ভূতের ভয় আসলে মানসিক স্বস্থ্যের সমস্যা! জানেন কী এই ফ্যাস্মোফোবিয়া?
Fear of Ghost: অ্যাডলার বলেছেন, মানুষের মনের প্রতিরক্ষা-প্রক্রিয়া (defense mechanism) প্রায়ই নিজের ভিতরের আবেগকে বাইরের কোনও শক্তির আকারে প্রক্ষেপণ করে। তাই ভয়ের অভিজ্ঞতা অনেক সময় ভূতের ছায়া হয়ে দেখা দেয়।
তখন ক্লাস টু-য়ের ছাত্র আমি। এক সন্ধ্যেয় ছোট ছাদে পায়চারি করতে করতে হঠাৎ চোখ পড়ল পাশের বড় ছাদে। কোঁকড়ানো চুল, কুচকুচে কালো গায়ের রঙ, বড় বড় চোখ মেলে তাকিয়ে আছে কেউ! বুক কেঁপে উঠল, দৌড়তে গিয়ে পা পিছলে চোটও খেলাম। পরে শুনলাম, ও-ই নাকি কানাই মামা— যিনি বেঁচে থাকতে ছিলেন প্রাণখোলা মানুষ, এখন নাকি ছাদে ঘুরে বেড়ানো আত্মা।
উত্তর কলকাতার শতাব্দীপ্রাচীন বাড়িতে বাস, যেখানে এক ছাদ থেকে আরেক ছাদে মানুষ যেমন অনায়াসে যায়, তেমনই বেড়াল কিংবা… আত্মাও নাকি ঘুরে বেড়ায়। ছোটবেলায় ভূতের গল্প শুনে শিহরণ জাগে, আবার ভয়ও। বড় হয়ে বোঝা যায়— এসব অভিজ্ঞতা অনেক সময়ই আমাদের মনের খেলা। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, হঠাৎ সেদিনই বা কেন এমন ভ্রম হলো?
মনস্তত্ত্ব কী বলছে?
মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েড বলেছিলেন, মানুষের মনে তিনটি স্তর আছে— সচেতন, অবচেতন ও অচেতন। অবচেতন মনে জমে থাকা ভয়, দুঃখ কিংবা রাগ কোনও সময়ে ভ্রম হয়ে সামনে আসে। শোনা ভূতের গল্প বা সামাজিক বিশ্বাস সেই ভ্রমকে রঙিন করে তোলে। ফলে দরজার ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ, জানালার শব্দ, বা বিড়ালের অদ্ভুত চাহনি তখন আমাদের কাছে ভূতের উপস্থিতি হয়ে দাঁড়ায়।
আরও পড়ুন- মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন হোন, এই রোগগুলি হতে পারে আপনারও
অ্যাডলার বলেছেন, মানুষের মনের প্রতিরক্ষা-প্রক্রিয়া (defense mechanism) প্রায়ই নিজের ভিতরের আবেগকে বাইরের কোনও শক্তির আকারে প্রক্ষেপণ করে। তাই ভয়ের অভিজ্ঞতা অনেক সময় ভূতের ছায়া হয়ে দেখা দেয়।
ভয় যখন রোগে পরিণত হয়
সাময়িক ভয় আনন্দদায়ক হতে পারে। তাই ভৌতিক সিনেমা, ভূতের গল্প আমাদের আকর্ষণ করে। কিন্তু ভয় যখন দীর্ঘস্থায়ী হয়ে ওঠে, তখন তা দুঃসহ হয়ে যায়। ঘুম ভাঙে মাঝরাতে, একা যেতে ইচ্ছে করে না বাথরুমে, বুক ধড়ফড় করে, শরীর ভারী লাগে, আতঙ্ক ঘিরে ধরে। চিকিৎসাশাস্ত্রে একে বলা হয় ফ্যাস্মোফোবিয়া (phasmophobia) অর্থাৎ ভূতের প্রতি তীব্র ও অযৌক্তিক ভয়।
এর উপসর্গগুলির মধ্যে রয়েছে— ঘুম না আসা, একা থাকতে না পারা, হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট, মাথা ঘোরা, ঘন ঘন প্যানিক অ্যাটাক। দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকলে এটি হৃদযন্ত্রের রোগ, উচ্চ রক্তচাপ ও বিষণ্ণতার ঝুঁকি বাড়ায়।
আরও পড়ুন- জলপানেই কমবে মানসিক চাপ! নতুন গবেষণায় উঠে এল চমকে দেওয়া তথ্য
কেন ভূত সব সময় ‘খারাপ’?
একটি প্রশ্ন ভেবে দেখা দরকার— যে মানুষ জীবিত অবস্থায় ছিলেন হাসিখুশি ও প্রাণখোলা, তিনি মারা গেলেই কেন হঠাৎ নিষ্ঠুর আত্মায় পরিণত হবেন? উত্তর লুকিয়ে আছে আমাদের সাংস্কৃতিক বিশ্বাসে। মৃত্যু যেহেতু নিজেই যন্ত্রণার প্রতীক, তাই তার পরবর্তী কিছুকেও আমরা ভয়ের রঙে রাঙাই। আসল ভূত নয়, আমাদের অচেতন মনই তখন দানব হয়ে ওঠে।
চিকিৎসা ও মুক্তির পথ
ফ্যাস্মোফোবিয়াকে ঠাট্টা নয়, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখা উচিত। চিকিৎসায় সাহায্য করতে পারে—
কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি (CBT): ভয়ের ভ্রান্ত ধারণাকে যুক্তি দিয়ে পাল্টানো।
এক্সপোজার থেরাপি: ধীরে ধীরে ভয়কে সামনে আনতে শেখানো।
ঔষধ: তীব্র ক্ষেত্রে অ্যান্টি-অ্যাংজাইটি ওষুধ।
রিলাক্সেশন টেকনিকস: মেডিটেশন, শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ, যোগাভ্যাস।
সবচেয়ে জরুরি হলো— বোঝা যে ভয় অনেকটাই আমাদের তৈরি। কানাই মামা আমার কাছে কতটা আতঙ্কের হবে, তা আমিই ঠিক করি। মানসিক অবস্থান বদলালে ভয়ও কমে আসে। ভূত আছে কি নেই— এ নিয়ে বিতর্ক চিরন্তন। কিন্তু ভূতের ভয় যে বাস্তব, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। তাই ভূতকে নয়, ভয়কেই চেনা দরকার। কারণ, ভূত যদি না-ই থাকে, ভয় নামক ছায়াটি কিন্তু আমাদের সঙ্গেই থাকে—ছাদের কার্নিশে দাঁড়িয়ে, কিংবা অবচেতনের অন্ধকারে।
অন্বেষা বন্দ্যোপাধ্যায়
লেকচারার
যোগময়া দেবী কলেজ
মনস্তত্ত্ব বিভাগ

Whatsapp
