দক্ষিণ ভারতের যে মন্দিরে দেবতাকে বিবাহ করে তৃতীয় লিঙ্গ সম্প্রদায়ের মানুষেরা

Koovagam Koothandavar Temple : কুবগম কুত্থন্দবর মন্দিরের এই উৎসব সমগ্র এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ তৃতীয় লিঙ্গের উৎসব। একইসঙ্গে মহাকাব্য, ও তৃতীয় লিঙ্গের একত্র দৈবিক সহবস্থান এই মন্দির।

তামিলনাড়ুর কাল্লাকুরিচি জেলার উলুন্দরপেট্টাই তালুকে অবস্থিত কুবগম কুত্থন্দবর মন্দিরটির (Koovagam Koothandavar Temple) নানা গুরুত্ব রয়েছে। বিশ্বাস, পরিচয় এবং মিথের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এই মন্দির।  মহাভারতের অন্যতম প্রধান চরিত্র অর্জুনের পুত্র হলেন আরাভান। এই আরাভানকে 'কুত্থন্দবর' নামেও পূজা করা হয়ে থাকে। অর্জুন-পুত্র আরাভানের প্রতি উৎসর্গীকৃত কুত্থন্দবর মন্দিরে চৈত্র মাসে আঠারো দিনের জন্য এক বার্ষিক উৎসব পালিত হয়। এই উৎসব তৃতীয় লিঙ্গ সম্প্রদায়ের মানুষদের কাছে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ!

আরও পড়ুন-

কেন আজও অস্বীকৃত সমলিঙ্গ বিবাহ? ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে প্রান্তিকদের লড়াই?  

আসলে, এই উৎসবের মূলে রয়েছে মহাভারতের এক মর্মস্পর্শী কাহিনি। আরাভান, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পাণ্ডবদের বিজয় নিশ্চিত করতে দেবী কালীর কাছে স্বেচ্ছায় নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। আত্মত্যাগের আগে, তিনি একটি আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেন– তাঁর আকাঙ্ক্ষা ছিল একদিনের জন্য বিবাহিত জীবনের স্বাদ গ্রহণ করা। যেহেতু এই ধরনের আত্মত্যাগের জন্য কোনো নারী আরাভানকে বিবাহ করতে রাজি ছিলেন না, তাই তখন শ্রীকৃষ্ণ মোহিনীরূপ ধারণ করে আরাভানকে একদিনের জন্য বিবাহ করেন। পুরুষের নারীরূপ ধারণ এবং ভালোবেসে আরাভানেক বিবাহ করার উদাহরণটি কুত্থন্দবর উৎসবের মূল অনুপ্রেরণা এবং আচারের কেন্দ্রবিন্দু!

কুবগম কুত্থন্দবর মন্দির

কুবগমের বার্ষিক এই উৎসবটি বিশেষভাবে তৃতীয় লিঙ্গ সম্প্রদায়ের মানুষদের কাছে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। উল্লেখ্য যে, দক্ষিণ ভারতে তৃতীয় ভারতের মানুষেরা 'আরাভানি' বা 'থিরুনাঙ্গাই' নামে পরিচিত। শ্রীকৃষ্ণের আরাভানের জন্য লিঙ্গ পরিবর্তন এবং মোহিনীরূপ ধারণ, দক্ষিণ ভারতের তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের নিজেদের সঙ্গে লৌকিক মিথের একটি সংযোগের সূত্র দেয়। ফলে, তাঁদের কাছে এই মন্দির ও মন্দিরকে ঘিরে উৎসবটির বিশেষ মাহাত্ম রয়েছে।

বিধবা-পোশাকে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা

কুত্থন্দবর মন্দিরের উৎসবের ১৪ তম দিনে একটি অভিনব ঘটনার সাক্ষী হন উৎসবের দর্শনার্থীরা। ওই দিন, তৃতীয় লিঙ্গ সম্প্রদায়ের মানুষেরা মোহিনীরূপে সেজে, এক অপূর্ব ভঙ্গিমায় মন্দিরে সমবেত হন এবং প্রতীকীভাবে ভগবান কুত্থন্দবরকে বিবাহ করেন। এই বিবাহপ্রথা আসলে, মহাভারতে আরাভান ও মোহিনীর সেই পবিত্র মিলনকে পুনরায় স্মরণ করিয়ে দেয়। এবং ঠিক এর পরের দিন, উৎসবের সুর বিষাদে ভরে যায়। সেদিন তৃতীয় লিঙ্গ সম্প্রদায়ের অন্তর্গত মানুষেরা আরাভানের মৃত্যুতে শোক পালন করেন। সেই শোক পালনের দৃশ্যটি এত জীবন্ত যে তা দেখতে পাওয়া এক অভিজ্ঞতা! তারা সাদা শাড়ি পরে, মঙ্গলসূত্র খুলে, চুড়ি ভেঙে শোক প্রকাশ করতে থাকেন। বৈধব্যের নানান চিহ্নগুলি ব্যবহার করে এই প্রথা এক অর্থে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের এক মানবিক স্বীকৃতি দেয়। যে-সমাজ তাঁদের নারীমনকে অস্বীকার করেছে, তাচ্ছিল্য করেছে, অপমান করেছে, সেই নারীমনই সমাজের তথাকথিত পুরুষদের ছেড়ে বিবাহ করছে এক দেবতাকে। এই বিবাহের মধ্যে যেমন একটা আত্মস্বীকৃতি রয়েছে, তেমনই বৈধব্যের নিয়ম পালনেও রয়েছে অস্তিত্বের আরেক স্বীকৃতি! 

আরও পড়ুন-

কোন আচরণ সঠিক কোনটা ভুল ঠিক করে দেবে কে?

শুধু তাই নয়, এই উৎসবে চলতে থাকে, নানান সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কার্যকলাপ। রূপচর্চা ও সংগীতের প্রতিযোগিতার ব্যবস্থাও থাকে এখানে। খুব জরুরি একটি পদক্ষেপ এই উৎসব বিগত বেশ কিছু বছর ধরে নিয়ে আসছে, তা হল, এখানে  উৎসব চলাকালীন তৃতীয় লিঙ্গের সম্প্রদায়ের মানুষদের অধিকার ও তাঁদের স্বাস্থ্য-বিষয়ক নানা রকমের সেমিনারের ব্যবস্থা করা হয়।    

কুবগম কুত্থন্দবর মন্দিরের এই উৎসব সমগ্র এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ তৃতীয় লিঙ্গের উৎসব। একইসঙ্গে মহাকাব্য, ও তৃতীয় লিঙ্গের একত্র দৈবিক সহবস্থান এই মন্দির। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের সমাজ অবজ্ঞার চোখে দেখলেও, ভারতের মতো দেশে যখন তা পূজার উৎসবে পরিণত হয়, তখন সাধারণ মানুষের মধ্যেও এ-সম্পর্কে বোধের উদয় হয়। এবং এ কথাও স্বীকার করতে হবে যে, এই উৎসব নিজেদের স্বাধীনভাবে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের এক বিশেষ দেবতা-মঞ্চ উপহার দিয়েছে।

More Articles