প্রান্তিক মানুষেরা কারোর করুণা চায় না, শুধু নিজের ইচ্ছেয় বাঁচতে চায়
Lgbtq Rights : শরীরের যেমন যৌনপরিচয় আছে, মনেরও তেমনই নিজস্ব যৌনপরিচয় রয়েছে। কেউই সেটা খেয়াল করে না। আবার যারা খেয়াল করে, তারা মানতে চায় না।
‘সম্মুখেতে চলবে যত, পূর্ণ হবে নদীর মত’— শুকিয়ে যাওয়া নদী কীভাবে পূর্ণ হতে পারে? পূর্ণ হতে পারে না- পাওয়ার দ্বারা। আমার তেইশ বছরের এই জীবন, শৈশব-কৈশোর থেকে যৌবন পর্যন্ত, না-পাওয়াতেই পূর্ণ হয়ে আছে। প্রতিবছর স্বাধীনতা দিবস এলেই সবাই যেভাবে স্বাধীনতা-পরাধীনতার সীমানাগুলি বিষয়ে কাটাছেঁড়া করতে থাকে, তখন আমার কিছুই বলার বা চাওয়া-পাওয়ার থাকে না। আমার আর নতুন করে ভয়-ও করে না। ‘সাগরে যার বিছানা পাতা, শিশিরে তার কী করিবে’। জন্ম থেকে অপমান, না পাওয়া সহ্য করতে-করতে নতুন করে কিছু পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা নেই।
আমি সহজ। আমি একজন সমপ্রেমী মানুষ। যাকে সমাজে সবার থেকে ‘আলাদা’ বা ‘প্রান্তিক’ বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়, আমি সেরকমই একজন। আমার ছোটবেলায় শাড়ি পড়তে বড় ভালো লাগত। কাঁধে আঁচল ফেলে দু-হাতের আঙুল দিয়ে শাড়িতে কুচি করতে শিখিয়েছিলেন আমার মা। একদিন অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে এসে বাবা দেখতে পান, আমি শাড়ি পড়েছি। খুব মারেন আমায়। মায়ের ওপরও চলতে থাকে চোটপাট। যখন শাড়ি পরতাম মনে হত আমি যা, আমি যেন তা-ই হলাম। কী অপূর্ব একটা স্বাধীনতা! সেদিনের পর থেকে শাড়ি পরতে চাওয়ার ইচ্ছেটা প্রায় জোর করেই ঝেড়ে ফেলতে হল জীবন থেকে।
আরও পড়ুন-
কোন আচরণ সঠিক কোনটা ভুল ঠিক করে দেবে কে?
এমন কত কিছুই জীবন থেকে জোর করে বার করে দিয়েছি। পুতুলের বিয়ে, রান্নাবাটি— এসব নাকি মেয়েলি খেলা? ছেলে হয়ে ক্রিকেট-ফুটবল খেলবে, পুতুল নয়— এই বলে বাবা পুতুলের বাক্স ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। বেশ, ওরাও বেরিয়ে গেল জীবন থেকে। তবে, সবটাই কিন্তু অন্যের ইচ্ছেয়। এই ‘অন্য’ কে? শুধু কি আমার বাবার অফিস ফেরৎ রাগিমুখ? না। চারপাশের পুরো সমাজটাই এই ‘অন্য’, যাদের চাপিয়ে দেওয়া অদৃশ্য নিয়মকে আমাদের মতো প্রান্তিক মানুষদের প্রতি নিয়ত মেনে চলতে হয়।
ছোটবেলায়, বাবার বকুনিতে যে-কদিন ইচ্ছের বিরুদ্ধে ক্রিকেট খেলতে গিয়েছি, বারবার মনে হয়েছে এর চেয়ে রান্না করা, সংসার করা ঢের সহজ। খেলার মাঠে বন্ধুরা আমাকে ডাকত ‘হাফ লেডিস’ বলে। শুধু খেলার মাঠ না, রাস্তাঘাট, স্কুল— সবই আমাকে এক বিভীষিকা ভূতের মতো তাড়া করে বেড়াত। তখনও ‘বুলিং’ শব্দটির অর্থ জানি না। শুধু মাঝরাতে ঘরে-রাখা কৃষ্ণমূর্তির সামনে কাঁদতে-কাঁদতে বলতাম সবাই আমাকে এরকম কেন বলে, আমার সঙ্গেই এরকম হয় কেন? সেই কৃষ্ণমূর্তি— শাড়ি পরে, নিজেকে রাধা ভেবে যার পাশে কল্পনা করতাম, সে নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত আমার দিকে। হাফ লেডিস, ছক্কা, হিজরা, হোমো শব্দগুলো শুনতে-শুনতে আমাকে বড় হতে হয়েছে এবং এখনও শুনতে হয়। তফাৎ শুধু একটাই, ছোটবেলায় এসব শুনলে চোখের বাঁধ ভেঙে কান্না আসত, কোনও অনুষ্ঠানে যেতে ভয় পেতাম, আর এখন এসব প্রত্যেক দিন দু-পায়ে মাড়িয়ে চলি।

এলজিবিটিকিউ আয়োজিত 'প্রাইড ওয়াক'
ছোট থেকে চুল বড় রাখার ভীষণ শখ আমার। মায়ের বিনুনিতে সাদা ফুল দিয়ে ভাবতাম কবে আমার এমন বড় চুল হবে! আজ যখন বড় চুল নিয়ে রাস্তায় বেরোই, মেট্রোতে উঠি, তখন চারিদিকে ফিসফিসানি শুনতে পাই— এটা ছেলে না মেয়ে? যে-গলায় আবৃত্তির জন্য প্রতিবছর স্কুলে প্রথম হতাম, সেই গলার জন্যই বন্ধুরা ঠাট্টা করে বলত তোর গলা একদম মেয়েদের মতো। আমার হাত নেড়ে কথা বলা যে স্কুলে কতজন মিমিক্রি করে দেখাত, তা নিয়ে ঠাট্টা করত— তার হিসেব নেই। শুধু বন্ধু, সহপাঠী, সিনিয়ররা না, স্কুলের কত স্যারও আমার নারীসুলভ আচরণকে নিয়ে দিনের পর দিন মজা করেছেন। মনে আছে, হল-ভর্তি ছাত্রের সামনে আমার এক স্যার মাইকে ঘোষণা করেছিলেন, এবার আবৃত্তি করতে আসবে আমাদের বয়েজ স্কুলের একমাত্র ছাত্রী, সহজ। গোটা হল-ঘর অট্টহাসিতে ভেঙে পড়েছিল। বাকি স্যারেদের মুখেও তখন মুচকি হাসি। আর আমি? লজ্জিত, আতঙ্কিত।
এ তো গেল কিছু বুঝে উঠতে পারার আগের কথা। তারপর যখন ধীরে-ধীরে নিজেকে চিনতে শুরু করেছি, মানুষের যৌনপরিচয়ের বিচিত্র সব রূপ সম্পর্কে জানছি, তখনই শুরু হল নিজের সঙ্গে নিজের লড়াই। আমি কেন অন্যদের থেকে আলাদা, এই সহজ প্রশ্নের কোনও উত্তর সহজের কাছে ছিল না। কেন ভগবান আমাকে ‘মেয়ে’ না বানিয়ে ‘ছেলে’ বানিয়ে দিল, এ-প্রশ্নের কোনো উত্তর আমি পাইনি। ছেলে যখন বানিয়েছে, তখন ছেলের ‘মন’ কেন দিল না? নিজের পুরুষাঙ্গকে দু-পায়ের মাঝে ঢুকিয়ে কল্পনা আমি করি যোনি, ব্লাউজের ভিতর কাপড় ঢুকিয়ে বানাই নকল স্তন। কিন্তু শাড়ি হাতে নিয়ে পরতে গিয়ে এখনও থমকে যাই।
আরও পড়ুন-
ভালোবাসতে না পারো, কিন্তু অস্বীকার করতে পারবে না
সহপাঠীদের আমার পেছনে চাটি মারা, আমার বুকে হাত দেওয়া কিংবা কোনো আত্মীয়ের আপত্তিকর স্পর্শ— এসব বিকৃত যৌনতাকে অতিক্রম করে প্রত্যেকের মতো আমার জীবনেও প্রেম এসেছে। পাড়ার এক দাদার সঙ্গে তখন রোজ কথা হয়। দাদাটা ওর সাইকেলে করে প্রত্যেক দিন আমাকে ঘুরতে নিয়ে যায়। একদিন দুপুরে ওর ফাঁকা বাড়িতে দুজন-দুজনকে নতুনভাবে আবিষ্কার করলাম আমরা। অঙ্গে-অঙ্গে আবিষ্কারের সে এক নাছোড়বান্দা সুখ। কিন্তু সবাই তো সুখী হতে পারে না। কিছুদিন পরেই আমার চোখের সামনে সেই দাদাটিরও বিয়ে হয়ে গেল। এরপরেও জীবনে কতবার প্রেম এসেছে, যৌন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি। কিন্তু সেই ছোটবেলা থেকে আজ পর্যন্ত একটা বিষয় একই রয়ে গেছে। যারাই আমার জীবনে এসেছে, তারা আমার আত্মপরিচয়কে স্বীকৃতি দেয়নি। আমার শরীরের পরিচয়, আমার মনের পরিচয়ের থেকে ভিন্ন। শরীরের যেমন যৌনপরিচয় আছে, মনেরও তেমনই নিজস্ব যৌনপরিচয় রয়েছে। কেউই সেটা খেয়াল করে না। আবার যারা খেয়াল করে, তারা মানতে চায় না।
আমি একটা স্বাধীন দেশে বাস করি, এ-কথা সেই ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি। কিন্তু আমার শরীর আর আমার মন, সেখানেও তো আমার বসবাস, ওরাও তো আমার ‘দেশ’। কিন্তু ওই দেশে, অর্থাৎ আমার আত্মপরিচয়ে কি আমি একদিনও স্বাধীনতার নিঃশ্বাস নিতে পেরেছি? না। পারিনি, চারপাশের সমাজচক্ষুর কারণে। কিন্তু এখন আর এগুলোও আমাকে স্পর্শ করে না। শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন, ‘করুণা চেয়েছি ভাবো? তোমাদের সমর্থন? ভুল/ অনুমোদনের জন্য হৃদয়ে অপেক্ষা নেই আর’। করুণা চাই না, অনুমোদন চাই না। শুধু নিজের মতো বাঁচতে চাই।
Whatsapp
