হুতোম প্যাঁচার নকশা: নগরদর্পণ, সেকালে একালেও
Hutom Panchar Naksha: তবে পুরনো বাবু কালচারে অভ্যস্ত বাঙালি কি বদলায়নি? বদলেছে তো বটেই; আর সেই বদল হুতোমেরও দৃষ্টি এড়ায়নি।
'বীরবল' প্রমথ চৌধুরী যে-বই সম্পর্কে লিখেছেন,
"... যাঁরা এ পুস্তক পড়েননি, তাঁদের তা পড়তে অনুরোধ করি"
সেই 'হুতোম প্যাঁচার নকশা' ১৬১ বছর অতিক্রম করে আজও সমান প্রাসঙ্গিক। বইটির প্রথম ভাগ ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দের শেষার্ধে প্রকাশিত হয়; আর ১৮৬৪ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম ও দ্বিতীয়— দুই ভাগ 'হুতোম'-এর ১ম সংস্করণ। 'হুতোম' ছদ্মনামে কলকাতার ধনী জমিদার বংশের সন্তান কালীপ্রসন্ন সিংহ যখন এই গ্রন্থ প্রণয়ন করছেন তখন তিনি মাত্র বছর বাইশের যুবক। এই নকশা রচনায় 'হুতোমের কি অভিপ্রায় ছিল', সে সম্পর্কে ১৭৮৪ শকাব্দে এই গ্রন্থের 'ভূমিকা উপলক্ষ্যে একটা কথা'য় তিনি নিজেই লিখছেন,
"কি অভিপ্রায়ে এই নকশা প্রচারিত হলো, নকশাখানির দু'পাত দেখলেই সহৃদয় মাত্রেই অনুভব কত্তে সমর্থ হবেন, কারণ এই নকশায় একটি কথা অলীক বা অমূলক ব্যবহার করা হয় নাই---"।
'হুতোম প্যাঁচার নকশা'য় সেকালের নাগরিক সমাজের নিখুঁত ছবি আঁকা রয়েছে। দেড় শতাধিক বছর আগের কলকাতার ধনী মধ্যবিত্ত ও সাধারণ হুজুকে মানুষের বিলাস-ব্যসন-নষ্টামি-আমোদ-উৎসবের ফোটোগ্রাফিক বর্ণনা কলকাতার চলতি বুলিতে (Calcutta cockney) যেভাবে উঠে এসেছে তা অনাস্বাদিতপূর্ব এবং অভিনব। হুতোমের নিজের ভাষায়,
"হুতোমের নকশা বঙ্গসাহিত্যের নূতন গহনা, ও সমাজের পক্ষে নূতন হেঁয়ালি; যদি ভাল করে চকে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া না হয়, তা হলে সাধারণে এর মর্ম বহন কত্তে পাত্তেন না ও হুতোমের উদ্দেশ্য বিফল হতো।"
আরও পডুন
‘নারী’ চরিত্রে অভিনয় থেকে ‘মহাভারত’-এর তর্জমা, বাঙালির হুতোম প্যাঁচা কালীপ্রসন্ন সিংহের অচেনা জীবন
কিন্তু তৎকালীন 'অলীক কুনাট্য রঙ্গে' মজে থাকা শহুরে বঙ্গসমাজের লিপিচিত্র হয়েও 'হুতোম' কোনো এক জাদুবলে অধুনা নগরঘেঁষা বঙ্গজীবনেরও ধারাবিবরণী হয়ে উঠেছে। এই অভিনবত্বের কারণেই 'হুতোম প্যাঁচার নকশা' বর্তমানে প্রাসঙ্গিক তো বটেই, বরং তা আরও গভীর অভিনিবেশও দাবী করে। 'কলিকাতার চড়কপার্ব্বণ' অধ্যায়ে হুতোম লিখছেন,
"আজকাল সহরের ইংরাজী কেতার বাবুরা দুটি দল হয়েছেন,... প্রথম দলের সকলি ইংরাজি কেতা, টেবিল চেয়ারের মজলিশ, পেয়ালা করা চা, চুরট, জগে করা জল, ডিকান্টরে ব্রান্ডী... পোলিটিক্স ও বেস্ট নিডস অব দ্য ডে নিয়ে সর্ব্বদা আন্দোলন। টেবিলে খান, কমোডে হাগেন এবং কাগজে পোঁদ পোঁচেন,...
দ্বিতীয়ের মধ্যে... সাপ হতেও ভয়ানক, বাঘের চেয়ে হিংস্র; বলতে গেলে এঁরা একরকম ভয়ানক জানোয়ার, চোরেরা যেমন চুরি কত্তে গেলে মদ ঠোঁটে দিয়ে গন্ধ করে মাতাল সেজে যায়, এঁরা সেইরূপ কেবল স্বার্থ সাধনার্থ স্বদেশের ভাল চেষ্টা করেন। 'ক্যামন করে আপনি বড়লোক হব', 'ক্যামন করে সকলে পায়ের নীচে থাকবে' এই এঁদের নিয়ত চেষ্টা--- পরের মাথায় কাঁটাল ভেঙ্গে আপনার গোঁপে তেল দেওয়াই এঁদের পলিসী,..."
আজকের শহুরে বাঙালি এই নকশার আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পেলে সেটা খুব স্বাভাবিক বলে মনে হয় না কি! অধুনা বঙ্গজীবনের মূল প্রতিপাদ্য উৎসব এবং সেই বর্ষব্যাপী উৎসবকে কেন্দ্র করে আমোদ। আর দুর্গোৎসব তো আগে-পরে বেড়েই চলেছে! সেই কত আগে হুতোম লিখছেন,
"কলকেতা সহরের আমোদ শিগগির ফুরায় না, বারোইয়ারি পূজোর প্রতিমা পূজো শেষ হলেও বারো দিন ফ্যালা হয় না।"
হুতোম যদি আজকে দাঁড়িয়েও লিখতেন, এর থেকে বেশি আর কী লিখতেন? গ্রন্থের দ্বিতীয় ভাগে 'দুর্গোৎসব' অধ্যায়ে হুতোম লিখছেন,
"ক্রমে সহরের বড় রাস্তা চৌমাথা লোকারণ্য হয়ে উঠলো,... ইংরাজি বাজনা, নিশেন, তুরুকসোয়ার ও সার্জ্জন সঙ্গে প্রতিমারা রাস্তায় বাহার দিয়ে বেড়াতে লাগলেন--- তখন 'কার প্রতিমা উত্তম' 'কার সাজ ভাল' 'কার সরঞ্জাম সরেস' প্রভৃতির প্রশংসারই প্রয়োজন হচ্চে, কিন্তু হায়! 'কার ভক্তি সরেস' কেউ সে বিষয়ে অনুসন্ধান করে না--- কর্ম্মকর্ত্তাও তার জন্য বড় কেয়ার করেন না।"
দুর্গোৎসবের এই বর্ণনা ও শহর কলকাতার ভক্তিরহিত আড়ম্বরপ্রিয়তা তো আজকেরও ছবি। নাগরিক বঙ্গজীবনের নতুন ট্রেন্ড বার্থডে সেলিব্রেশন। আপামর শহুরে বঙ্গবাসী আজ বার্থডে সেলিব্রেশনে নিজেদের আকণ্ঠ নিমজ্জিত করতে পছন্দ করেন। দেখা যাক হুতোম কী বলছেন?
"... আজ কাল সহরের কেউ কেউ জন্মতিথিতে বেতরগোছের আমোদ করে থাকেন। কেউ ষেটের কোলে ষাট বৎসরে পদার্পণ করে আপনার জন্মতিথির দিন গ্যাসের আলোর গেট, নাচ ও ইংরেজদের খানা দিয়ে চোহেলের একশেষ করেন; অভিপ্রায় আপনারা আশীর্ব্বাদ করুন, তিনি আর ষাট বছর এমনি করে আমোদ কত্তে থাকুন, চুলে ও গোঁপে কলপ দিয়ে জরির জামা ও হীরের কণ্ঠি পরে নাচ দেখতে বসুন,..."
মাতাল, মাতলামি, নেশা যে কোনো শহরের অভিজ্ঞান। সেখানেও দেখা যায় হুতোমের বর্ণনায় কোথায় সেকাল আর একাল এসে মিশে গেছে, তারা একই ঘাটে জল থুড়ি মদ খাচ্ছে।
"সহরের ইতর মাতালদের ঘরে ধরে রাখবার লোক নাই বলেই আমরা নর্দ্দামায়, রাস্তায়, খানায়, গারদে ও মদের দোকানে মাতলামি কত্তে দেখতে পাই। সহরে বড় মানুষ মাতালও কম নাই, সুদ্ধ ঘরে ধরে পুরে রাখবার লোক আছে বলেই তাঁরা বেরিয়ে মাতলামি কত্তে পান না। এঁদের মধ্যে অনেকে এমন মাতলামি করে থাকেন যে, অন্তরীক্ষ থেকে দেখলে পেটের ভেতর হাত পা সেঁধিয়ে যায় ও বাঙ্গালি বড়মানুষদের উপর বিজাতীয় ঘৃণা উপস্থিত হয়। ছোটলোক মাতালের ভাগ্যে— চারি আনা জরিমানা,— এক রাত্তির গারদে বাস— পাহারাওলাদের ঝোলায় শোয়ার হয়ে যাওয়া ও জমাদারের দুই এক কোঁৎকা মাত্র, কিন্তু বাঙ্গালি বড়মানুষ মাতালদের সকল বিষয়ে শ্রেষ্ঠ। পাকি হয়ে উড়তে গিয়ে ছাত থেকে পড়ে মরা— বাবার প্রতিষ্ঠিত পুকুরে ডোবা, প্রতিমার নকল সিংগি ভেঙ্গে ফেলে আসল সিংগি হয়ে বসা, ঢাকীরে মার সঙ্গে বিসর্জন দেওয়া, ক্যান্টনমেন্ট ফোর্ট, রেলওয়ে এষ্টেশন্ ও অকসনে মদ খেয়ে মাতলামি করে চালান হওয়া।"
"... কলকাতা সহরে প্রতিদিন নতুন নতুন মাতলামি দেখা যায়; সকলগুলি সৃষ্টিছাড়া ও অদ্ভুত!... সহরের বাঙ্গালি বড় মানুষের ছেলেদের মধ্যে প্রায় অনেকে বিবেচনায় গাধার বেহদ্দ ও বুদ্ধি এমন সূক্ষ্ম যে, নেই বল্লেও বলা যায়, লেখাপড়া শিখতে আদবে ইচ্ছা নাই, প্রাণ কেবল ইয়ারকির দিকে দৌড়োয়, স্কুল যাওয়া কেবল বাপ মার ভয়ে ওষুদগেলাগোছ!... দনু বাবুর দু চার স্কুলফ্রেন্ড সর্ব্বদা আসতেন
যেতেন, কখন কখন লুকিয়ে চুরিয়ে--- চরসটা, মাজমের বরপীখানা, সিদ্ধিটে আসটাও চলতো; ইচ্ছেখানা, এক আধ দিন শেরিটে, শ্যামপিনটারও আস্বাদ নেওয়া হয়,..."।

'হুতোম প্যাঁচার নকশা'র প্রচ্ছদ
তা সেই দনুবাবু এবং তাঁর বন্ধুরা একদিন মদমত্ত অবস্থায় বেলেল্লাপনার চূড়ান্তসীমায় পৌঁছলে দনুবাবুর বাবা দনুবাবুকে যাচ্ছেতাই গালিগালাজ করতে শুরু করলেন। এতে দনুবাবুর "এক জন ফ্রেন্ড বড়ই চটে উঠলেন ও দনু তাঁর সঙ্গে তেড়ে গিয়ে কর্ত্তাকে একটা ঘুসি মাল্লেন। কর্ত্তার বয়স অধিক হয়েছিল,... ঘুষি খেয়ে একেবারে ঘুরে পড়লেন।" তখন দনুবাবুর করুণা উপস্থিত হলো ও মায়ের কাছে গিয়ে বললেন,
"মা, বিদ্দেসাগর বেঁচে থাক্! তোমার ভয় কি! ও ওল্ড ফুল মরে যাক্ না কেন, ওকে আমরা চাই নি; এবারে মা এমন বাবা এনে দেবো যে, তুমি, বাবা ও আমি একত্রে তিন জনে বসে হেলথ [ড্রিঙ্ক] করবো, ও ওল্ড ফুল মরে যাক্, আমি কোয়াইট রিফর্মড বাবা চাই!"
শহরের আসল কেতা তো নাইট লাইফ। সেই নাইট-লাইফের ছবি তুলে ধরেছেন হুতোম।
"ক্রমে রাত্তিরের সঙ্গে লোকের ভিড় বাড়তে লাগলো, সহরের অনেক বড়মানুষ রকম রকম পোশাক পড়ে একত্র হলেন, নাচের মজলিস রনরন্ কত্তে লাগলো;... ক্রমে আকাশের তারার মত মাথালো মাথালো বড় মানুষে মজলিশ থেকে খসলেন, বুড়োরা সরে গ্যালেন, ইয়ারগোচের ফচকে বাবুরা ভাল হয়ে বসলেন, বাইরা বিদেয় হলো--- খ্যামটা আসরে নাবলেন।
খ্যামটা বড় চমৎকার নাচ। সহরের বড়মানুষ বাবুরা প্রায় ফি রবিবারে বাগানে দেখে থাকেন। অনেকে ছেলেপুলে, ভাগ্নে ও জামাই সঙ্গে নিয়ে একত্রে বসে খ্যামটার অনুপম রসাস্বাদনে ব্রতী হন। কোন কোন বাবুরা স্ত্রীলোকেদের উলঙ্গ করে খ্যামটা নাচান--- কোনখানে কিস্ না দিলে প্যালা পায় না--- কোথাও বলবার যো নয়! ... খ্যামটাওয়ালীরা ক্রমে নিমন্ত্তুন্নেদের সকলের মুখের কাছে এগিয়ে এগিয়ে অগগরদানী ভিকিরীর মত প্যালা আদায় করে তবে ছাড়লেন! রাত্তিরে দুটোর মধ্যেই খ্যামটা বন্দ হলো--- খ্যামটাওয়ালীরা অধ্যক্ষমহলে যাওয়া আসা কত্তে লাগলেন, বারোইয়ারিতলা পবিত্র হয়ে গ্যালো।"
'হুজুকে কলকেতা'র হুজুকপ্রিয় বাঙালিকে কেমন দেখছেন হুতোম?
"হেতা নিত্য নতুন নতুন হুজুক, সকলগুলিই সৃষ্টি-ছাড়া ও আজগুব! কোনো কাজকর্ম্ম না থাকলে "জ্যাঠাকে গঙ্গাযাত্রা" দিতে হয়, সুতরাং দিবারাত্র হুঁকো হাতে করে থেকে গল্প করে তাস ও বড়ে টিপে বাতকর্ম্ম কত্তে কত্তে নিষ্কর্মা লোকেরা যে আজগুব হুজুক্ তুলবে, তার বড় বিচিত্র নয়!"
অবশ্য এ থেকে বেরিয়ে আসার উপায়ও তিনি বাতেলেছেন।
"যত দিন বাঙ্গালির বেটর অকুপেসন না হচ্চে, যত দিন সামাজিক নিয়ম ও বাঙ্গালির বর্ত্তমান গার্হস্থ্য প্রণালীর রিফর্মেশন না হচ্চে, তত দিন এই মহান্ দোষের মূলোচ্ছেদের উপায় নাই।"
আরও পডুন
একুশ শতকের কবি উৎপলকুমার বসু : পাঠ, পুনর্পাঠে যে ভাবে তিনি ধরা দেন আজও
হায়, আজও সেই দিন এল না! শহুরে বাঙালির চরিত্রবৈশিষ্ট্যও চোখ এড়ায়নি হুতোমের।
"সহরের অনেক বড়মানুষ— তাঁরা যে বাঙ্গালির ছেলে, ইটি স্বীকার কত্তে লজ্জিত হন; বাবু চূণোগলির অ্যানড্রু পিদ্রুসের পৌত্তুর বললে তাঁরা বড় খুসি হন; সুতরাং যাতে বাঙ্গালির শ্রীবৃদ্ধি হয়, মান বাড়ে, সে সকল কাজ থেকে দূরে থাকেন। তদ্বিপরীত, নিয়তই স্বজাতির অমঙ্গল চেষ্টা করে থাকেন।"
রসেবশে থাকা আমোদপ্রিয় বাঙালিকে হুতোম স্মরণ করিয়ে দিতে ভোলেননি,
"সময় কারও হাত ধরা নয়; সময় জলের ন্যায়, বেশ্যার যৌবনের ন্যায়, জীবের পরমায়ুর ন্যায়, কারুই অপেক্ষা করে না।... কোন দিন যে মত্তে হবে তার স্থিরতা নাই।"
কিন্তু হুতোমকে ভুরু কুঁচকে বাঙালি বলছে,
"বরং যত বয়স হচ্চে, ততই জীবিতাশা বলবতী হচ্চে, শরীর তোয়াজে রাখচি, আরসি ধরে শোণ নুটির মত পাকা গোঁপে কলপ দিচ্চি, সিমলের কালাপেড়ের বেহদ্দ বাহারে বঞ্চিত হতে প্রাণ কেঁদে উঠচে। শরীর ত্রিভঙ্গ হয়ে গিয়েচে, চসমা ভিন্ন দেখতে পাই নে, কিন্তু আশা ও তৃষ্ণা তেমনি রয়েচে, বরং ক্রমে বাড়চে বই কমচে না। এমন কি অমর বর পেয়ে--- প্রকৃতির সঙ্গে চিরজীবী হলেও মনের সাধ মেটে কি না সন্দেহ!"
তবে পুরনো বাবু কালচারে অভ্যস্ত বাঙালি কি বদলায়নি? বদলেছে তো বটেই; আর সেই বদল হুতোমেরও দৃষ্টি এড়ায়নি।
"এখন আর সে কাল নাই; বাঙ্গালি বড় মানুষদের মধ্যে অনেকে সভ্য হয়েচেন। গোলাপজল দিয়ে জলশৌচ, ঢাকাই কাপড়ের পাড় ছিঁড়ে পরা, মুক্তভস্মের চূর্ণ দিয়ে পান খাওয়া আর শোনা যায় না। কুকুরের বিয়ের লাক টাকা খরচ, যাত্রায় নোট প্যালা, তেল মেখে চার ঘোড়ার গাড়ী চড়ে ভেঁপু বাজিয়ে স্নান কত্তে যাওয়া শহরে অতি কম হয়ে পড়েচে।"
এইভাবে পাতায় পাতায়, ছত্রে ছত্রে ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের কলকাতা আর একবিংশ শতকের প্রথমার্ধের কলকাতা মিলেমিশে যেতে থাকে 'হুতোম প্যাঁচার নকশা'য়। পাঠক সচেতন না থাকলে এবং খেয়াল না করলে মনে হতেই পারে সাম্প্রতিক নগর কলকাতার ছবি তিনি দেখছেন 'নকশা'র আধারে। হুতোমের উদ্দেশ্য ছিল নবজাগরণের পর তথাকথিত নতুন আলোকপ্রাপ্ত 'সহর কলকেতা'র সমাজজীবনের আসল গুলজারের ছবি তুলে ধরে ক্যাথারসিসের মাধ্যমে সমকালীন নাগরিক মননের সংস্কার সাধন। সে উদ্দেশ্যে যে তিনি কিছুটা সফল হয়েছিলেন তা তিনি নিজেই জানিয়েছেন,
"— অনেকে সুদরেচেন, সমাজের উন্নতি হয়েচে ও প্রকাশ্য বেলেল্লাগিরি বদমাইশি ও বজ্জাতির অনেক লাঘব হয়েচে।"
কিন্তু উত্তর আধুনিকতার দাবীসনদ নিয়ে হাজির হওয়া একবিংশ শতাব্দীর নগর কলকাতার যে বিমোক্ষণের প্রয়োজন তা 'হুতোম প্যাঁচার নকশা' চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেও কলকাতার নাগরিক কি তা দেখতে চাইবেন, না হুতোমকেই আবার সেই দায়িত্ব নিতে হবে?
Whatsapp
