ভালোবাসতে না পারো, কিন্তু অস্বীকার করতে পারবে না

Pride Month 2025: বিষমকামীরা তো প্রকাশ্যে কখনও ঘোষণা করেন না যে তিনি যৌন পরিচয়ে একজন বিষমকামী; তাহলে সমকামী মানুষদের কেন জনসমাজের সামনে দাঁড়িয়ে বলতে হবে তাঁর যৌন পরিচয়!

সমপ্রেমীরা কি গ্রহান্তরের মানুষ? আদৌ মানুষ? এহেন প্রশ্ন এই একুশ শতকেও আলোচনার বিষয় কিছু সংখ্যক মানুষের মধ্যে। এখন, যখন পৃথিবী জুড়ে ট্রান্সজেন্ডার আইন, সমপ্রেমী বিবাহে মান্যতা ইত্যাদি ইস্যু আলোচনায় মুখর, তখন সমপ্রেমীরা ‘খায় না মাথায় দেয়’ ধরনের প্রশ্ন বড্ড অবান্তর। অবান্তর হলেও এটাই হয়তো বাস্তব। এবং বারবার এ-ধরনের প্রশ্ন যেকোনও লড়াইকে জোরদার করতে সাহায্যই করে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আজ থেকে দশ বছর আগের পরিস্থিতি আর আজকের পরিস্থিতির মধ্যে মানসিক বিকাশ গঠনে প্রভূত বদল এসেছে। মানুষের চিন্তা, দৃষ্টিভঙ্গি, দৈনন্দিন যাপন, অভ্যাসের পরিবর্তন হয়েছে। আজকের এলজিবিটিকিউআইএ+ মিছিলে অংশগ্রহণ করতে দেখা যাচ্ছে প্রচুর সিসজেন্ডার-হেটেরোসেক্সুয়াল মানুষদের, সেই মিছিল দেখে পথচলতি ছেলেটি বা মেয়েটির মধ্যে প্রশ্ন জাগছে, আকাডেমিক স্তরে জেন্ডার স্টাডিজ নিয়ে পড়াশোনা হচ্ছে, পত্র-পত্রিকা-জার্নালে নানা তথ্যভিত্তিক আলোচনা প্রকাশিত হচ্ছে, সাহিত্য-সিনেমা নির্মিত হচ্ছে – এই এত আশাবাদের পাশে সমপ্রেমীরা-সমকামীরা কি ‘গ্রহান্তরের মানুষ’ জাতীয় প্রশ্নের উত্থাপন বেমানান।

জুন মাস প্রাইড মাস। আমাদের সকলের কাছে গর্বের মাস। বিভিন্ন যৌনঅভিমুখিতা এবং লিঙ্গপরিচয়ের মানুষদের অধিকারের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় এই জুন মাস। সাম্যের দৌড়ের নিরিখে, সম-অধিকারের নিরিখে এই মাস বিশ্বব্যাপী উদযাপিত হয়। কিন্তু যে ছেলেটি ছোটবেলায় গামছা নিয়ে শাড়ি শাড়ি খেলত কিংবা যে মেয়েটির নেশা ছিল মাঠে গিয়ে ক্রিকেট খেলা, অথবা পরিবার-পরিস্থিতির চাপে নিজের যৌন স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে কথা বলতে পারেনি যে বাবা-জ্যাঠা-কাকার প্রজন্ম – সমাজের চোখে তারা ‘নর্মাল’ নয়। অর্থাৎ অস্বাভাবিক। মূলস্রোতের বাইরে গিয়ে ভিন্ন মত পোষণ করাই যদি অস্বাভাবিক হয়, তাহলে তো প্রশ্ন উঠবেই, মূলস্রোত আসলে কী? মানুষ রচিত ইতিহাসে সে যেটা দেখাতে চেয়েছে সেটাই দেখিয়েছে, রচিত ইতিহাসের পিছনেও পড়ে থাকে এরম হাজার অতীত, যাকে মেরে ফেলা হয় অচিরেই। ‘মূলস্রোত’ আসলে মানুষই তৈরি করে, যেমন স্বাভাবিক আর অস্বাভাবিক জাতীয় তকমা মানুষ নির্ধারিত। ঋতুপর্ণ ঘোষ বহু বছর আগে সাক্ষাৎকারে একটি কথা বলেছিলেন, যা আজ বহু প্রান্তিক যৌনতার মানুষের কাছে স্পর্ধা – “এই শহর না আমায় নিতে পারবে, না ফেলতে পারবে”। অর্থাৎ তুমি আমায় ভালোবাসতে না পারো, কিন্তু অস্বীকার করতে পারবে না। আমাকে মানিয়ে নিতে না পারো, কিন্তু ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারবে না। সমাজ এগিয়েছে যৌনতার স্তর খুলতে খুলতে। বাবা-মায়েরা সন্তানের যৌন পরিচয় নিয়ে গর্ব প্রকাশ করছেন, লিঙ্গ পরিবর্তনের সিদ্ধান্তে পাশে থাকছেন; পাশাপাশি দীর্ঘদিন বিবাহিত জীবন অতিবাহিত করার পর বাবা নিজেকে নতুন করে চিনে নিজের যৌনতার কথা ভাগ করে নিচ্ছেন সন্তানের কাছে – আয়নার দুই পিঠই সত্যি। আর সত্যি বলেই তা সমাজের পক্ষে মেনে নেওয়া মুশকিল। মৌলবাদীদের কাছে ভয়ংকর ঘৃণ্য।

আরও পড়ুন-কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা হলে সরকারকে কখনই পাশে পাবে না মেয়েরা?

আমরা প্রত্যেকেই সমাজবদ্ধ জীব। আমি, আপনি, আপনারা ঘিরেই একটা আস্ত সমাজ। আমি বদলালে কিংবা পাশের মানুষটিকে বদলাতে সাহায্য করলে তবেই একটা সুস্থ সমাজ তৈরি হবে। আজও সমকামিতা নিয়ে অহেতুক আতঙ্কের শেষ নেই। কয়েকটি কথা প্রকাশ্যে বলা যাক বরং। বিষমকামীরা তো প্রকাশ্যে কখনও ঘোষণা করেন না যে তিনি যৌন পরিচয়ে একজন বিষমকামী; তাহলে সমকামী মানুষদের কেন জনসমাজের সামনে দাঁড়িয়ে বলতে হবে তাঁর যৌন পরিচয়! বলতে হয়। কারণ, রাষ্ট্রব্যবস্থার মন এখনও স্বাভাবিক/অস্বাভাবিকে দ্বিধাবিভক্ত। এলজিবিটিকিউআইএ+ মানেই যেন সেনসেটিভ ইস্যু। এই সেনসেশন কারা আনল? কীভাবে আনল? যৌন পরিচয় যদি 'নর্মাল'-ই হয়, তাহলে কীসের এত কথা কাটাকাটি, মারামারি, কাদা ছোড়াছুড়ি!

আরও পড়ুন- রূপান্তরকামী মহিলারা ক্রিকেট খেললে মহিলাদের অধিকার কমে যায়?

এক বাঙালি কুইয়্যার কবির একটি কবিতা (যদিও কবিতায় শ্রেণি বিভাজন করা ঠিক না, তাও আলোচনার সুবিধার্থে ধরা যাক প্রেমের কবিতা) নিয়ে এক সমালোচক আলোচনা করতে গিয়ে বারবার নারী-পুরুষের সম্পর্কের কথাই আনছেন। মেনে নিলাম, কবিতা পড়ে বোঝার উপায় নেই সেটি কুইয়্যার কবিতা কিংবা কবির সঙ্গেও ব্যক্তিস্তরে আলাপ নেই, কিন্তু সমস্যাটা তৈরি হয় এখানেই যে, আজও অধিকাংশ মানুষ প্রেম বলতে বোঝেন নারী-পুরুষ বাইনারি, তার বাইরে যে বৃহত্তর পৃথিবী মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে, সেদিকে ইচ্ছাপূর্বক নজর দিতে চান না। অসুবিধাটা কীসের? না কি ভয়? পরিবারের, কাছের মানুষের, সমাজের না কি নিজের উপরেই ভয়? উনিশ শতকীয় খোলস ছেড়ে এই মানুষই একদিন বিপ্লবের ডাক দিয়েছে। আধুনিক থেকে আধুনিকতর হয়েছে মানুষ। উন্মুক্ত হয়েছে ব্যক্তি প্রেম, সম্পর্কের বাঁধন। স্বাধীনতা পেয়েছে মেয়েরা। কিন্তু আজও কিছু ফোবিয়া সমাজের মূলে রয়ে যায় অজান্তেই। এই অজানাকে খোঁজার দায়িত্ব কার? আমার, আপনার— সবার।

এ কথা বলা যায়, এলজিবিটিকিউআইএ+ মানুষদের চিৎকার, তাঁদের প্রেম, যৌনতা, অর্থোপার্জন, বিবাহ সবকিছুই আজ গোটা পৃথিবীকে ভাবাতে বাধ্য করছে। তাই আজ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রামধনু মানুষদের কথা। আনন্দ পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রখ্যাত লেখক তিনশো পৃষ্ঠার গবেষণাধর্মী কুইয়্যার উপন্যাস লিখেও বলে ফেলছেন, কুইয়্যার কী আজও তিনি বুঝতে পারেন না। তখন আমাদের সংশয় হয় আগামীর ভবিষ্যৎ নিয়ে। লেখকের লেখার সত্যতা নিয়ে। আমরা অবাক হই। কুইয়্যার কোনও বিলিতি আমদানিও না কিংবা বড়লোকের মানসিক অসুখও না, কুইয়্যার একটা স্পষ্ট অবস্থান, দৈনন্দিন জীবনযাপনের ভাষা। আজকের পৃথিবীর সমস্ত ঘটনার মধ্যেই কুইয়্যার অভিব্যক্তি আছে, তা মেনে নিতে অসুবিধা কোথায়!

More Articles