FOMO থেকে FOFO! জেন-জিদের চার ‘ভয়’ ঠিক কী?

Gen Z fears: FOMO মূলত Gen Z প্রজন্মের সাথে যুক্ত হলেও FOFO সমস্ত প্রজন্মের মধ্যে দেখা যায়। স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে অর্থ, সম্পর্ক এবং ব্যক্তিগত উন্নয়নের মতো জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রেই ছড়িয়ে পড়েছে এই ভয়।

স্মার্টফোনে চোখ রেখে সোশ্যাল মিডিয়া সাইটে স্ক্রোল করতে করতে দেখছেন, বন্ধুরা হ্যাশট্যাগ দিচ্ছে— কাপল গোল, প্রি ওয়েডিং শ্যুট, কেউ চাকরি পেয়েছে, কেউ ইউরোপ ট্যুরে গিয়েছে, কেউ আবার ইনফ্লুয়েন্সার হয়ে উঠেছে চোখের নাগালেই। আপনার মনে হলো আমি কি তবে সবার থেকে পিছিয়ে পড়ছি?  হঠাৎ একটা চাপা ভয়, অস্বস্তি হতে শুরু করে। এই অনুভূতির নাম FOMO।

বিগত এক দশকে বিশেষ করে কোভিডের পর থেকেই FOMO (Fear of Missing Out) শব্দটি 'selfie' আর 'lol'-এর মতোই গ্লোবাল ডিকশনারির অংশ। যেখানে একজন ব্যক্তি এই ধারণায় বাঁচেন যে ‘অন্যেরা বুঝি আমার চেয়ে জীবনটা বেশি উপভোগ করছে’, ‘যত সমস্যা কি আমার?’ বা ‘আমার চেয়ে আরও ভালো জীবনযাপন করছে ওরা’। এই ভয়ের নাম ‘হারিয়ে যাওয়ার ভয়’। এমন একটি উদ্বেগজনক অনুভূতি যেখানে মনে হয় যে, অন্য সবাই আমাকে ছাড়া জীবনে নানা দিকে এগিয়ে যাচ্ছে শুধু আমিই এই ‘সব পেয়েছির’ দৌড়ে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছি।

তবে, ইদানিং ইন্টারনেটে আলোচনায় এসেছে আরেকটি নতুন লব্জ FOFO (Fear of Finding Out)। ধরুন, আপনি অসুস্থ বোধ করছেন তবু ডাক্তারের পরামর্শ নিতে যাচ্ছেন না এই ভেবে, যদি বড়সড় কোনো অসুখ বাঁধে, তখন কী হবে? স্টক মার্কেটে বিনিয়োগের আগে অনেকে বিশেষ গাইডলাইন গুলি ইচ্ছে করেই যাচাই করে না। কেন? বিনিয়োগের আগে উদ্বেগ যাতে না হয়। একজন ব্যক্তি তার সঙ্গীর সাথে সম্পর্কের সমস্যাগুলি নিয়ে আলোচনা করতে ভয় পায়, যদি সেই আলোচনা তাদের বিচ্ছেদের দিকে নিয়ে যায়, তখন কী হবে, এই ভেবে। এই ভয়ের নাম FOFO অর্থাৎ ‘জানার ভয়’ বা ‘সত্য জানার ভয়ে সত্য থেকেই বিরত থাকা’। এই আচরণকে অনেক সময় 'Ostrich Effect' বলা হয়।

উটপাখি বিপদ দেখলে যে ভাবে বালির ভেতর মাথা লুকিয়ে রাখে, সেই পৌরাণিক কাহিনি থেকে এই শব্দবন্ধটি এসেছে। যদিও এই ভয় ওই ব্যক্তির মনে সাময়িক স্বস্তি দেয় কিন্তু সমস্যার সমাধান দেয় না। ব্যক্তি ভয় পায় যে সত্য জানলে তাকে হয়ত বড় সিদ্ধান্ত নিতে হবে, মোকাবিলা করতে হবে অথবা কঠিন পরিস্থিতির দায়িত্ব নিয়ে নিজের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনতে হবে। এই দায়িত্ব এড়িয়ে যেতেই সে তথ্যকে এড়িয়ে যায়। অর্থাৎ FOFO পরিবর্তনের প্রতি একটি তীব্র প্রতিরোধ হিসেবে কাজ করে।

আরও পড়ুন

মদের চেয়েও ক্ষতিকর রিলস! নেশায় বুঁদ ‘জেন-জি’র কমছে ধৈর্য, বাড়ছে অবসাদ

FOFO বাস্তব জীবনে সুদূরপ্রসারী ও ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলে, যার একটি বিশেষ ক্ষেত্র হলো স্বাস্থ্য। ২০১৭ সালের NORC এবং West Health Institute-এর একটি জাতীয় সমীক্ষায় দেখা যায়, প্রায় ৪০% আমেরিকান স্বাস্থ্য খরচের কারণে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পরীক্ষা বা চিকিৎসা পদ্ধতি এড়িয়ে গেছেন। ৩৩% মানুষ গুরুতর অসুস্থতাকে ভয় পান। এই সমীক্ষা থেকে বোঝা যায় এক্ষেত্রে FOFO-এর কেন্দ্রবিন্দু রোগ নয় বরং রোগটি কতটা গুরুতর ও কত খরচ সাপেক্ষ সেই ভয়ে মানুষ চিকিৎসা এড়িয়ে গেছেন।

FOMO মূলত Gen Z প্রজন্মের সাথে যুক্ত হলেও FOFO সমস্ত প্রজন্মের মধ্যে দেখা যায়। স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে অর্থ, সম্পর্ক এবং ব্যক্তিগত উন্নয়নের মতো জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রেই ছড়িয়ে পড়েছে এই ভয়। আমাদের মস্তিষ্ক ভয় পেয়ে সঠিক তথ্য এড়িয়ে যাওয়ার কাজটিকে পুরস্কার হিসেবে গণ্য করে, সাময়িক শান্তি পায়। যার ফলস্বরূপ ব্যক্তিটি সেই একই আচরণ পুনরাবৃত্তি করতে থাকে। ফলে সমস্যা হয় দীর্ঘমেয়াদি।

তবে FOFO একা আসে না সাথে নিয়ে আসে FOBO (Fear of Better Options) অর্থাৎ ‘প্রাচুর্যের বিড়ম্বনা’। এমন একটি পরিস্থিতি যেখানে অনেকগুলি বিকল্প থাকা সত্ত্বেও শ্রেষ্ঠ বিকল্পের খোঁজে ব্যক্তি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। FOBO হলো আরও ভালো বিকল্প বা সুযোগ পাওয়ার ভয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অক্ষমতা। মনোবিজ্ঞানী ব্যারি শোয়ার্টজ তার 'Paradox of Choice' তত্ত্বে দেখিয়েছেন যে পছন্দের স্বাধীনতা আসলে আশঙ্কা সৃষ্টি করে। আজকের সীমাহীন বিকল্পের পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠটি বেছে নেওয়া কঠিন এবং শেষে আর কিছুই করা হয়ে ওঠে না। FOBO-তে আক্রান্ত ব্যক্তিরা তাদের পছন্দের সিদ্ধান্তটি নেওয়ার পরও অতীতের পছন্দ নিয়ে অনুশোচনায় ভোগেন। তবে FOBO-কে কেবল সিদ্ধান্তহীনতা হিসেবে দেখলে এর গভীরতা বোঝা যায় না। এটি একধরনের Existential crisis-এর বহিঃপ্রকাশ। আমাদের প্রতিটি পছন্দ আত্ম-পরিচয়ের প্রকাশ এবং একই সাথে বাকি অন্যান্য সব বিকল্প বাতিল করে। যদি কেউ সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করে তবে তা ব্যক্তিপরিচয়কেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়, তাই সেই ভয়ে সিদ্ধান্ত এড়িয়ে যাওয়াই তার কাছে সহজ মনে হয়।

“পেছনে লোকে কিছু বলবে” এই ভয়ের নাম হলো FOPO (Fear of Other People’s Opinions)। অন্যেরা কী ভাববে সেই ভয়ে মানুষ পুরনো চাকরি ছাড়তে ভয় পায়, নিজের ব্যবসা শুরু করতে ভয় পায়, পুরনো সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে ভয় পায়, নিজের সমস্যার কথা জানাতে ভয় পায়। FOPO সাধারণত নিজের অপছন্দের কাজ, অস্বাস্থ্যকর সম্পর্কে আটকে থাকতে বাধ্য করে কারণ জীবনে পরিবর্তন আনলে অন্যরা কী ভাববে সেই অমূলক ভয় গ্রাস করে তখন। এক জনমতের কারাগারে নিজেকে বন্দি করে নেয় ব্যক্তি। এই ভয়ের উৎস হলো দুর্বল আত্ম-মূল্যবোধ যেখানে ব্যক্তি মনে করে যে সমাজের নির্দিষ্ট মানদণ্ড বা স্ট্যাটাস পূরণ না করলে সে সমাজে বসবাস করার যোগ্য নয় ।

FOBO, FOPO এবং FOFO-এর ফলস্বরূপ জন্ম নেয় কাজ করার ভয় বা নির্দিষ্ট কাজে পদক্ষেপ নেওয়ার ভয় যার নাম FOMU (Fear of Messing Up)। ভুল করে ফেলার তীব্র ভয় মানুষকে কোনো একটি বিষয় নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা করতে ও বিশ্লেষণ করতে বাধ্য করে। কিন্তু এই অতিরিক্ত বিশ্লেষণ করেও যখন বিষয়টি পারফেক্ট মনে হয় না তখন কাজটি আর শুরু করাই হয় না। অনেক বিকল্প একসাথে থাকলে 'Analysis Paralysis' শুরু হয়। পারফেকশনিস্ট হতে গিয়ে অতিরিক্ত বিশ্লেষণের কারণে মস্তিষ্কের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা হ্রাস পায় ফলে শেষ পর্যন্ত কাজটি আর করে ওঠা হয় না। আর এই চূড়ান্ত অচলাবস্থা হলো FODA (Fear of Doing Anything)। ভুল সিদ্ধান্তের ভয় (FOMU) এবং অসংখ্য বিকল্পের চাপ (FOBO) যখন একত্রিত হয়, তখন ব্যক্তি সিদ্ধান্ত এড়িয়ে চলার ও কাজটি না করার পথ বেছে নেয়।

আরেকটি অনুভূতি হলো FOSO (Fear of Starting Over) অর্থাৎ নতুন করে শুরু করার ভয় বা পরিবর্তনের প্রতি ভয়। মানব মস্তিষ্ক জন্মগতভাবে ঝুঁকি-বিমুখ। নতুন পরিস্থিতিতে মস্তিস্ক 'ফাইট অথবা ফ্লাইট' প্রতিক্রিয়া ট্রিগার করে। কর্মজীবনের পরিবর্তন বা নতুন চাকরিতে প্রবেশের সময় এই ভয় বিশেষভাবে দেখা যায়, যেখানে ব্যক্তির মনে প্রশ্ন জাগে, 'আমি কি যথেষ্ট ভালো?', 'যদি আমি কাজটি করতে ব্যর্থ হই?' বা ‘ওরা বোধ হয় আমার চেয়ে ভালো করছে’। এই ভয়কে অনেকসময় ইমপোস্টার সিন্ড্রোম ও বলা হয়, যেখানে একজন দক্ষ ব্যক্তিও নিজেকে অপেশাদার মনে করে এবং ব্যর্থ হওয়ার ভয় পান। এই ভয় কাটিয়ে উঠতে না পারার কারণে ওই ব্যক্তি স্ট্রেস, আংসাইটি ও ক্লান্তিকর পরিস্থিতিতে আটকে থাকেন।

আরও পড়ুন

জেন জি লব্জ ‘ঘোস্টিং’; কখন কেন কীভাবে ঘোস্টিং করা হয়?

আজকের দিনে একাকীত্ব একটি বড় ভয়, যে অনুভূতি হলো FOBA (Fear of Being Alone) অর্থাৎ একা থাকার ভয়। এই ভয় বেশিরভাগ সময় ব্যক্তিকে একটি অস্বাস্থ্যকর সম্পর্কে টিকে থাকতে বাধ্য করে। শৈশবের ট্রমা, অযত্ন বা পরিত্যাগ হওয়ার পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে এই ভয়ের জন্ম হতে পারে। FOBA একজনকে কোনো রকম ভাবনা চিন্তা না করেই ‘রেড ফ্ল্যাগ’ এর উপেক্ষা করে দ্রুত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য করে। একটি কাল্পনিক ধারণা নিয়ে সে ভুল সম্পর্ক আঁকড়ে ধরে বাঁচতে বাধ্য হয়। FOBA-তে আক্রান্ত ব্যক্তিরা একা থাকলেই মারাত্মক ডিপ্রেশন ও আশঙ্কাতে ভোগেন। দেখা গিয়েছে তারা ভিড়ের মাঝেও একা অনুভব করে। এই ভয় নিরাময় না হলে ডিপ্রেশন, আত্মহত্যার প্রবণতা, PTSD- এর ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।

FOFO হলো এই সমস্ত ভয়ের নীরব চালক। বর্তমান প্রজন্ম সবচেয়ে বেশি এই ভয়ের শিকার। তবে এই ভয়গুলি থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রথম পদক্ষেপ হলো তথ্যকে শক্তি হিসেবে মেনে নেওয়া। তথ্য-বিমুখতা বা Ostrich Effect কাটিয়ে উঠতে সচেতন ভাবে কাজ করতে হবে, সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সেক্ষেত্রে সত্যই হলো শেষ কথা। সঠিক তথ্যই আসলে সঠিক বিকল্প বেছে নিতে সাহায্য করে। কাজের ক্ষেত্রে নেওয়া কোনো সিদ্ধান্তকে চূড়ান্ত হিসেবে না দেখে, সেটিকে জীবনের একটি পরীক্ষা হিসেবে নিলে সেক্ষেত্রে ব্যর্থতা এলেও, শেখার সুযোগ থেকেই যাবে, ক্ষতি হবে না— এই দৃষ্টিভঙ্গি ইমপোস্টার সিন্ড্রোম কমাতেও সাহায্য করে।
অন্যের মতামতের উপর মনোযোগ না দিয়ে নিজের জীবনের উদ্দেশ্য ও নিজের ক্ষমতার দিকে নজর দেওয়া উচিত। এছাড়াও, নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে শিখতে হবে, সচেতন ভাবে। এইজন্য মনোবিজ্ঞানীরা পরামর্শ দেন যে পর্যাপ্ত ঘুম, নিয়মিত ব্যায়াম এবং সুষম খাদ্য এই তিনটি বিষয় ঠিক থাকলে আমরা মানসিক ভাবে সুস্থ ও সতেজ থাকব। তবে কোনো ক্ষেত্রে যদি ডিপ্রেশন বেড়ে যায় বা আত্মহত্যার প্রবণতা তৈরী হয় তখন অবশ্যই একজন অভিজ্ঞ মনোবিদের সাহায্য নিতে হবে।

চূড়ান্ত সত্য হলো, বর্তমানে তথ্যই হলো শক্তি, তা যতই ভয়ের হোক না কেন। FOFO ব্যক্তিকে সাময়িক স্বস্তি দিতে পারে। কিন্তু তথ্য দেয় সচেতনতা যা জীবনের নানা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে, কার্যকরভাবে সিদ্ধান্ত নিতে এবং ব্যক্তিগত উন্নতির চাবিকাঠি।

More Articles