ওয়ান ব্যাটল আফটার অ্যানাদার: যে রাজনৈতিক ছবি এখানে হবে না

When Hollywood Dares and Bengal Hesitates: হলিউডের মতো স্কেলে না হলেও, ‘ওয়ান ব্যাটল আফটার অ্যানাদার’-এর সমমনস্ক ছবি এই দেশেও হতে পারত, কিন্তু আর হবে না। আমার মনে পড়ছে নবারুণ ভট্টাচার্যর ‘যুদ্ধ পরিস্থিতি’-র কথা।

এইবার পুজোয় যখন বাঙালির ‘ডাকাত ১’, ‘ডাকাত ২’, ‘ডাকাত ৩’, ‘তোপসে ১’ নিয়ে ব্যস্ততা ‘কান্তারা ২’-এ গিয়ে ঠেকবে, তখন দুটি ছবি তুলনামূলক নীরবে প্রেক্ষাগৃহে চলেছে। একটি নীরজ ঘাওয়ানের ‘হোমবাউন্ড’, যেটা অস্কারের জন্য ভারতীয় ছবি মনোনীত হওয়ায় কিছুটা দর্শক টেনেছে। অন্যটি পল টমাস অ্যান্ডারসনের ‘ওয়ান ব্যাটল আফটার অ্যানাদার’। এই দ্বিতীয় ছবিটা নিয়েই দু'কথা বলছি। প্রথমে গল্পটার চুম্বক দেওয়া যাক।

(১)

একখানি বৃহৎ গণতন্ত্র, কিন্তু গণতন্ত্রের ফাঁকফোকর দিয়ে সেই দেশে সংখ্যাগুরুর শাসন প্রায় ফ্যাসিজমের আকার নিচ্ছে। সংখ্যালঘুদের, বহিরাগতদের অবৈধ অভিবাসী তকমা দিয়ে ডিটেনশন ক্যাম্পে আটকে রাখা হয়, বিশেষ করে সীমান্তের অঞ্চলে। একটি অতিবামপন্থী রাজনৈতিক দল এই সমস্ত ক্যাম্প ও অন্যান্য সরকারী প্রতিষ্ঠানে সশস্ত্র হামলা চালিয়ে বন্দিদের মুক্ত করে, বিভিন্ন সরকারি নিয়মকানুনের চিৎকৃত, ডিসরাপ্টিভ বিরোধীতা করে। এই দলের নেতৃত্বে আছে এক সংখ্যালঘু মহিলা, আগুনখোর, আকর্ষনীয়। তাঁর প্রেমিক একজন তুলনামূলক নরম পুরুষ, এখনও মধ্যবিত্ত আড়ষ্টতা যার চোখেমুখে বিদ্যমান। এদের সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষ বাঁধে একজন সামরিক অফিসারের। এই লোকটির মানসিকতা সাম্প্রদায়িক; কিন্তু তাঁর একটি পার্ভার্শন আছে। যাদের সে ঘৃণা করে, সেই জনগোষ্ঠীর আকর্ষণীয়া নারীদের প্রতি তাঁর অবদমিত যৌনক্ষুধা। তাঁর সঙ্গে সেই দলনেত্রীর একটি আচমকা যৌনসম্পর্ক হয় এবং এক সময়ে সেই নেত্রীকে সে গ্রেফতার করে। অচিরেই সেই দলের সমস্ত কর্মী বন্দি হয়, নয় এনকাউন্টারে মারা যায়, নয় আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যায়। সেই যে দলনেত্রী, তাঁর একটি সদ্যজাত কন্যাকে নিয়ে তাঁর প্রেমিক গা-ঢাকা দেয়।

১৬ বছর পেরিয়ে গেছে। সেই পিতা এবং কন্যা এখন নাম, পরিচয় পালটে জীবন অতিবাহিত করছে এমন একটি শহরে যেখানে এরকম মানুষের ‘সেফ’ আস্তানা। কিন্তু সেই নিরাপত্তা টিকল না। সেই যে সামরিক অফিসার, তিনি এখন একটি উচ্চমার্গের সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীতে সদস্যপদ চান। কিন্তু গোকূলে বাড়িছে সেই যে দলনেত্রীর কন্যা, যে তাঁর ঔরসজাত হতে পারে, অর্থাৎ যে কিনা প্রমাণ যে তাঁর একটি আপত্তিকর রাজনীতির সংখ্যালঘু মহিলার সঙ্গে সাময়িক যৌনসম্পর্ক ঘটেছিল। সেই মেয়েটির অস্তিত্ত্ব তো তাঁর ক্ষমতার উচ্চাকাঙ্খার পথে অন্তরায় হয়ে যাবে! সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং অতিবামপন্থী বিপ্লবীদের ক্রিমিনাল তকমা দেওয়া সহজ। অতএব, সেইরকম ক্রিমিনালদের ক্র্যাকডাউন করার সরকারি ব্যবস্থা করে তিনি মিলিটারি নিয়ে সেই শহরে হানা দেন। সরকারি দৃষ্টিতে, একটি জনগোষ্ঠীকে ‘নিয়ন্ত্রণ’ করা হচ্ছে; এই সামরিক অফিসারের উদ্দেশ্য, সেই অপারেশনের অজুহাতে তাঁর একদার ‘স্খলন’-এর প্রমাণ লোপাট করা, সেই পিতা-কন্যাকে মুছে দেওয়া। এরকম গল্প, এরকম রাজনৈতিক প্রেক্ষিত, এরকম দেশের কথা কি খুব অচেনা লাগছে?

হলিউডের মতো স্কেলে না হলেও, ‘ওয়ান ব্যাটল আফটার অ্যানাদার’-এর সমমনস্ক ছবি এই দেশেও হতে পারত, কিন্তু আর হবে না। আমার মনে পড়ছে নবারুণ ভট্টাচার্যর ‘যুদ্ধ পরিস্থিতি’-র কথা। কিন্তু অ্যান্ডারসনের ছবিতে যা ঘটছে তা আরেকটু ভিন্ন, সেই নিয়েই কিছু কথা বলব। পল টমাস অ্যান্ডারসন অধুনার হলিউডের অগ্রগণ্য auteur-দের একজন, তাই তাঁর ছবির অবস্থান ‘বাজারী’ মূলধারার প্রান্তে, কিন্তু সাংস্কৃতিক কৌলীন্যের কেন্দ্রে। ‘ওয়ান ব্যাটল আফটার অ্যানাদার’ তাঁর সবচাইতে সহজপাচ্য ছবি, সবচাইতে খরচসাপেক্ষ, স্পেক্টাকুলার ওয়ার্নার ব্রাদার্স প্রযোজিত ছবি। এই ছবিতে অ্যাকশন এবং কমেডির যথেষ্ঠ উপাদান আছে; এক কথায়, ছবিটি উপভোগ্য। তাঁর ছবির লয় সাধারণত ধীর হয়, কিন্তু এই ছবি প্রথম দৃশ্য থেকেই তীব্র গতিতে বাঁধা এবং সেই গতি শ্লথ হয় খুব কমই।কিন্তু, সেই উপভোগ্য সহজপাচ্যতার মধ্যেই তীব্রভাবে বলা আছে যে ট্রাম্পের আমেরিকা একটি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র। সেই পরিস্থিতিতে র‍্যাডিকাল তীব্র বামপন্থী ধারার অতীতের প্রতি ক্রিটিকাল থেকেও ছবিটি সেই রাজনৈতিকতার প্রতি সমর্থনে অটল থাকে। অন্তত সেই রাজনৈতিক বিরোধীতা যে প্রচন্ডভাবে প্রয়োজন, সেই প্রত্যয়ে ছবিটির কোনো দ্বিধা নেই।

‘ওয়ান ব্যাটল আফটার অ্যানাদার’ তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে এতটাই অকপট যে ছবিটা মার্কিন সমাজকে দ্বিধাবিভক্ত করে দিয়েছে। প্রথম সপ্তাহে বক্স অফিস চমকে দিলেও হয়ত ছবিটি ফ্লপ করবে। সমালোকরা প্যাশনেটলি প্রশংসা করলেও দক্ষিনপন্থীরা ছবিটির ‘দায়িত্বজ্ঞানহীনতা’ নিয়ে হামলে পড়েছে। কিন্তু যে ব্যাপারটা বোঝা যাচ্ছে সেটা হলো ছবিটি প্রবলভাবে সাহসী এবং ওয়ার্নার ব্রাদার্সের মতো প্রতিষ্ঠানও ছবিটির পৃষ্ঠপোষকতায় দ্বিধা করেনি। আমাদের বাঙালি বামপন্থীদের যে সরলীকৃত ধারণা আছে হলিউডের রাজনীতি নিয়ে, তা একেবারে উলটে দিয়ে সেই দেশের দক্ষিণপন্থীদের উষ্মা প্রকাশ পাচ্ছে, হলিউডে বড্ড বামপন্থীদের আধিপত্য!

‘ওয়ান ব্যাটল আফটার অ্যানাদার’-এ আপনি গতানুগতিক ভাবে রাজনীতি দেখতে গেলে গুলিয়ে যাবে। এই ছবির অতিবাম গোষ্ঠীটির নাম ‘ফ্রেঞ্চ সেভেন্টিফাইভ’— এরা কারা? তারা কি Antifa? কিন্তু তারা তো হালের; ১৬ বছর আগে তো ওবামার সরকার— তখন এরকম ট্রাম্পীয় রাষ্ট্র ছিল নাকি? এরকম প্রামাণ্যতা ছবিটা দিতে চায় না। এই গল্পে ট্রাম্প ঘরানার স্বৈরতন্ত্র হলো এক রকম ‘perpetual present’, যেন আমেরিকা সর্বক্ষণ এই অবস্থায় ছিল। এই চিরায়ত সমসময়ের ফেবলধর্মীতা না বুঝলে এই ছবি বোঝা যাবে না। অনেকেই হয়ত এরকম উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অনৈতিহাসিকতায় অভ্যস্থ নন, তারা ছবিটার সমালোচনা করবেন হয়ত এই পয়েন্টে। কিন্তু আমার অ্যান্ডারসনের এই পদ্ধতিটা বেশ সাহসী লেগেছে। তাঁর কাছে প্রায়োরিটি হলো আমেরিকার বর্তমান শাসকদের (ট্রাম্পের নাম না করেও) ফ্যাসিস্ট বলা; তার জন্য যদি প্লটের প্রামাণ্যতায় টান পড়ে তিনি পিছপা হচ্ছেন না। এই ব্যাপারটা নিয়ে ছবিটায় চমকপ্রদ একটি রসবোধের ইঙ্গিত আছে। লিওনার্দো দি ক্যাপ্রিও অভিনীত নায়ক, বিপ্লবের ব্যর্থতার ১৬ বছর পর নেশাসক্ত ভগ্ন একটি মানুষ (বাড়িতে বসে বসে গিলো পন্টিকার্ভোর ‘ব্যাটল অফ অ্যালজিয়ার্স’ দ্যাখে। কন্যার বিপদের সময়ে সে কিছুতেই একটি গুরুত্বপূর্ণ পাসওয়ার্ড মনে রাখতে পারে না। পরে তাঁকে জানানো হয় পাসওয়ার্ডটি— "Time does not exist, yet it controls us"– আসলে ছবিটা নিজেকে নিয়েই কথা বলছে। ছবিটায় ‘ইতিহাস’-এর অস্তিত্ত্ব নেই, অথচ সমসম ছবিটাকে নিয়ন্ত্রণ করছে।
                                                                  (২)
কিছুদিন আগে হোয়াইট হাউজ থেকে একটি নথি প্রকাশিত হয়েছে (নেটে পাবেন) - ‘Countering Domestic Terrorism and Organized Political Violence’ শীর্ষক, তাতে বলা আছে –

“There are common recurrent motivations and indicia uniting this pattern of violent and terroristic activities under the umbrella of self-described “anti-fascism.” These movements portray foundational American principles (e.g., support for law enforcement and border control) as “fascist” to justify and encourage acts of violent revolution. This “anti-fascist” lie has become the organizing rallying cry used by domestic terrorists to wage a violent assault against democratic institutions, constitutional rights, and fundamental American liberties. Common threads animating this violent conduct include anti-Americanism, anti-capitalism, and anti-Christianity; support for the overthrow of the United States Government; extremism on migration, race, and gender; and hostility towards those who hold traditional American views on family, religion, and morality.”

অর্থাৎ, ট্রাম্প সরকারকে ‘ফ্যাসিস্ট’ বলা যাবে না। উপরের উদ্ধৃতিতে বলা আছে যে কোনো ধরণের প্রবণতা ট্রাম্পের সরকারকে ফ্যাসিস্ট বলবে। ভেবে দেখবেন, আম মধ্যবিত্ত বাঙালির সুরও এখন ট্রাম্পের সুরের সঙ্গে মেলে। আমরা ভাবি যে যারা ভারতীয়ত্ব-বিরোধী, সনাতনধর্ম-বিরোধী, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি, অস্বীকৃত নাগরিকদের প্রতি সমব্যাথী, পরিবার-ধর্ম-নৈতিকতার ঐতিহ্যের ব্যাপারে ক্রিটিকাল, শুধু তাই তারাই রাষ্ট্রকে ফ্যাসিস্ট বলে। ‘ওয়ান ব্যাটল আফটার অ্যানাদার’ ট্রাম্প, MAGA, রিপাবলিকানদের নাম না করেই বলে যে এই চিরায়ত সমসময়ের মার্কিন রাষ্ট্র ফ্যাসিস্ট, বা ফ্যাসিজমকামী। বিপ্লব ছাড়া এর হাত থেকে মুক্তি নেই। কিন্তু বিপ্লব আসে না, বিপ্লব ব্যর্থ হয়। সমস্ত বিপ্লব-প্রচেষ্টা ভেঙে পড়ে একসময়ে। কিন্তু উপায় তো নেই, তাই চালিয়ে যেতে হবে, এক সংগ্রামের পর আরেক সংগ্রাম। নিরন্তর!

আরও পড়ুন

অ্যানিমাল: এমন জান্তব সিনেমা কি শুধুই বিনোদন? কাদের জন্য?

কিছু প্রগতিশীল মানুষের কাছে এই ছবির প্রথমার্ধের নায়িকার চরিত্রটি ‘পলিটিকালি ইনকারেক্ট’ লাগবে। তাঁরা ছবিটাকেই উলটে রেসিস্ট ও মিসোজিনিস্ট তকমা দিয়ে দেবেন, বলবেন ছবিটার বামপন্থা ঠুনকো। আমি তাঁদের সমালোচনার ধরণটা শুনতে আগ্রহী, কিন্তু আমার দেখতে দেখতে ভিন্ন কথা মনে হয়েছিল। এই নায়িকার নাম পার্ফিডিয়া। এই নামে বিখ্যাত স্প্যানিশ একটা গান আছে। অতএব নামটা শোনা মাত্রই বোঝা গিয়েছিল এই অতিবাম দলনেত্রী প্রতারক হবেন। এবং এই ধরণের গল্পে ও দলে প্রতারণা একরকমেরই– পুলিশের চাপের মুখে দলের অন্যান্যদের নামধাম বলে দেওয়া। কিন্তু আবারও, আমার চরিত্রটাকে অচেনা লাগেনি। তাঁর যৌন তীব্রতাকে আমি রাজনৈতিক প্রতিরোধের অ্যাড্রিনালিন রাশ হিসেবেই দেখেছি। চরিত্রটি ক্যারিশ্মাটিক, নিজের ক্ষমতাকে ভালবাসে। কোথাও একটা মানুষের হিতের চাইতেও নিজের ইগো প্রাধান্য পেয়ে যায়। এই যে সর্বক্ষণ প্রতিষ্ঠান-বিরোধীতা, তাঁর উত্তেজনাটাই যেন এম্প্যাথির চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তাঁর কাছে। স্বাধীনতা তাঁর কাছে এতটাই সর্বস্ব যে তাঁর জন্য যে বিপ্লবপ্রচেষ্টা ব্যর্থ হলো, তার হাল ছেড়ে দিতেও তিনি রাজি; পরেরবার দেখা যাবে। একজন কৃষ্ণাঙ্গ দলনেত্রী হয়ে ছবির একমাত্র খুন তিনি করেন, ব্যাঙ্কডাকাতি করতে গিয়ে একজন প্রৌঢ় কৃষ্ণাঙ্গ ব্যাংক রক্ষী তাঁর হাতে নিহত হয়। এই দৃশ্যটিই ছবির সবচাইতে বিতর্কিত দৃশ্য হতে চলেছে। কিন্তু আমি যখন দেখছিলাম, যেভাবে দৃশ্যটি নির্মিত হয়েছে, বুঝতে পারছিলাম যে এই বিপ্লবপ্রচেষ্টা এই মুহুর্তেই ব্যর্থ হলো। এবং যেন সেই দলনেত্রীও বুঝতে পারছিলেন ট্রিগারটা টিপে। আমার মনে পড়ছিল যে নকশাল আমলে শ্রেণিশত্রু খতমের নামে কাদের খতম করা হয়েছিল? গরিব কনস্টেবল (অমুক গুহনিয়োগীকে কেউ স্পর্শও করতে পারেনি), শিক্ষক ইত্যাদিদের।

‘ওয়ান ব্যাটল আফটার অ্যানাদার’ নারী বা কৃষ্ণাঙ্গ বলেই যে অপাপবিদ্ধ হতে হবে চরিত্রকে তা মনে করেনি। আবার এই চরিত্রটি দেখে কারুর যদি মনে হয় যে তিনি বলছেন নারী বা কৃষ্ণাঙ্গদের দ্বারা বিপ্লব সাধিত হবে না, তাঁরা ফ্যাশনেবল অ্যাক্টিভিস্ট মাত্রই– আমি পর্দায় কোনো একটি চরিত্রকে একটি জনজাতির প্রতিনিধি হিসেবে দেখি না। ‘ওয়ান ব্যাটল আফটার অ্যানাদার’ ট্রেন্ডিং হওয়ার চেষ্টা করে না, সেফ খেলে না।
                                                                  (৩)
এরকম ছবি এখন বাংলা ভাষায় আর করা সম্ভব? এতটা সোজাসাপ্টা? মনে হচ্ছে, না। তাই, যে ভাবনাটা আমাকে ভাবাচ্ছে সেটা হলো এই ছবির ‘সমমনস্ক’ বাংলা ছবি আর বানানো যাবে না কেন? প্রথমত, ‘ওয়ান ব্যাটল আফটার অ্যানাদার’-এর অন্যতম বৈশিষ্ট্যটি যেরকম বললাম, একেবারেই পপুলার ঘরানায় বাঁধা। আমাদের বামপন্থী সিনেমার অন্যতম ভ্রান্তি হলো আমরা ৭০ দশক থেকে সিনেমায় পপুলার ক্ষেত্রকে সাংস্কৃতিক রাজনীতির ক্ষেত্র বলে মনে করিনি। সেই ফর্মে রাজনীতি কীভাবে ক্রিয়াশীল হয় তার কোনো ধারণা আমদের নেই বা ভুল ধারণা আছে। সদর্থে যে ক্ষেত্র সাধারণ মানুষ বা শ্রমজীবি মানুষদের বিনোদনের ক্ষেত্র, সেই পরিসরে বামপন্থীদের কিছু করার আছে বলে আমরা মনে করিনি, এমনকি বিনোদন নিয়েও বামপন্থী ছবি কী করবে তা নিয়ে আমরা নিশ্চিত নই। আমাদের মনে হত, রাজনৈতিক সিনেমার পরিসর শুধুমাত্র বিকল্প সিনেমাতেই হবে। কিন্তু সেই বিকল্প সিনেমার ক্ষেত্রটা যে ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে, অপর্যাপ্ত হয়ে, কর্পোরেট-দাক্ষিণ্যে ফেস্টিভাল-কেন্দ্রিক কৌলীন্যপ্রার্থী হয়ে মিনমিনে নান্দনিক মধ্যবিত্ত-সংকীর্ণ হয়ে যেতে পারে, তা আমাদের ভাবনায় আসেনি (অথবা আমরা তাই চেয়েছি)। যাবতীয় রক্ষণশীলতা জুটে এসে বসার জন্য সেই মাঠটাকে আমরা ফাঁকা রেখে দিয়েছিলাম। তাই ‘ওয়ান ব্যাটল আফটার অ্যানাদার’-এর সমধর্মী ছবি আমাদের পক্ষে বানানো সম্ভব নয়।

দ্বিতীয়ত, বৈপ্লবিক, বামপন্থী, প্রগতিশীল ভাবনাকে বাঙালি আপাতত কি আইরনি— সোশাল মিডিয়াকেন্দ্রিক অ্যাক্টিভিজমে পর্যবসিত করে ফেলেছে। এমনকি ফাংশনাল রাজনীতিতেও তার প্রভাব ধীরে ধীরে আরও কমবে। অর্থাৎ, যতই পথে নামা হোক, রাত জাগা হোক, সেই অতিব্যস্ততা কিন্তু মানুষকে এই প্রত্যয় দেবে না যে অপদার্থ দুর্নীতিগ্রস্থ সরকারকে ফেলে দেওয়ার জন্য অশুভ সাম্প্রদায়িক দক্ষিণপন্থীদের রাস্তা সুগম করতে নেই। রাত জেগে পথ গরম করা যত চলেছে, ততই উল্টোপিঠে বাংলার মধ্যবিত্তে দক্ষিণপন্থী অসহিষ্ণু সাম্প্রদায়িক উচ্চারণ ত্বরান্বিত হয়েছে। এবং আমার কাছে এটা জরুরি - পুঁজিবাদের চরম আগ্রাসন ও ক্লাইমেট ক্রাইসিসের সংকটের মধ্যে দিয়ে যে আমরা চলেছি, তা নিয়ে বিন্দুমাত্র সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে না। অতএব, ক্রিটিকাল রাজনৈতিক শিল্প আর সংস্কৃতির ধরণটা যে কী, তা কী করে, সেই নিয়ে বাঙালির বোধ আপাতত তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। তাই, ‘ওয়ান ব্যাটল আফটার অ্যানাদার’-এর সমমনস্ক ছবি বানানোর বোধ আর আমাদের নেই।

তৃতীয়ত, আসলে বৈপ্লবিক আধুনিকতার ভ্যালিডিটিই আমরা সিস্টেমেটিকালি নষ্ট করেছি। বৈপ্লবিক আধুনিকতা মানে এই বোধজগৎ যে অপ্রেসিভ শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের একধরণের ক্রিটিকালি অ্যাগ্রেসিভ রাজনৈতিকতা যেখানে শাসনতন্ত্রের উৎখাত কাম্য। শাসনতন্ত্র বললাম, কোনো নির্দিষ্ট পার্টির কথা বলিনি। ‘ওয়ান ব্যাটল আফটার অ্যানাদার’ শুরু হচ্ছে এই উক্তি দিয়ে—

“The message is clear. Free borders, free bodies, free choice and free from f___g fear!”

“Nothing is secure. Everything is wrong. No one is above suspicion”

আর শেষ দৃশ্যে, যখন কন্যা প্রতিবাদ সভায় যাচ্ছে, পিতা বলছে “Be Careful”, কন্যা হেসে বলছে - “I won’t” - এই সংলাপগুলোর আদপেই আমাদের অচেনা নয়। কিন্তু এই উচ্চারণগুলির জন্য যে বৈপ্লবিক আধুনিকতার সেন্সিবিলিটি লাগে, তার গুরুত্ব যে আর নেই, তার প্রমাণ বাংলাভাষায় লেখা সোশাল মিডিয়ার কমেন্টে ছত্রে ছত্রে প্রমাণিত হয়। মার্কিন দেশে ট্রাম্প ক্ষমতায় আছে; কিন্তু এই বিরোধী উচ্চারণের ভ্যালিডিটি নষ্ট হয়ে যায়নি, বরং বাড়ছে। এইখানে নষ্ট হয়ে গেছে। ইস্যুভিত্তিক প্রতিবাদ, যা শুধুই শাসকের অপসারণ চায়, শাসনতন্ত্রের নয়, তা আদপেই এইরকম উক্তির সমধর্মী নয়। এই ধরণের উক্তি আমাদের এখন ক্লিশে লাগে।

আরও পড়ুন

সত্যিই কি ওপেনহাইমার শতাব্দীর সেরা সিনেমা? নাকি…

এই ছবির শেষে কন্যা মায়ের লেখা একটি চিঠি পড়ে, যে মাকে সে চোখেও দেখেনি এবং যে মা হয়ত বিপ্লবের প্রতারক। সেই চিঠিতে লেখা থাকে যে তাদের দিনবদলের লড়াই খুঁতে ছিল, হয়ত তার কন্যার লড়াইয়ে সেই খুঁত থাকবে না। ‘Change the World’— এই কথাটি স্পষ্ট উচ্চারিত হয়। এই চিঠিটাও আর বাংলা ভাষার ছবিতে এমনভাবে লেখা সম্ভব নয় যাতে মনে না হয় যে দর্শক বলবেন, সেই চর্বিতচর্বণ ক্লিশে! হ্যাঁ, আমাদের দর্শকের সেটা মনে হবে। কারণ আমাদের হৃদয়েই আর সেই বিশ্বাস নেই। সেই বিশ্বাস নিহত হয়েছে, প্রতারিত হয়েছে, তার আর কোনো সম্মান নেই। তাই, ‘ওয়ান ব্যাটল আফটার অ্যানাদার’-এর সমব্যাথী ছবি বানানোর হৃদয় আর আমাদের নেই।
                                                                 (৪)
‘ওয়ান ব্যাটল আফটার অ্যানাদার’ রাজনৈতিক বিকল্প ছবি নয়, পলিটিকাল আভাঁ-গার্দ ছবি নয়। এই ছবি বলে যে একেবারে মূলধারাতেই এই রকম মানুষদের নিয়ে এম্প্যাথেটিক গল্প বলা সম্ভব। কিছুদিন আগেই ঢাক-ঢোল পিটিয়ে ‘ধুমকেতু’ মুক্তি পেয়েছে। সেই ছবি সুপারস্টার দেবের ফ্যানদের কিঞ্চিত বিভ্রান্ত করেছে; এবং সেই ছবিতে নায়ক যে টেরোরিস্ট, এই ব্যাপারটি সমালোচিত হয়েছে। ‘ধুমকেতু’-র নায়ক প্রতিবাদী, তা সে ভরা বাজারে সুইসাইড বম্বিং-এর মিশনে আসে। আমাদের পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে এরকম কোনো টেরোরিজম ছিল? নকশালপন্থীরা এরকম মাস-মার্ডার করেছে, এমনটা আমরা শুনেছি কি? ‘ওয়ান ব্যাটল আফটার অ্যানাদার’-এ অতিবাম গোষ্ঠীটি বাংক ডাকাতি করতে যায়; তখন কৃষ্ণাঙ্গ নায়িকার গুলিতে একজন ব্যাংকরক্ষী মারা যান, তিনিও কৃষ্ণাঙ্গ। এবং বোঝা যায় যে এই একটি হত্যাই মুভমেন্টটাকে ধ্বংস করে দিল। এই ছবিতে সমস্ত সহিংস রাজনৈতিকতাকে একইরকম ধাঁচে ফেলে দেওয়া হয়নি ‘ধুমকেতু’-র মতো। খুবই আশ্চর্য; ইদানিং যে ‘ডাকাতপন্থী’ বাংলা ছবি দেখা যাচ্ছে, সেইখানে নিশ্চয়ই বিদ্রোহে অস্ত্রের ব্যবহার প্রশ্নের সম্মুখীন হবে না।

‘ওয়ান ব্যাটল আফটার অ্যানাদার’ যেখানে শেষ হয়, আমরা যে বোধটা নিয়ে সিট ছেড়ে উঠি, সেটা হলো ছবিটা বিপন্ন বাবা আর মেয়ের গল্প বলে। কীসের বিপন্নতা? ফ্যাসিস্ট, সংখ্যাগুরুবাদের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের আগ্রাসনের সম্মুখীন হওয়ার বিপন্নতা। এই ছবির পিতা ‘নায়ক’ নয়। লিওনার্দো দি ক্যাপ্রিও-র অসাধারণ অভিনয়ে চরিত্রটি কমিক আর প্যাথেটিকের সুসম সংশ্লেষ হয়ে উঠেছে। একদা বৌদ্ধিক বিপ্লবী, এখন যে প্রায় একটি ভাঁড়। মেয়ের জন্য প্যারানয়েড, মেয়েকে মোবাইল ফোন দেয় না। নেশাচ্ছন্ন, ঘরে বসে গিলো পন্টিকার্ভোর ‘ব্যাটল অফ অ্যালিজিয়ার্স’ দেখে। সে আদ্যন্ত পরাজিত একটি মানুষ। কিন্তু একেও নায়কোচিত করে তোলাটা ছবিটির অভিপ্রায়ও নয়। ছবিটি এই চরিত্রটিকে শুধুই একটি স্নেহপ্রবণ বিপন্ন বেচারা পিতার আকার দিতে চায় (কন্যাটি তাঁর ঔরসজাতও নয়)। কিন্তু সেই স্নেহের ভিত হলো একধরণের বৈপ্লবিক রাজনীতির বোধ। আগামী প্রজন্মকে সে কোনো পৃথিবীতে রেখে যাচ্ছে, তাই নিয়ে সে শঙ্কিত থাকে। সেই প্রজন্মের জন্য তাঁর এতটা উৎকন্ঠা, অথচ তাদেরকে যে সে ঠিকঠাক বুঝে উঠতে যে পেরেছে তাও নয়। সে সন্তানকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, কিন্তু তাঁর স্নেহ সেই ‘পিতৃসুলভ’ নিয়ন্ত্রণ করতেও দেয় না। পর্দায় পৌরুষের সমস্ত মাপকাঠিতে সে ফেল করে। শেষে সে বোঝে, তাঁর ১৬ বছরের মেয়েটি বড় হয়ে গেছে, এইবার বরং তাঁর ব্যর্থ জীবনটা কন্যার অভিভাবকত্বে কাটবে। ‘ওয়ান ব্যাটল আফটার অ্যানাদার’-এ যে বোধটা আমাকে সবচাইতে স্পর্শ করেছে সেটা হলো প্রান্তিক ভাবনার মানুষদের বিপন্নতার বোধ এবং সেই বিপন্নতায় কুঁকড়ে না যাওয়ার সাহসের প্রতি সমর্থন—

“You know what freedom is? No fear!”

কিন্তু এই প্রতিটা বোধ হৃদয়গ্রাহী তখনই হয়ে ওঠে যখন চরিত্র দুটির ভিতেই আছে ফ্যাসিবিরোধী বৈপ্লবিক রাজনীতির প্রান্তিকতা। অন্য কোনো ভাবনার (বা ভাবনাহীনতার) গল্পে এই আবেগগুলো আদপেই অনুভব করানো যাবে না। ‘ওয়ান ব্যাটল আফটার অ্যানাদার’ একদমই প্রান্তিক সেন্সিবিলিটির কিছু মানুষের গল্প বলে। কিন্তু ওয়ার্নার ব্রাদার্সের প্রযোজনা বা পল টমাস অ্যান্ডার্সনের টমাস পিনচনের ‘ভাইনল্যান্ড’ উপন্যাসের অবলম্বণে এই ছবিটি একবারের জন্যও ভাবেনি— মানুষ কি আর এই চরিত্রগুলোকে বুঝতে চাইবে? আমরা বাংলা ছবি বানাতে গিয়ে সেই নিয়ে বড্ড ভাববো, এতই ভাববো যে ছবিটাই হবে না। আর পুজোয় নরম ও ন্যাকা পশ্চাদমুখী হিন্দুত্ববাদী ছবি চলবে, কয়েকটিতে দৃশ্যে টোকেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উল্লেখ থাকবে, আর সারাক্ষণ বর্ণ হিন্দু পৌরুষের আস্ফালন। ‘ওয়ান ব্যাটল আফটার অ্যানাদার’-এর মতো আধুনিক অথচ প্রান্তিক সেন্সিবিলিটির প্রতি সহৃদয় ছবি বানানোর এম্প্যাথি আর সাহস আর আমাদের নেই। ছবিটা হলিউডের ছবি, আমরা এককালে কথার আগুন দিয়ে সেঁকে বাংলা খেতাম।

(লেখকের মতামত ব্যাক্তিগত)

More Articles