প্রার্থী জিতেছে ১৩০ ভোটে। দ্বিতীয় স্থানে আছে তৃণমূল কংগ্রেস। উপনির্বাচনে বামেরা পেয়েছে ১০১৮ ভোট। তৃণমূল প্রার্থী সুজিতকুমার নাথ পেয়েছেন ৮৮৮ ভোট। গতবারের বিজয়ী দল বিজেপির প্রার্থী সৌমেন দাস পেয়েছেন ৬৭ ভোট। কংগ্রেসের ঝুলিতে গিয়েছে ৪৪ ভোট। চন্দননগর পুরনিগমের ভোটের আগে বিজেপি প্রার্থী গোকুলচন্দ্র পালের মৃত্যুর কারণেই এই ওয়ার্ডে ভোটগ্রহণ স্থগিত রাখা হয়েছিল। এই ওয়ার্ডে প্রায় ৩২ বছর পর জয়ী হল বামেরা। ফলে এই জয় বামেদের কাছে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এই পুরনিগমের মোট ৩৩টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৩১টি তৃণমূলের দখলে, একটি সিপিএমের এবং এই ১৭ নম্বর ওয়ার্ডটি শূন্য ছিল। এত বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়েও তৃণমূল এই ওয়ার্ডটি কীভাবে হারল, প্রশ্ন উঠেছে তা নিয়েও। সবুজ ও গেরুয়ার টানাটানিতে বামেদের এই জয় স্বভাবতই বড় সাফল্য, যা অন্য ভাবনার খোরাক দিয়েছে রাজনৈতিক মহলকে।