একের পর এক আত্মহত্যা টলিউডে, ২০২২-এর মে মাস যেন এখনও বিভীষিকা

Year Ender 2022 : এক মাসের মধ্যেই টলিউড হারিয়ে ফেলে চারজন নতুন মুখকে। এদের মধ্যে কেউ তখন জনপ্রিয় ডেলি সোপের কেন্দ্রীয় মুখ, কেউ আবার সোশ্যাল মিডিয়ার জনপ্রিয় মডেল।

পথ শেষের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ২০২২। এখন কেবল সুতো গোটানোর পালা। বিগত একটা বছর ধরে শিল্প, সাহিত্য, চলচ্চিত্র, রাজনীতি অথবা টেকনলজি সব বিষয়ে ঘটেছে বহু পালা বদল। কোথাও আমরা চিরতরে হারিয়েছি পুরনোকে কোথাও আবার পছন্দের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে একগুচ্ছ নতুন কিছু। ঠিক ভুল, প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি, সব মিলিয়েই ভাঁড়ার ভরেছে। সেটা ভাঙলেই শুরু হয় ফিরে দেখা। যেন কোনও একটা স্লাইড শো, পরের পর ঘটনাগুলো সাজানো রয়েছে সেখানে। যার কিছু হয়তো খুব ভালো, আমাদের মনে করিয়ে দেয় সুখ স্মৃতি, কিছু আবার টেনে নিয়ে যায় বিষম বিষাদে। কিন্তু এ সব নিয়েই তো একটা গোটা বছর। ভালো খারাপ, ঠিক ভুলের একটা মিশেল।

বছরভর অজস্র মৃত্যুর সাক্ষী থেকেছে গোটা দেশ। বাংলাও তার ব্যতিক্রম নয়। স্বাভাবিক মৃত্যুর পাশাপাশি অস্বাভাবিক মৃত্যুর জেরও কিছু কম নেই ফিরে দেখার তালিকায়। বছরের শুরুতেই পরপর শিল্পী মৃত্যুর ঘটনায় দোলাচল শুরু হয়েছিল টলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে। তাই বলে প্রাপ্তি কি কিছুই নেই? নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু প্রচুর ভালো ছবি, নতুন কাজের পাশাপাশি রয়েছে বিষাদ কথন। টলিউড ইন্ডাস্ট্রির স্বাভাবিক ছন্দ বারবার পতন ঘটিয়েছে ২০২২ সাল।

২০২২ সালের মে মাস। করোনার ধাক্কা কাটিয়ে স্বাভাবিক ছন্দে তখন টলিউড। নিউ নর্মালের নিয়ম কানুনও বেশ সিঁধিয়ে গিয়েছে ততদিনে। বন্ধ থাকা শুটিং ফ্লোরে নিয়মিত যাতায়াত শুরু হয়েছে কলাকুশলীদের। এরকম সময়ে নেমে আসে পরপর বিপর্যয়। একের পর এক অভিনেত্রী এবং মডেলের চাঞ্চল্যকর আত্মহত্যার ঘটনা যেন নিজেদের বদলে যেন স্বাভাবিক ছন্দ। সংক্রামক ব্যাধির মতো হানা দে আত্মহত্যা। একটা ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই পরবর্তী ঘটনার ঘনঘটা। প্রতিটা ঘটনাতেই উঠে আসে চেনা ছক। ত্রিকোণ প্রেমের উপস্থিতি, জালিয়াতি ইত্যাদি। এক মাসের মধ্যেই টলিউড হারিয়ে ফেলে চারজন নতুন মুখকে। এদের মধ্যে কেউ তখন জনপ্রিয় ডেলি সোপের কেন্দ্রীয় মুখ, কেউ আবার সোশ্যাল মিডিয়ার জনপ্রিয় মডেল। প্রত্যেকেই প্রতিষ্ঠিত। অথচ অলৌকিক ভাবে মারা গেলেন সুইসাইডে।

আরও পড়ুন - অপরাজিত, বেলাশুরু থেকে বল্লভপুরের রূপকথা, বাংলা ছবির দর্শককে কতটা হলমুখী করল ২০২২

পল্লবী দে - ১৫ মে ২০২২। দক্ষিণ কলকাতার গড়ফার ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার হয় অভিনেত্রী পল্লবী দে-র মৃতদেহ।পুলিশ সূত্রে প্রাথমিক ভেবে জানা যায়, আত্মহত্যা করেছেন পল্লবী দে। যদিও সে নিয়ে বিতর্কের জল অনেক দূর গড়ায়। এমন আকস্মিক মৃত্যুর ঘটনায় ভেঙে পড়েন গোটা টলিউড ইন্ডাস্ট্রি। সকলেই বলেন, পল্লবীর এই মৃত্যু স্বাভাবিক আত্মহত্যা হতে পারে না, কোনও রকম আগাম আঁচ কেউই পায়নি বলেই জানান। তাহলে কী এমন ঘটল রাতারাতি যে মাত্র ২৫ বছর বয়সে আত্মহত্যা বেছে নিতে হয় পল্লবীকে।তদন্তে উঠে আসে পল্লবী দের লাইভ ইন পার্টনার সাগ্নিকের নাম। পল্লবীর পরিবার এবং কাছের বন্ধুদের অনেকেই এই ঘটনায় দায়ী করেন সাগ্নিককে। বহুমূল্য ফ্ল্যাট, অডি গাড়ি, বিলাসবহুল জীবনযাপন এসবের নেপথ্যে কোন কোন অসঙ্গতি এত কম বয়সে এই পরিণতি ডেকে আনলো তা অবশ্য আজও অধরা।

বিদিশা দে মজুমদার - পল্লবীর মৃত্যুর জট তখনও ছাড়েনি। মাত্র ১০ দিনের মাথায় আবার মর্মান্তিক খবর আসে টলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে। ফের আত্মহত্যায় মৃত্যু হয় টেলি অভিনেত্রী বিদিশা দে মজুমদারের। ২৫ মে দমদমের নাগেরবাজারের ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার হয় বিদিশার দেহ। রামগড় কলোনির একটি ভাড়া বাড়িতে থাকতেন ২১ বছর বয়সী বিদিশা। সূত্রের খবর, ১০ দিন আগে বন্ধু পল্লবীর আকস্মিক মৃত্যুতে তিনি নাকি খুবই ভেঙে পড়েছিলেন। কিন্তু তিনিও যে এই একই পথে হাঁটতে চলেছেন তা ঘুণাক্ষরেও আঁচ করতে পারেননি অভিনেত্রীর মা। তবে কেন মাত্র ১০ দিনের মাথায় একই ধাঁচে আত্মহত্যা করতে হল তাঁকেও? এই প্রশ্নের জবাব দেওয়ার মানুষটা অবশ্য আর নেই।

মঞ্জুষা নিয়োগী - এর পরের মৃত্যুটা ঠিক ২ দিনের মাথায়। এবারের ঘটনাস্থল পাটুলি। টলিউডের উঠতি মডেল মঞ্জুষা নিয়োগীও মারা গেলেন একই ভাবে, আত্মহত্যায়। নিজের বাড়িতেই আত্মহত্যা করেন এই মডেল। পুলিশ এসে দেহ উদ্ধার করে। উচ্চাকাঙ্ক্ষা, বিলাসবহুল হাতছানি, লাগামছাড়া জীবন এসবই ডেকে এনেছে বিপদ এমনটাই জানিয়েছেন মঞ্জুষার মা।

আরও পড়ুন - বাংলার ভাঁড়ার শূন্য, ২০২২ সালের জিআই ট্যাগ পেয়েছে এই সব রাজ্যের বিখ্যাত যে খাবারগুলি

সরস্বতী দাস - মঞ্জুষার মৃত্যুর আবারও দুই দিনের মাথায় অর্থাৎ ২০২২ সালের ২৯ মে আরও এক উঠতি মডেল ১৮ বছর বয়সী সরস্বতী দাসের আত্মহত্যার খবর আসে। কসবায় মামারবাড়িতে সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলে আত্মঘাতী হন সরস্বতী।

একই মাসে পরপর চারটি ঘটনা। প্রতি ক্ষেত্রেই আত্মহত্যার ছক। নেপথ্যে কোনও না কোনও লাগামছাড়া জীবনের ছবি। এবং প্রতিটি ঘটনাই ঘটছে একটি চেনা গণ্ডির মধ্যে। সিরিয়াল কিলিং নয় ঠিকই তবে এমন সিরিয়াল মেনে আত্মহত্যার কীই বা কারণ হতে পারে তা তো ভাবাতে বাধ্য! এটা প্রত্যেকেই একে অপরকে কম বেশি চিনতেন। তবুও কেন চেনা মানুষের জীবনের পরিণতি দেখে সাবধান হলেন না কেউ? কেনোই বা মনে হল অন্য জনের পথটাই একমাত্র পথ? উত্তর মেলানো সহজ নয়। বর্তমানে আরও আরও ওপরে ওঠার নেশা এমনভেবেই গেঁড়ে বসেছে একটা শ্রেণীর মধ্যে যার জন্য সহজ রাস্তা খুঁজতে ঝুঁকিও নিতে হচ্ছে তাদের। তবে কি একটা সময় সেই ঝুঁকির মাত্রা এতটাই হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে যে সামাল দিতে না পেরেই আত্মহত্যাকে একমাত্র পথ ভেবে বসেছেন তাঁরা? নাকি এই যান্ত্রিক জীবনের ইঁদুর দৌড়ে মানসিক অবসাদ এতটাই গ্রাস করেছে প্রজন্মকে যার জেরেই পরপর আত্মহত্যার ঘটনা সামনে এসেছে? এইসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর হয়তো দিতে পারবে সময়ই আর খানিকটা দিতে পারবেন মনোবিদরা। কিন্তু ২০২২ সালের প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির হিসেবে দাগ কেটে যাবেই গোটা মে মাস।

More Articles