শরীরে বাসা বেঁধেছিল কোন রোগ? কেন সেদিন থামল কে কে-র হৃদযন্ত্র

মাত্র ৫৩ বছর বয়সেই ইহলোক ছেড়ে চলে যেতে হলো কে কে-কে। তাঁর প্রয়াণে এখনও শোকস্তব্ধ শিল্পীমহল।

সংগীতশিল্পী কে কে-র আকস্মিক মৃত্যুর খবর কলকাতা শহর তো বটেই, দেশবাসীকে অবাক করে দিয়েছিল সেদিন। ৩১ মে নজরুল মঞ্চে অনুষ্ঠান শেষে হোটেলে ফিরতেই সব শেষ হয়ে যায়। ওইদিনের অনুষ্ঠানে মোট ২০টি গান গাওয়ার কথা ছিল সংগীতশিল্পীর, কিন্তু শরীর সঙ্গ দেয়নি তাঁর। ১৯টি গান গেয়েই মঞ্চ ছেড়েছিলেন শিল্পী। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া একাধিক ভিডিওতে দেখা গেছে, অনুষ্ঠান চলাকালীন কী মারাত্মক ঘামছিলেন কেকে।

হোটেলে ফেরার সময়ও অসুস্থ বোধ করছিলেন বলে জানিয়েছেন শিল্পীর গাড়ির চালক। সকাল থেকেই যে শরীরে জোর পাচ্ছিলেন না, সেকথাও জানিয়েছেন তাঁর ম্যানেজারকে। এমনকী, মৃত্যুর আগের দিন, অর্থাৎ ৩০ মে অনুষ্ঠানের আগে স্ত্রীকেও ফোন করে বলেছিলেন যে, তাঁর হাত ও কাঁধে ব্যাথা হচ্ছে। তিনি সুস্থ বোধ করছেন না। পরের দিন নজরুল মঞ্চের অনুষ্ঠান শেষ হয় ৮.৪৫ মিনিট নাগাদ। ৯.১৫ নাগাদ হোটেল পৌঁছে যান তিনি। নিজের ঘরে যাওয়ার জন্য লিফটে উঠতেই মারাত্মক অসুস্থ বোধ করেন তিনি। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, তিনি লিফটের হাতল ধরে মাথা নিচু করে আছে। এরপর ঘরে ঢুকতেই মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন কে কে।

তার মধ্যে অসুস্থতার খবর জানাজানি হতেই হোটেলের পক্ষ থেকে ফোন করে যোগাযোগ করা হয়ে এক চিকিৎসকের সঙ্গে। তাঁর কাছে বিস্তারিত বলার পর দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। হোটেলে অ্যাম্বুল‍্যান্স না থাকায় হোটেলের গাড়িতেই তাঁকে সিএমআরআই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। প্রাথমিকভাবে জানা যায়, হার্ট অ্যাটাকেই মৃত্যু হয়েছিল শিল্পীর। অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলাও দায়ের হয়েছিল নিউ মার্কেট থানায়। তবে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট সামনে আসতেই সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যায়। সংগীতশিল্পী কে কে-র মৃত্যুর পর তাঁর ময়নাতদন্তের জন্য একটি বিশেষ চিকিৎসকদের টিম তৈরি হয়। তাঁদের রিপোর্টে অস্বাভাবিক মৃত্যুর দাবি উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন: ঠিক কী হয়েছিল কে কে-র! কেন অকালে চলে যেতে হল?

প্রশ্ন উঠেছিল, কনসার্টের চরম অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে। শোনা যায়, ভিড়ে ঠাসাঠাসি নজরুল মঞ্চে সেদিন তিলধারণের জায়গাও ছিল না। ২৫০০ দর্শকের স্থানে ৭৫০০ দর্শক ঢুকে পড়েছিল সেদিন হলে। ওই অব্যবস্থার কারণেই গায়কের মৃত্যু হয়েছে।

কী কারণে মৃত্যু হয়েছিল কে কে-র, তা নিয়ে জল্পনা ছিল ভক্তদের ভেতর। শিল্পীর মৃত্যুর পর তাঁর স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত নানা তথ্য উঠে এসেছে সমাজমাধ্যমে। জানা যায়, মুম্বই থেকে কলকাতার অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার আগে স্ত্রী জ্যোতিলক্ষ্মীকে কে কে নাকি বলেছিলেন, শরীরটা ইদানীং ভালো যাচ্ছে না তাঁর। আয়োজকদের কাছ থেকে অগ্রিম নিয়েছেন তাই শেষ মুহূর্তে না করতে পারছেন না তিনি।

কী বলছে কে কে-র ময়নাতদন্তের রিপোর্ট?
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, কে কে-র ময়নাতদন্তের রিপোর্ট বলছে, হাইপক্সিয়ার কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হন শিল্পী। তাঁর হার্টের ৭০% আগে থেকেই ব্লক ছিল। অনুষ্ঠান চলাকালীন, দৌড়ঝাঁপের কারণে সেই ব্লকের পরিমাণ আরও বেড়ে যায়। এ-প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, শরীরে অক্সিজেন কমে যাওয়াকে বলে হাইপক্সিয়া। এই সমস্যার জন্য একাধিক কারণ দায়ী। প্রথমত, দমবন্ধ করা জায়গায় থাকার ফলেও হাইপক্সিয়া হতে পারে।আবার কারও হার্টে ব্লকেজ থাকলে উপসর্গ হিসেবে হাইপক্সিয়া দেখা যেতে পারে। তখন রোগীর বুকে ব্যথা হবে। ফলস্বরূপ, মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশনে আক্রান্ত হন শিল্পী।

রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে যে, কে কে-র হৃদযন্ত্র ফুসফুস থেকে প্রাপ্ত রক্তের পরিমাণ পাম্প করতে পারেনি। ফলে হৃদযন্ত্রের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হয়, যার ফলে এক ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকের কবলে পড়েন কে কে। এই অবস্থাটি কার্ডিওজেনিক পালমোনারি এডিমা নামেও পরিচিত।

তাছাড়া তাঁর হৃদযন্ত্রে হলদে-সাদা রঙের পুরু ফ্যাটের আস্তরণ পাওয়া গেছে। তাঁর হৃদযন্ত্রে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি থাকায় তা ইনট্রামাসকুলার ধমনিকে সংকুচিত করে দিয়েছিল এবং তার জন্যই চাপ পড়েছিল হার্টের ওপর। আর সেই কারণেই শেষ রক্ষা হলো না শিল্পীর। পাশাপাশি কে কে-র শরীরে ১০ রকমের অ্যান্টাসিড, লিভার, ভিটামিন-সি সংক্রান্ত ওষুধ মিলেছে। এর মধ্যে কিছু হোমিওপ্যাথি এবং আয়ুর্বেদিক ওষুধও রয়েছে। অ্যাসিডিটি থেকে আরাম পেতে একাধিক ট্যাবলেট খেয়েছিলেন শিল্পী সেদিন। তাঁর স্ত্রীও পুলিশকে জানিয়েছেন, হজমের সমস্যা ছিল ভেবে প্রচুর অ্যান্টাসিড খেতেন কে কে। অবহেলা না করে সঠিক সময় চিকিৎসকের পরামর্শ নিলে হয়তো আজ আমাদের মধ্যেই থাকতেন শিল্পী। মাত্র ৫৩ বছর বয়সেই ইহলোক ছেড়ে চলে যেতে হলো কে কে-কে। তাঁর প্রয়াণে এখনও শোকস্তব্ধ শিল্পীমহল।

 

More Articles