যে বাসে বসে শহর দেখত কলকাতা: লাল ডাবল ডেকারের স্মৃতিচারণ
Double decker bus: এই বাসগুলির উপরের তলায় ছাদ ছিল না অর্থাৎ ওপেন টপ। গরমের দিনে যাত্রীরা ছাতা মাথায় বসে শহর দেখতেন। বর্ষায় কালো ছাতার সারি দেখে মনে হতো, ঠিক যেন একটা চলমান ছবি ঘুরে বেড়াচ্ছে শহর জুড়ে।
১৯২৮ সালের ২০শে ডিসেম্বরের সকাল ৯টা...
শ্যামবাজারের পাঁচমাথা মোড় থেকে একটি দোতলা বাস ছাড়ছে, গন্তব্য স্থল কালীঘাট... কয়েকজন অফিস যাত্রীর ভিড়... বাস ধরার তাড়া...আবার দোতলায় বসার জায়গা পেলে তো সোনায় সোহাগা... বেশ হাওয়া খেতে খেতে, খবর পড়তে পড়তে অফিসে পৌঁছে যাওয়া যাবে...
উনিশ শতকের বিভিন্ন ছবিতে কলকাতার শহুরে জনবহুল বিশৃঙ্খল জনজীবন দেখাতে এই দোতলাকে বাসকে আমরা দেখেছি মহানগরীর রাস্তা জুড়ে ঘুরে বেড়াতে। কলকাতা শহরের ঐতিহ্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে লাল রঙের ডাবল ডেকার বাস। লন্ডনের আইকনিক রেড বাসের আদলে তৈরি এই দোতলা বাসগুলি কলকাতার রাস্তায় ছুটে বেড়াত একসময়। ট্রামের পাশাপাশি এই দোতলা বাস ছিল সেইসময়ের মহানগরের পরিবহণের একটি প্রতীক। কিন্তু সময়ের স্রোতে এই বাহনগুলি ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেছে। আজও বহু তিলত্তমাবাসী এই বাসের স্মৃতিতে আবেগাপ্লুত হন।
কলকাতায় দোতলা বাসের ইতিহাস শুরু হয় ব্রিটিশ রাজত্বকালে। ১৯২৬ সালে ক্যালকাটা ট্রামওয়েজ কোম্পানি (সিটিসি) প্রথম ডাবল ডেকার বাস চালু করে। যাতায়াতের এই আভিনব ব্যবস্থা দেখে শহরবাসী মুগ্ধ হয়ে যায়। ওয়ালফোর্ড অ্যান্ড কোম্পানির তৈরি এই বাসগুলি লন্ডনের ডাবল ডেকার বাসের মতোই লাল রঙের ছিল। প্রথমে এর চলাচল শুরু হয় উত্তরের শ্যামবাজার থেকে দক্ষিণের কালীঘাট পর্যন্ত। এর আগে ১৯২২ সালে সাধারণ মোটর বাস চালু হলেও দোতলা বাসের আগমন কলকাতাবাসীর কাছে ছিল এক নতুন আকর্ষণ।
আরও পড়ুন - দোতলার ঐতিহ্য গিয়েছিল আগেই, অবশেষে অতিমারী কোপ বসাল বাস চলাচলেই?
প্রথমদিকে, এই বাসগুলির উপরের তলায় ছাদ ছিল না অর্থাৎ ওপেন টপ। গরমের দিনে যাত্রীরা ছাতা মাথায় বসে শহর দেখতেন বাসের দোতলা থেকে। বর্ষায় কালো ছাতার সারি দেখে মনে হতো, ঠিক যেন একটা চলমান ছবি ঘুরে বেড়াচ্ছে শহর জুড়ে। বাসগুলির কাঠামো ছিল কাঠের, তার উপর ধাতুর মোড়ক দিয়ে মোড়া, বড় ড্রপ শাটার জানালা দিয়ে বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা ছিল। একটি বাসে ৫৬ জন যাত্রী চড়তে পারতেন। ঘনবসতিপূর্ণ কলকাতায় এই বাসগুলি ছিল আদর্শ এক পরিবহণ ব্যবস্থা, একই বাসে অনেকজন যাত্রী একসঙ্গে যাত্রা করতে পারত।
স্বাধীনতার পরও এই বাসগুলির জনপ্রিয়তা একইরকম ছিল। স্বাধীনতার পর কলকাতা স্টেট ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশন (সিএসটিসি) এই বাসগুলি চালাত। যাত্রীরা এগুলিকে ভালোবাসতেন। উপরের তলা থেকে শহর দেখার আনন্দ ছিল অসাধারণ। ১৯৪০-৫০ এর দশকে ডিজেল ইঞ্জিনের বাস আসে। ১৯৮০-এর দশকে শহরে ৩৫০-র বেশি ডাবল ডেকার বাস চলত। অশোক লেল্যান্ড এইসময় বাসগুলি তৈরি করত। ব্যারাকপুর, হাওড়া, বেহালা থেকে শহরের কেন্দ্রে বিভিন্ন রুটে তখন যাত্রীদের নিয়ে ঘুরে বেড়াত দোতলা বাস। যাত্রীদের মতে, “কলকাতা দেখার সেরা উপায় ছিল ডাবল ডেকারের উপরের তলা থেকে।”

তিলোত্তমা জুড়ে ঘুরে বেড়াত এই লাল দানবগুলি
কিন্তু ১৯৯০-এর দশক থেকে সমস্যার শুরু হয়। বাসগুলি পুরনো হয়ে যেতে থাকে, আর তাই রক্ষণাবেক্ষণের খরচ বাড়তে থাকে। এই বাসগুলির পার্টসগুলির দাম ছিল তুলনামূলক বেশি, এছাড়া গাড়ি আকারে যত বড়, জ্বালানিও লাগে তত বেশি। যখন বাসগুলি পুরোপুরি ভর্তি হতো না, তখন বাস কর্তৃপক্ষকে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হতো। তাই, আয়ের তুলনায় ব্যয় অনেক বেশি হয়ে উঠছিল। তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার এগুলিকে ‘হোয়াইট এলিফ্যান্ট’ বলে মনে করতে শুরু করে। এছাড়া ট্রাফিক জ্যাম, উচ্চতা বেশি হওয়ায় উঁচু গাছের ডালে আটকে যাওয়া, দূষণ এবং জ্বালানি খরচ ইত্যাদি সমস্যা মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে থাকে। তাই, ধীরে ধীরে বাসের সংখ্যা কমতে থাকে। ২০০৫ সালে দোতলা বাস শেষবারের মতো যাত্রীদের নিজ নিজ গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দেয়। শহরবাসীর কাছে এটি ছিল একটি দুঃখের দিন। নিত্যদিনের যাত্রী পরিবহণে 'শহরের দোতলা বাসে'র যুগ শেষ হয়।
সম্প্রতি ২০২৪ সালে শেষ পুরনো লাল ডাবল ডেকার বাসটিকে উদ্ধার করে সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নেয় রাজ্য সরকার। শেষ পুরনো লাল ডাবল ডেকার বাসটি (১৯৭০-এর দশকের) স্ক্র্যাপে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছিল, কিন্তু 'কলকাতা বাস-ও-পিডিয়া' সংগঠনের উদ্যোগে এবং পরিবহণ মন্ত্রীর হস্তক্ষেপে এটিকে উদ্ধার করা হয়। বর্তমানে পাইকপাড়া ডিপোতে পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়া চলছে এবং এই দোতলা বাসটিকে মিউজিয়ামে সংরক্ষণের পরিকল্পনা রয়েছে।

২০২০ সালে মহানগরে ফিরিয়ে আনা দোতলা বাস
অর্থনৈতিক কারণে প্রতিদিনের নিয়মিত পরিষেবা বন্ধ হলেও, নস্টালজিয়া এবং ঐতিহ্য রক্ষার জন্য এটিকে পুনরায় ফিরিয়ে আনা হয়েছে। ২০২০ সালে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দুটি আধুনিক ওপেন-টপ বা খোলা ছাদের দোতলা বাসের উদ্বোধন করেন। এগুলি নীল-সাদা রঙের, সিসিটিভি, প্যানিক বাটন, অটোমেটিক দরজা যুক্ত। প্রথমে দুর্গাপুজোর প্যান্ডেল হপিংয়ের জন্য চালু হয়, পরে 'কলকাতা কানেক্ট' নামে হেরিটেজ ট্যুরে ব্যবহৃত হচ্ছে—ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, প্রিন্সেপ ঘাট, সেন্ট জনস চার্চের মতো জায়গা ঘুরিয়ে দেখায় এই বাস।
ব্রিটিশ আমলের উত্তরাধিকার থেকে শুরু করে আধুনিক পর্যটনের প্রতীক হয়ে ওঠা— এটি তিলোত্তমার এক শতকের পরিবর্তনের সাক্ষী। আধুনিক সুবিধাযুক্ত আরামের দোতলা বাস চালু হলেও, মহানগরে সেই পুরনো লাল দোতলা বাসের যাত্রা ছিল প্রায় এক শতাব্দীর আবেগ। আজকের প্রজন্মের কাছে সেই কাঠের লাল দোতলা বাস একটি গল্প—কলকাতার গৌরবময় অতীতের। যাকে সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেনের ছবিতে দেখা গেলেও, চাইলেই চড়া যায় না। যারা সেইসময় দেখেছেন মহানগরের রাস্তা, তাদের স্মৃতিতে এখনও জ্বলজ্বল করে সেই পুরনো দিনগুলি, যখন এই লাল দানবগুলি শহরের রাস্তা দাপিয়ে বেড়াত।

Whatsapp
