ধনে পাতার স্বাদ অপছন্দ? মানুষের জিনের সঙ্গে এর সম্পর্ক কোথায়?
শিশুকাল থেকেই যদি কোনও গন্ধ বা স্বাদের সঙ্গে মানুষের পরিচিতি ঘটে, তবে অনেক সময় মস্তিষ্ক সে-গন্ধকে ইতিবাচক অর্থে গ্রহণ করতে শিখে নেয়। একে বলে ‘ফ্লেভার কন্ডিশনিং’।
রান্নাঘরের এক পরিচিত দৃশ্য, যিনি রান্না করছেন তিনি গরম গরম মাংসের ঝোল রান্নার পর, তার ওপরে কিছু ধনেপাতা ছড়িয়ে দিলেন। আর, বেশ মনটা ফুরফুরে হয়ে উঠল। আর ঠিক তখনই, পাশে দাঁড়িয়ে একজন বলে ভ্রু কুঁচকে উঠল, ‘ইস! ধনেপাতা?’ শুরু হল পারিবারিক খাদ্য-বিতর্ক! এ-কথা ঠিক যে অনেকেই ধনে পাতা পছন্দ করেন না, তার স্বাদ বা গন্ধের কারণে। ধনেপাতা পছন্দ না করার এই বিষয়টা শুধুই রুচির ব্যাপার নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে মানুষের শরীরের ডিএনএর গভীরতর সম্পর্ক।
আরও পড়ুন-
আহত ঘাস কীভাবে বিপদ থেকে বাঁচায় অন্যান্য গাছেদের?
সম্প্রতি একটজ আন্তর্জাতিক গবেষণায় দেখা গেছে, যাঁরা ধনেপাতার স্বাদে বিরক্ত হন বা পছন্দ করেন না, এ আসলে তাঁদের স্বভাবরুচির সমস্যা নয়, বরং বিশেষ এক জিনের গঠন সেইসব মানুষদের এমনভাবে প্রভাবিত করে যে ধনেপাতার ঘ্রাণ তাদের কাছে ভালো লাগে না। গবেষণাটি জানাচ্ছে, মানুষের নাসিকায় উপস্থিত একটি রিসেপ্টর জিন OR6A2, এই ঘটনার মূল খলনায়ক। এই জিন এমন একটি ঘ্রাণগ্রাহী রিসেপ্টর তৈরি করে যা ‘অ্যালডিহাইড’ নামক কিছু রাসায়নিক যৌগের প্রতি অতি সংবেদনশীল। আর, ধনেপাতায় যে অ্যালডিহাইড থাকে, তা অনেকটা সাবান বা ডিটারজেন্টের গন্ধের মতো। ফলে, যাঁদের শরীরে OR6A2 জিন রয়েছে, তাঁদের নাক ধনেপাতার গন্ধকে খাদ্য নয়, বরং প্রসাধন দ্রব্যের মতো চিহ্নিত করে। ফলে, তাঁরা ধনে পাতা খেতে চান না।

ধনে পাতা গাছ
ধনে পাতা খাওয়ার ক্ষেত্রে, কারা ঘৃণা বেশি করেন? আর কেন? গবেষণায় উঠে এসেছে, ইউরোপীয় এবং পূর্ব এশিয়ার বংশোদ্ভূত মানুষদের মধ্যে এই সাবান-সংবেদনশীল জিন বেশি পরিলক্ষিত হয়। অন্যদিকে, দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, এবং লাতিন আমেরিকান জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই জিনের বিকল্প সংস্করণ দেখা যায়, যা আবার ধনেপাতার স্বাদকে সহজে সহ্য করতে সাহায্য করে নেয়। এই কারণেই হয়তো ভারতীয়, মেক্সিকান, বা থাই রান্নায় ধনেপাতার এত ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায়। কারণ, এই অঞ্চলের মানুষের জিন ধনেপাতার প্রতি সহনশীল। তাই যখন কেউ গরম-গরম মাংসের ঝোলে ধনে পাতা দিলে খেতে চান না, তখন তা নিছক রুচির কারণে নয়, এর পেছনে সেই ব্যক্তির জিনের বৈশিষ্ট্যের গুরুত্বও লুকিয়ে আছে।
গবেষকদের মতে, যাঁরা ধনেপাতার গন্ধে অতিসংবেদনশীল, তাঁদের ডিএনএ-র যে অংশ এই অভ্যাস নিয়ন্ত্রণ করে, তা ঘ্রাণশক্তির অবনমন অর্থাৎ ঘ্রাণ হারানোর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত—এবং এটা আলঝেইমারস রোগের প্রাথমিক লক্ষণগুলির একটি। তার মানে এই নয় যে, ধনেপাতা অপছন্দ মানেই স্মৃতিভ্রংশ আসন্ন। তবে গবেষকরা মনে করছেন যে ঘ্রাণ ও স্বাদের জিনগুলি মস্তিষ্কের সুস্থতার আগাম সংকেত দিতে পারে।

রান্না মাংসে ধনে পাতা
গবেষণায় এটাও উঠে এসেছে যে, নারী ও পুরুষদের মধ্যে এই জিনগুলির প্রকাশ ভিন্ন ভিন্ন ভাবে প্রকাশিত হয়। এই পার্থক্যের ফলে স্বাদ ও গন্ধের অভিজ্ঞতাও নারী-পুরুষের ক্ষেত্রে ভিন্ন হতে পারে। সম্ভবত এই কারণেই পরিবারের এক সদস্য ধনেপাতা ছাড়া খেতে পারেন না, আরেকজন তা দেখলেই মুখ বেঁকান। আর এরই ফাঁক দিয়ে জীববিজ্ঞানের গোপন এই খেলা কখনও কখনও আমাদের রান্নাঘর পর্যন্ত গড়ায়।
আরও পড়ুন-
রূপান্তরকামী হয় গাছও! প্রতি ঋতুতে কীভাবে লিঙ্গ বদলায় আখরোট গাছ?
এখানে এক অদ্ভুত বিষয়ের কথা বলছেন বিজ্ঞানীরা। তাঁদের মতে, যেসব মানুষের জিন ধনেপাতার গন্ধ অপছন্দ করে, তাঁদেরকেও ধনে পাতার স্বাদের দিকে ফেরানো সম্ভব। বিজ্ঞানীরা বলছেন, শিশুকাল থেকেই যদি কোনও গন্ধ বা স্বাদের সঙ্গে মানুষের পরিচিতি ঘটে, তবে অনেক সময় মস্তিষ্ক সে-গন্ধকে ইতিবাচক অর্থে গ্রহণ করতে শিখে নেয়। একে বলে ‘ফ্লেভার কন্ডিশনিং’। জিনের বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে, তাই যদি ছোটবেলা থেকেই মা-বাবা বা ঠাকুরমার রান্নায় ধনেপাতা থাকে, তবে সেই স্মৃতি ও আবেগ হয়তো ধীরে-ধীরে মস্তিষ্কে ধনেপাতার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করতে পারে! শান্ত সবুজ ধনে পাতার স্বাদের তারতম্যের এমন বৈজ্ঞানিক কারণ সত্যিই অবাক করার মতো।

Whatsapp
