রাষ্ট্রপতি হওয়ার দৌড়ে কতটা এগিয়ে দ্রৌপদী মুর্মু? বিরোধীদের এই ব্যর্থতাই বিজেপির তাস
ভোটমূল্যের নিরিখে কিছুটা পিছিয়ে থাকার জন্যই বিস্তর হিসেব করে বিজেপি এবার প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে। রাজনৈতিক মহলের অভিমত, দ্রৌপদী মুর্মুকে প্রার্থী করার মূল উদ্দেশ্য, বিরোধী ভোটে ভাগ বসানো।
রাইসিনা পাহাড়ের সঙ্গে দ্রৌপদীর দূরত্ব ক্রমশই কমছে।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ভোটের অঙ্ক দ্রুত বদলে যাচ্ছে। নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরুর সময় বিরোধী শিবিরের মোট ভোটমূল্যের তুলনায় কিছুটা পিছিয়েই ছিল বিজেপি তথা এনডিএ। তখনকার অঙ্ক অনুসারে এনডিএ-র থেকে প্রায় ২.২ শতাংশ ভোটমূল্যে এগিয়ে ছিল বিরোধী শিবির। অঙ্কের নিরিখে বিজেপি ও তার সহযোগীদের ভোট ৪৮.৯ শতাংশ। সেখানে বিরোধীদের ভোট ৫১.১ শতাংশ। বিজেপি চিন্তিত ছিল, বিরোধীরা এক হলে সমস্যায় পড়তে পারে এনডিএ প্রার্থী। দ্রৌপদী মুর্মুকে বিজেপি রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী করার পর ওই অঙ্ক অনেকটাই বদলে গিয়েছে। এখন দেখার, বিরোধী প্রার্থী যশবন্ত সিনহা এই নতুন সমীকরণ কতখানি বদলে দিতে সফল হন।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হয় ইলেক্টোরাল কলেজের মাধ্যমে। সংখ্যায় বেশি ভোট পেলেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জেতা যায় না। পেতে হবে বেশি মূল্যের ভোট। একজন প্রার্থী ঠিক ক’টি ভোট পেলেন, হার-জিতের ফয়সালা তার ওপর নির্ভর করে না। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে এক জন প্রার্থী কত মূল্যের ভোট পেলেন, জয় নির্ধারিত হয় তার ভিত্তিতেই।
আরও পড়ুন: দ্রৌপদী মুর্মুকে সামনে রেখেই চলছে ইতিহাস পালটে দেওয়ার খেলা
এবারের নির্বাচনে ইলেক্টোরাল কলেজের সদস্য অর্থাৎ লোকসভা, রাজ্যসভা এবং দেশের সবক'টি রাজ্য বিধানসভার নির্বাচিত বিধায়কের সংখ্যা মিলিয়ে মোট ৪৮০৯ জন। এর মধ্যে নেই জম্মু- কাশ্মীর বিধানসভা। কারণ, ওই রাজ্যে বিধানসভা ভেঙে জারি আছে রাষ্ট্রপতি শাসন। এই ৪৮০৯ জনের মধ্যে রাজ্যসভার সদস্য ২৩৩ জন, লোকসভার ৫৪৩ এবং বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভার ৪০৩৩ জন সদস্য রয়েছেন। এই ৪৮০৯ জনের মোট ভোটমূল্য ১০,৮৬, ৪৩১। ফলে জিততে হলে প্রার্থীকে পেতে হবে ন্যূনতম ৫,৪৩,২১৬ ভোটমূল্যের সমর্থন। এনডিএ বা বিজেপি এখানেই প্রায় ৯ হাজার ভোটমূল্যে পিছিয়ে।
সাংসদ ও বিধায়কদের ভোটের মূল্য আলাদা। আবার সব রাজ্যের বিধায়কদের ভোটের মূল্যও এক নয়। বিষয়টি নির্ভর করে সেই রাজ্যের জনসংখ্যার ওপর। যেমন, উত্তরপ্রদেশের কোনও বিধায়কের ভোটের মূল্য ২০৮, অথচ মিজোরামে ৮, তামিলনাড়ুর ক্ষেত্রে ১৭৬। এর কারণ, ১৯৭১ সালের জনগণনা অনুযায়ী প্রতিটি রাজ্যের জনসংখ্যা যা ছিল, সেই সংখ্যাকেই এখনও রাজ্যের জনসংখ্যা হিসেবে ধরে নির্বাচিত বিধায়ক সংখ্যা দিয়ে ভাগ করা হয়। শুধু এই বছরই নয়, ২০২৬ সাল পর্যন্ত এই পদ্ধতিতেই চলবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। আর এই হিসেব অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা ৪ কোটি ৪৩ লক্ষ ১২ হাজার ১১ জন। তাই নির্বাচিত ২৯৪ জন বিধায়কের সংখ্যা দিয়ে জনসংখ্যাকে ভাগ করলে পশ্চিমবঙ্গের প্রতি বিধায়কের ভোটমূল্য ১৫১। তবে দেশের প্রতিটি সাংসদের ভোটের মূল্য এক, তা হচ্ছে ৭০০।
ভোটমূল্যের নিরিখে কিছুটা পিছিয়ে থাকার জন্যই বিস্তর হিসেব করে বিজেপি এবার প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে। রাজনৈতিক মহলের অভিমত, দ্রৌপদী মুর্মুকে প্রার্থী করার মূল উদ্দেশ্য, বিরোধী ভোটে ভাগ বসানো। কেন ওঁকে প্রার্থী করা হলো, সে ব্যাপারে বিজেপি যতই ভালো ভালো ব্যাখ্যা দিক, আসল কথা একমাত্র দ্রৌপদী মুর্মু প্রার্থী হলেই উড়িষ্যা বা ঝাড়খণ্ড বিধানসভা থেকে 'আবেগ ভোট' আসতে পারে। সেই ভোট পেলেই মুখরক্ষা হবে মোদি-শাহর। একমাত্র এই একটা কারণেই প্রার্থী করা হয়েছে দ্রৌপদী মুর্মুকে। বিজেপির এই কৌশল পুরোমাত্রায় সফল। উড়িষ্যার ভূমিকন্যা হওয়ার জন্য ওই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়েক ইতিমধ্যেই আবেগতাড়িত হয়ে ঘোষণা করেছেন তাঁর দল, বিজেডি সমর্থন করবে বিজেপি প্রার্থীকেই। বিজেডি খাতায়-কলমে বিজেপির বন্ধু-দল না হলেও দ্রৌপদী মুর্মুকে ভোট দেবে৷ ওদিকে ঝাড়খণ্ডের রাজ্যপাল ছিলেন দ্রৌপদী মুর্মু৷ তাই ঝাড়খণ্ডের শাসক দল জেএমএম-ও বিজেপি বিরোধী হলেও মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন জানিয়ে দিয়েছেন, তাদের সমর্থন যাবে দ্রৌপদী-র দিকেই৷ বিজেপির অঙ্ক মিলে গিয়েছে৷ বিজেডির মোট ভোটমূল্য ৩১,৬৮৬ এবং ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার মোট ভোটমূল্য ৬,৬৮০ দ্রৌপদী মুর্মুর পক্ষে ইতিমধ্যেই এসে গিয়েছে। দুই দলের মোট ভোটমূল্য ৩৮,৩৬৬, অথচ এই ভোটের একটি অংশ যাওয়ার কথা বিরোধী প্রার্থী যশবন্ত সিনহার বাক্সে। তা আর হচ্ছে না। ভোটের শুরুতে কম থাকা ৯ হাজার ভোটমূল্য ছাপিয়ে গিয়েছে এই দুই দলের সমর্থন পাওয়ার পর।
ওদিকে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারও জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁর দল জেডিইউ-ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে দ্রৌপদী মুর্মুর পাশে থাকবে। নীতীশ কুমারের জেডিইউ-র মোট ভোটমূল্য ২২,৬০১। সাম্প্রতিককালে নীতীশের সঙ্গে বিজেপির সখ্য উধাও হয়ে গিয়েছিল। তাই এই ভোট বিজেপি আশা করেনি। কিন্তু মহারাষ্ট্র সরকারের পরিস্থিতি দেখার পর নীতীশ কুমার আর ঝুঁকি নেননি। কোনও অনুরোধ পাওয়ার আগেই বিজেপি'র গুড বুকে নাম তুলে ফেলেছেন, পাছে না তাঁর পরিণতিও উদ্ধব ঠাকরের মতো হয়। ফলে বিরোধী প্রার্থী যশবন্ত সিনহার ব্যাকগ্রাউন্ড বিহার হলেও বিহারের শাসক দল তাঁর পাশে থাকছে না। পুরোটাই যশবন্তের হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে। বিজেডি এবং জেএমএম-এর পর নীতীশের জেডিইউ-র মোট ভোটমূল্য ২২,৬০১ মুর্মুর পক্ষে যাওয়ায় বাড়তি ভোটমূল্যের সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে ৬০,৯৬৭, মাথায় রাখতে হবে বিজেপির কম ছিল মাত্র ৯ হাজার ভোটমূল্য।
ওদিকে মহারাষ্ট্রের মহা সংকটেও কপাল পুড়তে পারে বিরোধী প্রার্থী যশবন্ত সিনহার। রাজনৈতিক সমীকরণ অনুসারে মহারাষ্ট্রের শাসক জোট মহাবিকাশ অঘাড়ি-র সব ভোট যশবন্তের পক্ষে যাওয়ার কথা৷ মহাবিকাশ অঘাড়ি গঠিত হয়েছে শিবসেনা, এনসিপি এবং কংগ্রেসকে নিয়ে। এই তিন দল বিজেপির সঙ্গে নেই। কিন্তু মহারাষ্ট্রে শিবসেনার একনাথ শিন্ডের বিদ্রোহ, যশবন্ত সিনহাকে হতাশ করতে চলেছে৷ শিন্ডে আওয়াজ তুলেছে শিবসেনাকে এখনই ছাড়তে হবে এনসিপি এবং কংগ্রেসের সঙ্গে পথ চলা। ফলে এনসিপি এবং কংগ্রেসের ভোট যশবন্তর পক্ষে গেলেও শিন্ডে-অনুগামী বিধায়ক বা সাংসদরা কিছুতেই ভোট দেবেন না যশবন্তকে। শিবসেনার উদ্ধব-গোষ্ঠীর ভোট পেলেও পেতে পারেন যশবন্ত। তবে ঘটনাক্রমে একনাথ শিন্ডে যদি বিজেপির সঙ্গে জোট গড়ে মহারাষ্ট্রে সরকার গঠন করে ফেলেন এবং নিজে উপ-মুখ্যমন্ত্রী হন, তাহলে ঠাকরের হাতে ক'জন বিধায়ক শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে, তা আগাম বলা মুশকিল।
মোটের ওপর, এখন যা অঙ্ক, তাতে যত ভোট বা ভোটমূল্যের আশা করে যশবন্ত সিনহা বিরোধী প্রার্থী হয়েছেন, সেই হিসেব গুবলেট হয়ে গিয়েছে। ভোটের এখনও বাকি অনেকদিন। ততদিনে বিরোধী শিবিরে নতুন কোনও আঘাত নেমে এলে বা বৃহত্তর রাজনৈতিক সমীকরণ কিছুটা বদলে গেলে বিরোধী প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোটমূল্যের দ্বিগুণও পেয়ে যেতে পারেন দ্রৌপদী মুর্মু।