শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘জরাসন্ধ’: নতুন করে পড়া

Shakti Chattopadhyay’s 'Jarasandha': ‘জরাসন্ধ’ শব্দটি একটি বিশেষ্য পদ এবং এই নামটির সাথে যে কোনো সাধারণ পাঠকও পরিচিত। কেননা এই চরিত্র এই পুণ্যভূমি ভারতভূমির আকর ‘মহাভারত’-এর এক চরিত্র হওয়ার সুবাদে।

বিশ্ব সাহিত্য যদি একটি পৃথিবী হয়, তাহলে তার অন্যতম সমৃদ্ধশালী দেশ হলো বাংলা সাহিত্য। এই বাংলা সাহিত্যে যাঁরা প্রতিনিধিত্ব করে গেছেন, এবং সময়ের ভীষণ চোখরাঙানিকে উপেক্ষা করে দশকের পর দশক পরবর্তী পাঠক ও লেখকদের মোহিত ও আচ্ছন্ন করার মাধ্যমে নিজেদের প্রভাব বজায় রাখতে পেরেছেন, তাঁদের মধ্যে এক অনস্বীকার্য নাম শক্তি চট্টোপাধ্যায়। তিনি আক্ষরিক অর্থেই শব্দের প্রভু, সুন্দরের পূজারী, মানুষের নিবিড় প্রেমিক। মানুষের জীবন, দৈনন্দিন বাঁচা, নান্দনিকতা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটি, সেটি হলো অনুভূতি শক্তির লেখায় যেভাবে ফুটে উঠেছে, তা সাধারণ প্রশংসার ঊর্ধ্বে আনন্দ-দুঃখ-ঘৃণা-ভালবাসা-জন্ম-মৃত্যু-জরা-আলো-অন্ধকার সব যেন এক অপার্থিব জগতের পুরুষ হয়ে এসে দাঁড়ায় তাঁর কবিতায়। হয়ত ঈশ্বর হয়ে, হয়ত বা তা-ও নয়, এক অতি সাধারণ জৈবিক সত্তা হয়েই। 

জরা বা আরও স্পষ্ট করে বললে শক্তির ‘জরাসন্ধ’, নির্দিষ্ট এই কবিতাটি এই আলোচনার মূল বিষয়। কবিতাটিকে নিয়ে ইতোমধ্যে নানান আলোচনা হয়েছে, আলোচনা হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও আলোচনা হবে; তবুও যেন এ-লেখা ফুরোবার নয়, আরও কিছু দাবি করে চলে। কিন্তু কী সেই দাবি? কী সেই খিদে? সেটিই একটু নিজের মতো করে খোঁজ করা বা ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে এই লেখায়।

প্রথমেই আসা যাক কবিতাটির নামকরণ নিয়ে। ‘জরাসন্ধ’ শব্দটি একটি বিশেষ্য পদ এবং এই নামটির সাথে যে কোনো সাধারণ পাঠকও পরিচিত। কেননা এই চরিত্র এই পুণ্যভূমি ভারতভূমির আকর ‘মহাভারত’-এর এক চরিত্র হওয়ার সুবাদে। যদিও চরিত্রটি স্বল্প সময়ই থেকেছে বিপুল ঘটনাবলীর তুলনায়, তবুও তার উপস্থিতি এবং কার্য আলাদাভাবে নজর কেড়ে নিতে পেরেছে এবং মনের মধ্যে থেকেছে। সবকিছু বাদ দিলেও, যেটি সব থেকে চমকপ্রদ লাগে এই চরিত্রটির ক্ষেত্রে, সেটি হলো এর জন্ম রহস্য এবং যার সাথে কণায় কণায় জড়িয়ে রয়েছে তাঁর মৃত্যু রহস্যও। সেটি এরকম— জরাসন্ধের পিতা রাজা বৃহদ্রথের বিয়ে হয়েছিল কাশীর রাজার যমজ দুই কন্যার সাথে। রাজা তাঁর দুই স্ত্রীকেই সমান ভালোবাসতেন, কিন্তু কারো কোনো সন্তান ছিল না। ঋষি চন্দকৌশিক একবার তাঁর কাছে এল এবং একটি একটি মন্ত্র পড়া আম তাঁকে দিয়েছিল বর হিসেবে, যে আম তাঁর স্ত্রীদের খাওয়ালে তাঁরা  সন্তান জন্ম দিতে পারবে। বৃহদ্রথ আমটি দুই ভাগ করে দুই স্ত্রীকে খাওয়ালেন। এর ফলে দুই স্ত্রী অর্ধেক বাচ্চার জন্ম দিলো। রাজা রেগে গিয়ে অর্ধাংশ দুইটি বনে ফেলে দিতে নির্দেশ দিলেন। সেই বনে জরা নামক এক রাক্ষসী বসবাস করতো। সে দুইটি অর্ধাংশ দেখতে পেল এবং অর্ধাংশ দুইটি যুক্ত করে একটি পূর্ণ বাচ্চা বানাল। জরা বাচ্চাটিকে রাজার কাছে নিয়ে গেল এবং ফেরত দিয়ে দিল। জরা বাচ্চাটির দুইটি অংশ জুড়ে দিয়েছিল, তাই বাচ্চাটির নাম রাখা হলো জরাসন্ধ। জরা দ্বারা সন্ধ। 

আরও পড়ুন

আমাদের বিয়ের দিনও বৃষ্টি, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে বসেছিল কবিতাপাঠের আসর

সভাপর্বে যখন দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীমের সঙ্গে যুদ্ধ হয় জরাসন্ধের এবং ভীম তাঁর প্রচণ্ড বাহুবলে জরাসন্ধের দেহ দ্বিধাবিভক্ত করে, তখন বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশে তাঁর দেহের দুটি অংশ দুই বিপরীত দিকে ছুঁড়ে দেয়, নাহলে পূর্বের ন্যায় আবার দেহের অংশ দু'টি জোড়া লেগে যাবে। 

কাহিনি এই। কিন্তু তা মহাকাব্যিক বা পৌরাণিকভাবে। তাহলে আজকের দিনের বা কবিতাটি লিখিত যখন হচ্ছে, তখনের জরাসন্ধ কে? কে হতে পারে? 

এর উত্তরে বলতে হয়, এই জরাসন্ধ আসলে আর কেউ নয়, এক যুবা পুরুষ। যার কাছে হয়ত এমনই এক প্রায় অমরত্বের এবং অপরাজেয় থাকার আশীর্বাদ থাকলেও, জীবনের ভার সে নিতে আর সক্ষম নয়; আর তাই সে তার জন্মদাত্রী মায়ের কাছেই প্রশ্ন করছে—

‘আমাকে তুই আনলি কেন, ফিরিয়ে নে’

এই ফিরে যাওয়া কেবল হতাশার কারণে নয়, বরং এক শান্তির খোঁজে। ফিরে যাওয়া সেই শৈশবে, যা এখনও পৃথিবীতে পৃথিবীর সমস্ত কলুষ, ক্লান্তি ও দুঃসহ যন্ত্রণার অতীত হয়েই থাকে। যদিও, কবিতার পুরুষটি জানে যে এহেন ফিরে যাওয়া কখনওই সম্ভব নয়। 

অথবা, এই কবিতার পুরুষ এখানে সন্তান নয়, বরং এক পিতা। কবিতার লাইন ‘...তাঁকে তোর মায়ের হাতে ছুঁয়ে ফিরিয়ে নিতে বলি’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, ‘তোর মায়ের হাতে’ অংশটি ভেবে নেওয়া যায় যদি, তাহলে বলতে হয় যে, নারীটি তাঁর স্ত্রী, যে জন্ম দিয়েছে তাঁদের সন্তানের। আর এই সন্তান আরেকভাবে জন্ম দিয়েছে কথকের। কেননা, সন্তান পিতা বা মাতা উভয়কেই এক আশ্চর্য অনুভূতির মাধ্যমে এক ভিন্ন অস্তিত্ব ও বাস্তবতার সামনে এনে দাঁড় করায়, যা কিনা এক আবিষ্কার। এই ‘ফিরিয়ে নে’ কথাটি হয়ত পিতা হিসেবে কথকের কোনো ব্যর্থতারই ইঙ্গিতবাহী। 

কিন্তু, এই ধারণা ভেঙ্গে যায় পরের স্তবকে। কেননা, এখানেও ‘মা’ শব্দটি পাওয়া যাচ্ছে এবং যেভাবে পাওয়া যাচ্ছে, তাতে ওই নারীটিকে ‘মা’ হিসেবেই ভাবতে হবে, অন্য কোনো নারী (কথকের স্ত্রী ও তাদের সন্তানের মা) হিসেবে ভাবা সম্ভব নয়। অতএব, এভাবে ধরে নিতে হচ্ছে যে, এখানে যে নারীচরিত্রটি রয়েছে, সেটি যত না একটি চরিত্র, তারও বেশি একটি সত্তা, যা স্ত্রী হিসেবে এবং মা হিসেবে, উভয়ভাবেই প্রকট। যাইহোক, এই অংশে উল্লেখযোগ্যভাবে উল্লেখ করা আছে রান্নাঘরের বেশ কিছু অনুষঙ্গ, যা স্বভাবতই ‘মা’-এর চেনা ও বড় আপন ক্ষেত্র। এবং এক্ষেত্রে বলতেই হয় যে এখানের ‘অনঙ্গ অন্ধকার’, ‘জরা’ যেভাবে ক্ষুধা ও তার নিবারক খাদ্যকে বোঝাচ্ছে এবং তার প্রস্তুতকারিণী ও সেহেতু আমাদের কর্ত্রী মা-কে বোঝাচ্ছে, তেমনই, আমাদের শারীরিক অস্তিত্ব রক্ষায় যে সর্বাপেক্ষা খাদ্যেরই গুরুত্ব সর্বাধিক, তারও যেন ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

আরও পড়ুন

নিজের বেডরুমেই ভৌতিক অভিজ্ঞতা হয়েছিল শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের!

এর কিছু ভিন্নতর সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও টানা যায়— শক্তির এই কবিতাটি ১৯৫০ এর দশকে লিখিত। আর আমরা জানি যে ১৯৫০ এর দশক খুব একটা শান্ত ছিল না, বরং নানান কারণে অস্থির ছিল, আর যার মধ্যে অন্যতম প্রধান হয়ে উঠেছিল দেশভাগজনিত উদ্বাস্তু সমস্যা এবং সেই কারণে দেখা দেওয়া খাদ্যের চরম সংকট ও ব্যবস্থাপনার ত্রুটিও। কিন্তু, একটি শিশু দেশ বোঝে না, রাজনীতি বোঝে না, দেশভাগ বোঝে না, বোঝে কেবল তার ‘মা’-কে। আর তার যাবতীয় দাবি থাকে তার মা-কে ঘিরেই। যখন একটি শিশুর খিদে পায়, তখন শৈশবে তা জানানোর ভাষা থাকে কান্না, আর সেই কান্নাই কথায় বদলে যায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। আবার যখন আরও বড়ো হয় সেই অতীতের শিশুটি, এবং দেখে প্রতিদিনই তার সামান্য খাবারের অভাব, তখন তা তার চূড়ান্ত ক্ষোভের জন্ম দেয় এবং হয়ত এই ক্ষোভই একটি শ্লেষাত্মক লাইন ‘আমাকে তুই আনলি কেন, ফিরিয়ে নে’ হয়ে ধরা দেয় কবিতায়, যা আসলে আমাদেরই দৈনন্দিন একটি কথার প্রায় সমার্থক—

‘খাওয়াতে পারবে না তো জন্ম দিলে কেন?’

এছাড়া এই ‘অনঙ্গ অন্ধকার’ হলো সেই সামাজিক, রাজনৈতিক, দৈনন্দিন অবস্থা, যার কোনও রূপ বা আকৃতি নেই, কিন্তু উপস্থিতি ও প্রভাব রয়েছে। ‘জরা’ শব্দটি ততোধিক তাৎপর্যপূর্ণ। আসলে এই শরীর ঘিরেই শৈশব, যৌবন, জরা আসে। আর প্রাণ কিন্তু বহন করে এই শরীরই। এই কথা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। এখানে ‘তোর জরায় ভর ক'রে এ আমায় কোথায় নিয়ে এলি’ লাইনটিকে এভাবে ভেবে নেওয়া যায় না কি— কাঁটাতার পেরিয়ে এক মা তাঁর সন্তানকে কোলেপিঠে করে আনছেন আরেক দেশে— আর সেই সন্তানই বড় হয়ে বলছে এ কথা; আসলে এখানে ‘জরা’ সেই বাহক শরীর ছাড়া আর অন্য কিছুই নয়। অন্যদিকে, ‘জরায় কঠিন বাঁধন দিস’ লাইনটি যেন ক্রমশ ক্ষয়ে আসা সেই মাতৃশরীরকেই বোঝাচ্ছে। 

‘আমার যা-কিছু আছে তার অন্ধকার নিয়ে নাইতে নামলে...’

লাইনটিতে ‘অন্ধকার’ কী? আর ‘আমার যা-কিছু আছে তার অন্ধকার’ বলতে কী বোঝানো হচ্ছে? আসলে পাপ পুণ্যে ভরা আমাদের জীবন। এখানে যত না পূণ্য আছে, আলো আছে, তার চেয়ে ঢের বেশি আছে ‘অন্ধকার’, ‘পাপ’; এখানে তাই নিজের স্পর্শ বা নিজের সম্পূর্ণ অস্তিত্বে একটি পাপের বা অন্ধকারের মান্যতা এনে দিচ্ছেন কবি বা কবিতার মধ্যে থাকা সেই বক্তা। 

‘তবে হয়তো প্রসব করেছিস জীবনের ভুলে’

এই লাইন, এ ভাবনা এবং দর্শন চিরন্তন। কেননা, এর চেয়ে বাস্তব সত্য আর কোথাও কোনোভাবেই নেই। মৃত্যু আসলে জীবনের থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়, আর তা হতেও পারে না। মৃত্যু আসলে জীবনের একটি অঙ্গ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ বললেও কোনো ভুল হয় না। আর মৃত্যু তো মনের হয় না, বা আত্মার হয় না। মৃত্যু হয় শরীরের। আর শরীরই জন্মায়, বেড়ে ওঠে এবং তারই অবশেষে মৃত্যু হয়। ফলে যখন এই লাইনটি পড়া হচ্ছে, তখন আমাদের মধ্যে কি এই ভাবনা একবারের জন্যও আসে না যে, মা যে সন্তানের জন্ম দিয়েছেন পৃথিবীতে নতুন একটি জীবন হিসেবে, তা আসলে জীবনকে জন্ম দেওয়া নয়, বরং মৃত্যুকেই জন্ম দেওয়া এবং ওই মায়ের সন্তান যতখানি না বেড়ে উঠছে, আসলে বেড়ে উঠছে তাঁর ভেতরে থাকা মৃত্যুই। আর তাই কবিতাটা শেষ হচ্ছে সেই পুনরাবৃত্তি দিয়ে। শুরুর লাইন দিয়েই। একইসাথে একাধিক আর্তি রেখে—

‘আমাকে তুই আনলি কেন, ফিরিয়ে নেনে।’

More Articles