শশী তোমার শরীর নাই, ঘর নাই? পুতুলনাচের ইতিকথা ছবির নিবিড়পাঠ
Putul Nacher Itikatha: আজকের দুনিয়ায় মানুষ আধুনিকতার যান্ত্রিক উন্নাসিকতায়, তার গণনানির্ভর জীবনে বার বার ভুলে যায় বিপন্ন প্রকৃতি ও মানুষকে, এমনকি দায়ে না পড়লে সে ভুলে থাকে নিজের রোগ ব্যাধি জড়া সম্বলিত বিপন্ন শরীরটিকেও।
২০০৫ সাল। নন্দন প্রেক্ষাগৃহে সদ্য মুক্তি পেয়েছে নবারুণ ভট্টাচার্যের উপন্যাস অবলম্বনে সুমন মুখোপাধ্যায়ের নির্দেশিত ছবি হারবার্ট। সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করা আমি ছুটে বেড়াচ্ছি গবেষণার বিষয় অন্বেষণে। ইচ্ছে, কাজ করব উত্তর-ঔপনিবেশিক তত্ত্ব নিয়ে। হারবার্ট চোখের সামনে যেন নিয়ে এল সেই কাঙ্ক্ষিত বিষয় – মৃত মানুষের প্রতিরোধ – মৃত সময়েরও। নকশালবাড়ির উত্তাল মুহূর্তে রাষ্ট্রীয় হিংসায় মৃত বিপ্লবের প্রেত যেন ফিরে আসে হারবার্ট উপন্যাসে। নকশাল ভাইপোর স্মৃতি বয়ে চলা প্রেত বিশ্বাসী হারবার্ট সরকারের আত্মহত্যা যখন শ্মশান চুল্লিতে বিস্ফোরণ ঘটায় তার লেপের ভিতরে লুকিয়ে রাখা নকশালি বোমায় তখন ভেঙে পড়ে রাষ্ট্রীয় যুক্তিবোধ। আমাদের গণনানির্ভর জীবনে প্রতিটি পদক্ষেপে মেপে দেওয়ার রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা তছনছ হয়। আজ ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে যখন মৃত্যুকেন্দ্রিক মানববিদ্যাচর্চা বা necrohumanities নিয়ে গবেষণা করি তখন ভাবি সুমনবাবুর এই ছবি আমার চিন্তায় চেতনায় কী গভীর অভিঘাত ফেলেছিল। ২০ বছর পর আবারও দেখছি সেই একই পরিচালকের সিনেমা। এবার, পুতুলনাচের ইতিকথা।
পাশ্চাত্য যুক্তিবোধের সরলীকরণ থেকে জন্ম রাষ্ট্রচিন্তার, আবার তার থেকেই নির্মিত পুঁজিবাদী সমাজের ম্যানেজমেন্টেরও। এই যুক্তিবোধের বিপরীতে থাকে বিপন্ন মানুষ ও প্রকৃতি। আবার যুক্তিবোধই যেন সমস্ত বিপন্নতার সমাধান রূপে আবির্ভূত হয়। অথচ এই যুক্তিবোধ নিয়ন্ত্রিত প্রকৃতি আজ বিপন্ন – ধ্বংসপ্রাপ্ত। আর কর্পোরেট পুঁজিবাদের চক্রান্তে বিপন্ন প্রান্তিক মানুষও। এসবের অশুভ আরম্ভ মনে হয় গ্রাম শহরের সেই চিরকালীন দ্বন্দ্বে যেখানে সরল, একই ছন্দে বয়ে চলা, জীবন ও মৃত্যুর সহাবস্থান মেনে নিয়ে বেঁচে থাকা মানুষের বিচরণকে ভাবা হয় প্রাগাধুনিক। আর জীবনকে ব্যাখ্যা করে মানুষের সুরক্ষা বলয়ের মধ্যে নিয়ে আসা যেন তার বিপ্রতীপে থাকা আধুনিকতা। আমাদের দেশে এই আধুনিকতার প্রবেশ ঔপনিবেশিক শাসনের হাত ধরে। উনিশ শতকের শেষ থেকে বিশ শতকের প্রথমার্ধ অবধি বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার সংকট হয়ে ওঠে অন্যতম বিষয়বস্তু। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে সুমন মুখোপাধ্যায়ের নির্দেশিত সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি পুতুল নাচের ইতিকথা সেই সংকট আরও একবার যেন ফিরিয়ে নিয়ে আসে। মানিকবাবুর উপন্যাসের এই চলচ্চিত্রায়িত নব্য পাঠ যেন আমাদের এখনকার সময়ের সংকটমুহুর্তগুলোর সাথে উপন্যাসটিকে যুক্ত করে।
আরও পড়ুন- পঞ্চাশ বছরে শোলে! হিট ছবি, কালোত্তীর্ণ কি?
আধুনিকতার সংকট কেবল সেকালের নয়, আজও ঔপনিবেশিক আধুনিকতার ভূত আমাদের তাড়া করে বেড়ায়। আজকের দুনিয়ায় প্রধানতম তিনটি সংকটের সাথে জুড়ে যায় পাশ্চাত্য আধুনিকতার প্রশ্নটি। আধুনিকতা কি বিপন্ন মানুষ ও প্রকৃতিকে বোঝার এবং তাকে রক্ষার করার সমাধানসূত্র নাকি এই আধুনিকতার দৌড় সীমিত এবং ক্ষুদ্র? এই মুখ্য প্রশ্নটির সাথে যথাক্রমে জুড়ে যায় মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্ক, পাশ্চাত্য আধুনিকতা বনাম মানুষের যুক্তির বাইরে থাকা ধর্মবিশ্বাস ও আধ্যাত্মিকতার অনুভব এবং মন ও শরীরের ভেদের প্রসঙ্গ। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এই বৈপরীত্যগুলির একদিকে রয়েছে মানবকেন্দ্রিক যুক্তিবোধের প্রাধান্য ও অপরদিকে যুক্তির বাইরে থাকা বৃহত্তর অব্যাখ্যাত জগত এবং মানুষের সাথে তার জটিল সম্পর্ক।

ছবির শুরুতে উপন্যাসের ঘটনাক্রম অনুসরণ করেই যখন গাওদিয়া গ্রামে প্রবেশ করছে শহরফেরতা ডাক্তার শশী তখনই হঠাৎ বজ্রপাত! গাছের গা ঘেঁষে দেখা যায় হরি ঘোষের মৃত শরীর। গাছের সঙ্গেই সেই দেহ যেন পিষ্ট হয়ে গেছে – দূর থেকে আলাদা করা যায় না তাদের। মৃত শরীর আর তড়িদাহত গাছ মিলেমিশে তৈরি করেছে এক অশরীরী আবহ। একদিকে বৃষ্টিস্নাত নৌকায় মাঝির সাথে একক যাত্রী শশী অন্যদিকে নদীর পাড়ে গাছের গায়ে পিষ্ট হারু ঘোষের মৃতদেহ - এই বিযুক্তি এবং বৈপরীত্য যেন সূচিত করে পুতুলনাচের ইতিকথা ছবিটির মুখ্য ব্যঞ্জনা। শশী যেন প্রকৃতির বাইরে জীবিত একক মানুষ যার কাছে বাইরের প্রকৃতি, মানুষ, ধীর লয়ে বয়ে চলা গ্রাম্য জীবন – এই সবকিছুই পর্যবেক্ষণের বস্তু। বহিরাগতর দৃষ্টিতে গ্রামের ছেলে শশী দেখে তার নিজের গ্রামকেই। এটাই আধুনিকতার চোখ। যার মুখ্য উদ্দেশ্য মৃত্যুহীন জঙ্গমজীবন নির্মাণ যার ভিত্তি নিরলস কর্মময়তা ও চিরকাল বেঁচে থাকার প্রয়াসে খোদার ওপর খোদকারি।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসের শুরুতে ছিল –
“খালের ধারে প্রকাণ্ড বটগাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়া হারু ঘোষ দাঁড়াইয়া ছিল। আকাশের দেবতা সেইখানে তাহার দিকে চাহিয়া কটাক্ষ করিলেন।”
উপন্যাসের বর্ণনাত্মক লিখন সুমনের চলচ্চিত্রে ছবি হয়ে ওঠে। সেখানে বিধাতাপুরুষ শশীর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মননের দিকেও চেয়ে যেন মুচকি হাসেন। চলচ্চিত্রায়নে পুড়ে যাওয়া দেহ পুড়ে যাওয়া গাছের সাথে যেন মিশে যায়। মানুষ যে প্রকৃতির অংশ সেই প্রকৃতি মৃত্যুময়। ছায়াছবি জুড়ে বার বার প্রকৃতির মাঝে শশীর বিচ্ছিন্ন উপস্থিতি রং এবং দূরত্বের প্রযুক্তিগত নির্মাণে প্রতিভাত হয়। তা যেন আধুনিকতার এক প্রাথমিক বিচ্ছেদকে সূচিত করে – সেটি একই সঙ্গে জীবনের সাথে মৃত্যুর বিচ্ছেদ,আবার প্রকৃতির সাথে মানুষেরও। অতি সাধারণ জড়া ব্যাধি দুর্যোগময় গ্রাম্য জীবনে অভ্যস্ত মানুষের অস্তিত্ব যেন বৃহৎ, মূক এবং দুর্বোধ্য প্রকৃতির অংশ, যাকে পাঠ করতে চায় ডাক্তার শশী। তার সংকটের চিকিৎসা করতে চায়। ছবিতে শশীর সাথে বার বার দৃশ্যগত দূরত্ব তৈরি হয় বাকি মানুষ ও গ্রামের প্রকৃতির। বিস্তীর্ণ ক্ষেত, গাছপালার মাঝে একক শশী, আবার যাদব চক্রবর্তীর স্বেচ্ছামৃত্যুর সময় ভিড়ের মধ্যেও শশী যেন এক একক অস্তিত্ব, বিচ্ছিন্ন। সে তার ডাক্তারি বিদ্যার ব্যবচ্ছেদাগারে দেখে নিচ্ছে রোগগ্রস্ত হিস্টিরিয়াগ্রস্ত জনগণের উন্মাদনা, অযুক্তি, অন্ধবিশ্বাস।

এমনকি শহর থেকে আসা এক সময়ের খ্যাতিমান ছাত্র, শশীর সুহৃদ কুমুদ, গ্রাম্য যাত্রার আসরে হয়ে ওঠে স্বচ্ছন্দ অভিনেতা – সে অচিরেই হয়ে যায় গ্রাম্য জীবনের অংশ, সেখানকার মেয়ে মতির সাথে সহজ সারল্য প্রেমে নিমজ্জিত হতে পারে সে, বিয়ে করে তাকে। সিনেমার দর্শক যখন পর্দায় প্রকৃতির মাঝে বসে থাকা কুমুদ ও মতির প্রেম ও খুনসুটি দেখে তখন তা যেন শশীরই দৃষ্টি। শশী গ্রাম জীবনের সাথে শুধু নয়, দূরত্ব বোধ করে নিজের ভালবাসার নারীর সাথেও। মতি হোক বা কুসুম কারো সাথে সহজ সম্পর্কে যেতে পারে না। তার জীবন উদ্দেশ্যময়। সে আগে থেকেই পরিকল্পনা করে রেখেছে। এই গ্রাম জীবনের থেকে মুক্ত হয়ে সে বৃহত্তর কর্মজগতে প্রবেশ করবে, বিলেত যাবে।
শশীর চরিত্রে আবীরের চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয় কিঞ্চিত আড়ষ্ট লাগে। কিন্তু এও মনে হয়, তার চরিত্রের বোধহয় সেই আড়ষ্টতার দাবিই ছিল। কেবল মতি বা কুসুম নয়, সেনদিদি, যাদব চক্রবর্তী, পাগল দিদি, সমস্ত চরিত্রের সাথেই তার দূরত্ব, তার প্রবেশ ও প্রস্থান ছবিতে যেন বহিরাগতর মতো।
ঔপনিবেশিক সময়ের চিকিৎসাশাস্ত্র যে যুক্তির নিগড়ে গড়া সেই একই যুক্তিতে নির্মিত হয়েছিল নৃতত্ত্ববিদ্যা। ঠিক নির্জীব অব্যক্ত প্রকৃতি কিংবা জীবজগৎকে নিরাপদ ও নিরাসক্তভাবে পর্যবেক্ষণ করার মতো করেই যেন পড়া যাবে বিবিধ সংস্কৃতির মানুষকে। এখানে পাশ্চাত্য চিকিৎসাশাস্ত্র যেভাবে মানব শরীরকে দেখে, তার অভ্যন্তরকে পাঠ করে একইভাবে গ্রামের মানুষকেও নৃতত্ত্ববিদ্যার নিরাসক্তি থেকে দেখতে চায় যেন শশী, আর বারংবার ব্যর্থ হয়। যে যাদব চক্রবর্তী নিজের মৃত্যুর দিনক্ষণ ঘোষণা করে শশীর চ্যালেঞ্জ মেনে নিয়ে, এবং সেই কথা শশীর মুখ থেকে ছড়িয়ে পড়লে নিজের বিশ্বাসকে সঠিক প্রমাণ করতে সস্ত্রীক আত্মহত্যা করেন, তিনিই আবার সমস্ত সম্পত্তি গ্রামে স্বাস্থ্যকেন্দ্র করার জন্য লিখে দিয়ে শশীকেই দায়িত্ব দিয়ে যান। দুর্বোধ্য থাকে শশীর কাছে যাদব চক্রবর্তীর ভালবাসা – অনুভব করেও যেন স্পর্শ করতে পারে না সে। ঠিক যেমন কুসুমের ভালবাসায় সাড়া দিতে পারে না সে। করে বসে বাংলা সাহিত্যে প্রায় অমর হয়ে যাওয়া প্রশ্ন,
“শরীর! শরীর! তোমার মন নাই কুসুম?”
আরও পড়ুন- বাংলা সিনেমায় ‘দলিত’ স্বর! যে অভাব পূরণ করল অর্ণ-অনির্বাণ-সোহিনীর অথৈ
অনিয়ন্ত্রিত মনকে ভয় পায় শশী। তার কাছে শরীর যেন শুধু অঙ্গের সমাবেশ, যাকে বোঝা যায় মন দিয়ে, অথবা মন যাকে পারে নিয়ন্ত্রণ করতে। রোগগ্রস্ত শরীর, হৃদয়াবেগতাড়িত দেহ, আধ্যাত্মিক অনুভতিসম্পন্ন সত্ত্বা কিংবা মৃতদেহ সমস্তটাই তার যুক্তিবোধের বাইরে।
ছবির শেষে তার মহাজন বাবা গ্রাম ত্যাগ করে চলে যায় সমস্ত দায়িত্ব শশীর ওপর ন্যস্ত করে। শশী কি তবে ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে গ্রামের একজন? না কি বিচ্ছিন্নভাবে গ্রামজীবনের ভিতর সে থেকে যায় একক সত্তা হয়ে? এই মধ্যবর্তী অবস্থানই বোধহয় আধুনিক মানুষের ভবিতব্য। খুব সহজে আর আমরা প্রকৃতির সন্তান হয়ে উঠতে পারি না, আবার যুদ্ধ, হিংসা, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বিপন্ন মানুষ এবং বিধ্বস্ত ভূপ্রকৃতির মাঝে আমরা নিরাসক্ত, নিরপেক্ষ যুক্তির চর্চাও করতে পারি না। ছবির শেষের দিকে কুসুমের গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়াও এক প্রকার মৃত্যুর দ্যোতক। দৃশ্যায়ন এক মুহূর্তে দেখায় কুসুম মিশে যাচ্ছে জলের মধ্যে ফুলের মাঝে। সে যেন টি এস এলিয়টের দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড কবিতার হায়াসিন্থ গার্ল। অনুর্বর প্রকৃতির মাঝে হারানো প্রেম ও আকাঙ্ক্ষার প্রতিরূপ, অথবা হয়তো আধুনিক মানুষের যুক্তিবোধের চাপে হারিয়ে ফেলা প্রকৃতিও। আজকের দুনিয়ায় মানুষ আধুনিকতার যান্ত্রিক উন্নাসিকতায়, তার গণনানির্ভর জীবনে বার বার ভুলে যায় বিপন্ন প্রকৃতি ও মানুষকে, এমনকি দায়ে না পড়লে সে ভুলে থাকে নিজের রোগ ব্যাধি জড়া সম্বলিত বিপন্ন শরীরটিকেও।
“শশী তোমার শরীর নাই, ঘর নাই, উঠোন নাই?”
এই প্রশ্ন করে গবেষক হিসেবে আরও একবার বরং ঘুরে তাকাই গ্রাম জীবনের দিকে, প্রান্তবাসী মানুষের প্রকৃতির সাথে নিত্যবাসের স্মৃতিচারণার দিকে। শশীর মতোই প্রবেশ করি গাওদিয়া গ্রামে, থেকে যাই সেখানে বহিরাগত একক মানুষ হয়ে আর চেষ্টা করে যাই স্পর্শ করতে তার সোহাগ শরীর। মানিকের লেখার প্রায় একশো বছর পর সুমন মুখোপাধ্যায়র ছবি আমাদের ফিরিয়ে দেয় সেই সত্তার কাছে যেখানে রাজনীতি, প্রকৃতিবিজ্ঞান আর ব্যক্তিমননের সংকট আর আলাদা থাকে না।

Whatsapp
