বাংলায় নির্বাচন কমিশনকে যে প্রশ্নগুলির জবাব দিতেই হবে

Election Commission: গত ৩ বছরের অবৈধ অনুপ্রবেশকারী গ্রেপ্তার হওয়া বা বিহারের বিশেষ নিবিড় সংশোধনীর হিসেব যদি দেখা যায়, তাহলে কিন্তু তা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বয়ানকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়।

প্রস্তুতি প্রায় শেষের পর্যায়ে। বিহারে বিশেষ নিবিড় সংশোধনীর পর বাংলায় শুরু হতে চলেছে একই প্রক্রিয়া। দেশের সর্বোচ্চ আদালত বলেছে, তাদের নির্বাচন কমিশনের উপর ভরসা আছে। স্রপ্রিম কোর্ট মনে করে, যে নির্বাচন কমিশন যদি কোনও ভুল করেও থাকে, তা ইচ্ছাকৃত নয়। ভবিষ্যতে অন্যান্য রাজ্যে যখন এই বিশেষ নিবিড় সংশোধনী হবে, সেই ভুল তারা শুধরে নেবে। অনেকে বলছেন, বিহারে যা হয়েছে, অর্থাৎ যে পরিমাণে আসল ভোটার বাদ যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে, তা বাংলায় হবে না। বিজেপির কেউ কেউ বলছেন, বিহারে যদি ৮০লক্ষ ভোটার বাদ গিয়ে থাকে, বাংলায় অন্তত তার দ্বিগুণ ভোটার বাদ যাবে। প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে গুলি চালিয়ে এই প্রক্রিয়া করা হবে। কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন বলার আগেই বাংলার প্রধান বিরোধী দল যখন বাদ দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিচ্ছে, তখন এই প্রক্রিয়া আদৌ কতটা প্রশাসনিক, আর কতটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।

কেন্দ্রের শাসকদলের তরফে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বিভিন্ন সাক্ষাৎকার থেকে শুরু করে বিহারের নানা সভায় বলে চলেছেন একটাই কথা, "অনুপ্রবেশকারীরা কি ভারতের ভোটার তালিকায় থাকতে পারেন?" তিনি এই ভোটার তালিকা শুদ্ধিকরণ কিংবা বিশেষ নিবিড় সংশোধনীর বিষয়টিকে ‘হ্যাঁ অথবা না’ এই বাইনারিতে দাঁড় করাতে চাইছেন। মনে হচ্ছে যেন, অবৈধ অনুপ্রবেশকারীরা সারা দেশের জনবিন্যাস বদলে দিয়েছে। এই তত্ত্বটা এতটাই গভীরে প্রবেশ করানো গেছে, যে প্রতিটি মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, যে অনুপ্রবেশকারীরা উইপোকার মতো দেশের সম্পদ ধ্বংস করছে, এবং তাঁদের জন্যেই কর্মসংস্থানের অভাব হচ্ছে। অথচ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের নিজস্ব তথ্য কিন্তু সেই ইঙ্গিত দেয় না। গত ৩ বছরের অবৈধ অনুপ্রবেশকারী গ্রেপ্তার হওয়া বা বিহারের বিশেষ নিবিড় সংশোধনীর হিসেব যদি দেখা যায়, তাহলে কিন্তু তা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বয়ানকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়।

বাংলা ভাষায় কথা বলার জন্য, দেশের নানা প্রান্তে বাঙালি আজ আক্রান্ত। সারা দেশের পুলিশ প্রশাসনের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, তাঁদের কাছে যেন অলিখিত নির্দেশ আছে, বাঙালি দেখলেই, বা বাংলায় কথা বললেই, তাঁকে বাংলাদেশি বলে সন্দেহ করা। যে বাঙালিকে একসময় মুম্বই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি বাঙালিবাবু বলে সম্বোধন করতো, সেই বাঙালিকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে সন্দেহ করা হচ্ছে। এই বিষয়কে ধরে যখন এক সাংসদ প্রশ্ন করেছেন সংসদে দাঁড়িয়ে— তাহলে নাগরিকত্বের সংজ্ঞা কী? যার উত্তর কিন্তু সরকারপক্ষ দিতে পারছে না। অথচ পূর্ণ উদ্যমে, প্রচার করা হচ্ছে, সারা দেশের জনবিন্যাস বদলে গেছে, অনুপ্রবেশকারীদের জন্য। অথচ বিহারের সদ্য শেষ হওয়া বিশেষ নিবিড় সংশোধনীর যে ফলাফল আমরা দেখতে পেয়েছি, তাতে কিন্তু খুব বেশি বিদেশি সনাক্তকরণ করা যায়নি, যার মধ্যে দিয়ে এটা প্রমাণিত হয়, যে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীরা জনবিন্যাস বদলে দিয়েছে। একজনও রোহিঙ্গা কিংবা নেপালি কিংবা বাংলাদেশি কিন্তু চিহ্নিত করা যায়নি।

আরও পড়ুন- ‘ভোট চুরি’ বা এসআইআর! নির্বাচন কমিশনের সেম-সাইড গোল?

একটা সময় নির্বাচন কমিশনের ইআরও হিসেবে কাজ করা, সরকারি আমলা কান্নান গোপিনাথন সম্প্রতি কংগ্রেসে যোগ দিয়েছেন, তিনি এই বিষয়ে একটা ভালো যুক্তি দিয়ে থাকেন, যা সবার জানা উচিৎ। "ধরা যাক আমাদের বাড়িতে কারেন্ট চলে গেল, তার একঘণ্টা পরে আবার কারেন্ট ফেরত এলো। কারেন্ট যাওয়ার সময়ে আমরা সাধারণত কী করে থাকি? বিদ্যুৎ দফতরে খবর দিয়ে থাকি। তখন সেই সমস্যার সমাধানের জন্য দায়িত্বে থাকা আধিকারিক বলেন যে— তাঁরা দেখছেন সমস্যাটা কোথায়, হয়তো কারেন্ট আসতে আরও ১ঘণ্টা সময় লাগতে পারে। আমরা তা মেনে নিয়ে কখন আসবে কারেন্ট তার জন্য অপেক্ষা করি। একঘণ্টা পরেও যদি না আসে তাহলেও অপেক্ষা করি। আমাদের অসীম ধৈর্য। কিন্তু এটা যদি ১ ঘণ্টা না হয়ে ১ দিন হয় বা ১ মাস, তাহলেও কি আমরা এরকমভাবেই অপেক্ষা করবো? আসলে আমরা সব কিছু মেনে নিতে শিখেছি। উল্টে বিদ্যুৎ দফতরকে প্রশ্ন করিনি বা করিনা কেন কারেন্ট গেল? ঠিক একইভাবে যখন নোটবন্দি হলো, তখন বলা হলো যে কালো টাকা বন্ধ করতে হবে। সবাই একবাক্যে রাজি হয়ে গেলাম হ্যাঁ, সেটা তো করাই উচিৎ। কিন্তু দেখা গেল যে, আমাদের পরিবারে যেটুকু জমানো টাকা ছিল সেটা নিয়ে আমাদেরকেই ব্যাঙ্কের সামনে দাঁড়াতে হলো এটা প্রমাণ করতে যে ওই জমানো টাকাগুলো কালো নয়। আসলে আমরা আবারও প্রশ্ন করলাম না, কালো টাকা কী? আমরা আবারও বললাম না যে, আপনি আমি যে বেতন পাই বা তার থেকে যা জমানো হয় সেটা কালো নয়। টাকা কালো হয় না বা সাদা হয় না। টাকার আদানপ্রদানটা কালো বা সাদা হতে পারে।"

আজকে যখন ভোটার তালিকা শুদ্ধিকরণের নামে বিশেষ নিবিড় সংশোধনী করে বহু ভোটারের নাম বাদ দেওয়ার অভিযোগ উঠছে, যখন দেখা যাচ্ছে বিহারে প্রায় ১০ শতাংশ মানুষের নাম বাদ পড়েছে, যে তালিকা এখনও নির্বাচন কমিশন প্রকাশ করেনি। জানায়নি, কোন ভোটারের নাম কী কারণে বাদ গেছে, তখন কান্নান গোপিনাথনের কথাগুলোকে আবার মনে করতে হয়। যে সময়ে কান্নান গোপিনাথন সরকারি আমলার কাজ থেকে পদত্যাগ করেন, তখন তার মনে হয়েছিল তিনি আগে একজন নাগরিক, আর এই দেশের নাগরিক হওয়ার কারণে তাঁর কিছু দায়িত্ব বর্তায় এই সরকারকে প্রশ্ন করার। তারপর থেকে তিনি মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছেন এবং মানুষকে উৎসাহিত করছেন প্রশ্ন করতে। এই মানুষের কাছে পৌঁছনোর প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে তিনি সাম্প্রতিক সময়ে কংগ্রেসে যুক্ত হয়েছেন। তাঁর মনে হয়েছে, তিনি কংগ্রেসে থেকেই এই প্রশ্নগুলো করতে পারবেন।

চাকরি ছাড়ার সময় তিনি দেখেছিলেন দেশের প্রতিটি মানুষ অত্যন্ত আতঙ্কিত হয়ে আছেন, কারণ সারা দেশজুড়ে নাকি নাগরিকপঞ্জী বা এনআরসি চালু হবে। প্রত্যেকটি মানুষ তাঁদের তথ্যপ্রমাণ জোগাড় করতে শুরু করে দিয়েছেন। সেই প্রক্রিয়াতে মানুষের অফুরন্ত টাকাও নষ্ট হচ্ছে। এই জায়গায় এসে তিনি প্রথমে নিজেকে প্রশ্ন করতে বললেন আবারও। এই যে সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, অবৈধ অনুপ্রবেশকারীতে ভরে গেছে, সরকার কী করে চিনছে একজন অবৈধ অনুপ্রবেশকারীকে? সরকার কী করে একজন মানুষকে বলবে সে অবৈধ, অনুপ্রবেশকারী। তাহলে কি যার কাছে কোনও তথ্য প্রমাণ নেই বা সরকার নির্ধারিত কোনও নথি নেই, তিনিই অবৈধ অনুপ্রবেশকারী? না আসলে যে মানুষটি এদেশে এসেছেন অবৈধ ভাবে, তিনি তো কোনও কারণে এসেছেন। তাহলে এদেশে এসেই তিনি নিশ্চিত নিজের কাগজপত্র বানিয়ে নিয়েছেন, তাঁর উদ্দেশ্য সাধনের জন্য। কোন মানুষটির কাছে কোনও কাগজ নেই? যিনি নিশ্চিন্তে এখানে জন্মেছেন এবং যিনি জানেন যে তাঁর কোনও নথিপত্রের প্রয়োজন নেই। এখন সারা দেশে যদি নাগরিকপঞ্জী বা এনআরসি চালু করা হয়, তাহলে তো প্রতিটি সাধারণ মানুষকে প্রমাণ দিতে হবে তিনি ভারতীয় এবং তার জন্য শুধু নিজের নয় পূর্বপুরুষের নথি জোগাড় করতে হবে। কিন্তু তাহলেও কি তিনি প্রমাণ করতে পারবেন তিনি ভারতীয়। তাঁকে প্রমাণ করতে হবে তিনি প্রতিবেশী দেশ থেকে ধর্মীয় উৎপীড়নের কারণে উৎখাত হয়ে এসেছেন। তারপর সরকার তাঁকে রিফিউজি বা শরণার্থীর তকমা দেবে। তাহলে আপনি নিজের দেশে নাগরিক থেকে শরণার্থী হয়ে যাবেন। আর একজন শরণার্থী তো সরকারের দয়ায় বাঁচে, সে কি আর তখন সরকারকে প্রশ্ন করতে পারবে? নাকি সরকার তাঁকে যে দয়াদাক্ষিণ্য করবে সেই নিয়েই তিনি বেঁচে থাকবেন?

আরও পড়ুন- এসআইআর শেষে বিহারের চূড়ান্ত ভোটার লিস্ট: অজস্র অসঙ্গতির উত্তর নেই

বাংলার ভোটার তালিকা সংশোধনী নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন— এই প্রক্রিয়া আসলে ঘুরপথে নাগরিক পঞ্জীকরণেরই প্রক্রিয়া। বাংলার অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্য কিন্তু এক নয়। সিপিআইএমএল ছাড়া বেশ কিছু নাগরিক সংগঠন এটা বললেও, বামেদের মূল ধারার দলগুলো কিন্তু এখনও এই প্রক্রিয়াকেই সমর্থন করছেন। কেউ কেউ বলছেন যে, ভোটার তালিকায় অনেক ভুয়ো এবং মৃত ভোটার আছে, তাঁদের বাদ দেওয়া হোক, তবেই ভোটার তালিকা শুদ্ধ হবে। যাঁরা এই কথা বলছেন, তাঁদের কাছে আবারও কান্নান গোপিনাথনের প্রশ্নটিকেই করতে হয়, তাঁরা কি তাহলে সরকারপক্ষের যুক্তিজালকেই সঠিক মনে করছেন? যদি তা না হয়, তাহলে কীসের ভিত্তিতে এই কথা বলছেন? ভোটার তালিকায় হয়তো বেশ কিছু মৃত ভোটার আছে, কিন্তু তা মোছার দায়িত্ব তো নির্বাচন কমিশনের এবং যা প্রত্যেক বছর, সাধারণ ‘সামারি রিভিশন’ করলেই করা সম্ভব। তার জন্য তো বিশেষ নিবিড় সংশোধনী করতে হয় না, যে প্রক্রিয়ায় প্রতিটি ভোটারকে তাঁর নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে হয়। একজন চোর চিহ্নিত করতে তো সারা পাড়াকে চোর সাব্যস্ত করা যায় না। ঠিক যেমন ‘কালো টাকা’ বন্ধ করতে নোটবন্দি কোনও সমাধান নয়, তেমনই ভুয়ো ভোটার বাদ দিতে, সমস্ত মানুষকে নাগরিকত্বের পরীক্ষা দিতে বলা কোনও পদ্ধতি হতে পারে না।

ভারতের নির্বাচনের ইতিহাসে যা আজ অবধি হয়নি, তা এবার নির্বাচন কমিশন করছে। এতদিন অবধি, কোনও ভোটারকে যদি সন্দেহ হতো, তাহলে তাঁর নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র চাওয়া হতো। কমিশনের নতুন নিয়ম অনুযায়ী, প্রতিটি ভোটারকে আজকে তাঁর নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে হবে, যা কখনোই কাঙ্খিত নয়, এবং তা করতে গিয়ে যদি বিহারের মতো ৮০ লক্ষ মানুষ বা তার কয়েকগুণ বেশি মানুষ বাদ পড়েন, তার দায় কে নেবে? তার মধ্যে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকাও যথেষ্ট অস্বচ্ছ। যদি ২০০২ সালের সঙ্গে ২০২৫ সালের ভোটার তালিকা মিলিয়ে দেখা হয়ে গিয়েই থাকে, তাহলে গতবারের তালিকায় যাঁদের নাম আছে তার অন্তত ৫০ শতাংশ নাম না থাকারই কথা। কাদের নাম আছে, আর কাদের নাম নেই, এবং কী কারণে নেই সেই তথ্য সর্বসমক্ষে আনতে হবে, এই দাবী করা উচিৎ সমস্ত রাজনৈতিক দলের। নির্বাচন কমিশনের বকলমে, কেন্দ্রীয় শাসকদলের নেতারা একের পর এক কথা বলে যাবেন, "বাংলায় বিশেষ নিবিড় সংশোধনী হলে ২ কোটি থেকে ৪ কোটি মানুষ বাদ যাবেন" বা "বাংলায় রোহিঙ্গারা থিক থিক করছে"— আর বাংলার মানুষ তা মুখ বুজে মেনে নেবে তা তো হতে পারে না। বিহারে প্রায় কোনও রাজনৈতিক প্রতিরোধ ছাড়া এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে নির্বাচন কমিশন, বাংলায় কিন্তু এখনও একটা নাগরিক সমাজ আছে, যারা কোনও রাজনৈতিক দলেরই সমর্থক নয়, আর কে না জানে গণতন্ত্রে একজন নাগরিকের কন্ঠস্বরও যথেষ্ট শক্তিশালী। বাংলায় বিশেষ নিবিড় সংশোধন নিয়ে কমিশনকে কিন্তু নাগরিকদের বহু প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।

লেখকের মতামত ব্যাক্তিগত 

More Articles