ভারতে প্রবেশ করতে দেওয়া হলো না! ঠিক কোন বিষয়ে কাজ করেন ফ্রান্সেসকো ওরসিনি?
Francesca Orsini Denied Entry to India: সাম্প্রতিক এই বইয়ে তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে বহু ভাষার মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক বোঝা জরুরি, এবং এক ভাষার ইতিহাসকে অন্য ভাষা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা ভুল।
ভারতের সাহিত্য, ভাষা ও সংস্কৃতিকে যিনি বিশ্বের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন, সেই গবেষক ফ্রান্সেসকা ওরসিনিকেই এবার ঢুকতে দেওয়া হলো না ভারতে। বৈধ ভিসা থাকা সত্ত্বেও দিল্লি বিমানবন্দরে থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হয় লন্ডনে। এই ঘটনায় শিক্ষাজগতে বিস্ময় ছড়িয়েছে। অনেকেই এখন প্রশ্ন করছেন, গবেষণা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কি সত্যিই আর নিরাপদ আছে?
ফ্রান্সেসকা ওরসিনির জন্ম ইতালিতে। তিনি প্রথমে ইউরোপে তুলনামূলক সাহিত্য বিষয়ে পড়াশোনা করেন। পরে ভারতে এসে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় এবং কেন্দ্রীয় হিন্দি সংস্থান (Central Institute of Hindi)-এ হিন্দি ভাষা ও সাহিত্য অধ্যয়ন করেন। বর্তমানে তিনি লন্ডনের এসওএএস (SOAS), ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের হিন্দি ও দক্ষিণ এশীয় সাহিত্য (Hindi and South Asian Literature) বিভাগের অধ্যাপক। তাঁর গবেষণা ক্ষেত্র মূলত হিন্দি ও উর্দু সাহিত্য, ঔপনিবেশিক যুগের ভাষা ও সংস্কৃতি, সাহিত্য ও রাজনীতির সম্পর্ক, দক্ষিণ এশিয়ার বহু-ভাষিক সংস্কৃতি।
তাঁর লেখা বই–
• The Hindi Public Sphere, 1920–1940: Language and Literature in the Age of Nationalism (2002, Oxford University Press)
এই বইটি তাঁর সবচেয়ে পরিচিত কাজ। এখানে তিনি বিশ্লেষণ করেছেন কীভাবে ভারতের জাতীয়তাবাদী সময়কালে (বিশেষ করে ১৯২০–৪০) হিন্দি সাহিত্য এক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের রূপ নেয়। বইটিতে দেখানো হয়েছে হিন্দি ভাষা কীভাবে 'জাতীয় ভাষা' হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়, এবং সাহিত্য কীভাবে সমাজের পরিবর্তনের হাতিয়ার হয়।
আরও পড়ুন
• Print and Pleasure: Popular Literature and Entertaining Fictions in Colonial North India (2009, Permanent Black)
এই বইয়ে ওরসিনি দেখিয়েছেন, ঔপনিবেশিক ভারতে ‘বিনোদনমূলক সাহিত্য’ কীভাবে জনপ্রিয়তা পায়। তিনি বিশ্লেষণ করেছেন কীসের প্রভাবে মানুষ সেই সময় উপন্যাস, গল্প, পত্রিকা পড়তে শুরু করে— যা ভারতীয় পাঠ সংস্কৃতিতে বড়ো পরিবর্তন আনে।
• Before the Divide: Hindi and Urdu Literary Culture (2010, Orient Blackswan)
এই বইয়ে তিনি তুলে ধরেছেন সেই সময়ের কথা, যখন হিন্দি ও উর্দু সাহিত্য আলাদা ছিল না বরং একে অপরের সঙ্গে মিশে একটি যৌথ সংস্কৃতি তৈরি করেছিল। ওরসিনি দেখিয়েছেন কীভাবে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিভাজনের কারণে পরে এই দুই সাহিত্যিক ধারাকে আলাদা করে দেখা হয়।
• Tellings and Texts: Music, Literature and Performance in North India (2015, Open Book Publishers)
এই বইটি একটি সম্পাদিত গ্রন্থ, যেখানে বিভিন্ন গবেষক উত্তর ভারতের সংগীত, কবিতা ও মৌখিক সাহিত্যিক ঐতিহ্য নিয়ে আলোচনা করেছেন।
ওরসিনি এখানে 'পারফরম্যান্স কালচার' বা মৌখিক সাহিত্য ও সংগীতের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন।
• Love in South Asia: A Cultural History (2006, Cambridge University Press)
দক্ষিণ এশিয়ায় প্রেমের ধারণা কীভাবে সময়ের সঙ্গে বদলেছে, ধর্ম, সাহিত্য ও সমাজে তার প্রতিফলন কী, এই বইয়ে সেই বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এটি একাধারে সাহিত্য, সমাজবিজ্ঞান ও ইতিহাসের মেলবন্ধন।
• How to Do Multilingual Literary History: Lessons from Fifteenth- and Sixteenth-Century North India (2020, Oxford University Press)
সাম্প্রতিক এই বইয়ে তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে বহু ভাষার মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক বোঝা জরুরি, এবং এক ভাষার ইতিহাসকে অন্য ভাষা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা ভুল।
ফ্রান্সেসকা ওরসিনি ভারতের সাহিত্যকে কখনও শুধুমাত্র ভাষা বা ধর্মের দৃষ্টিতে দেখেননি। তিনি বিশ্বাস করেন, ভারতীয় সাহিত্য মানে কেবল এক ভাষার ইতিহাস নয়, বরং বহু ভাষার মিলিত সাংস্কৃতিক প্রবাহ। তিনি সব সময় চেষ্টা করেছেন হিন্দি-উর্দু-ফারসি-সংস্কৃত-আওধি ভাষার পারস্পরিক সম্পর্ক বোঝাতে। তাঁর কাজ দক্ষিণ এশিয়ার বহুভাষিক সাহিত্য ইতিহাস (multilingual literary history) নির্মাণে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে।
ভারতের বাইরে ব্রিটেন, ইউরোপ ও আমেরিকার বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি বক্তৃতা দিয়েছেন। ভারতীয় ভাষা ও সংস্কৃতির উপর তাঁর কাজ বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও ফেলোশিপ পেয়েছে। তিনি আন্তর্জাতিক একাডেমিক জার্নালে নিয়মিত লেখেন— বিশেষত Modern Asian Studies, Comparative Studies of South Asia, Africa and the Middle East, ও South Asia: Journal of South Asian Studies-এ।
আরও পড়ুন
বৈধ ভিসা থাকা সত্ত্বেও ভারতে ঢুকতে বাধা বিশ্ববন্দিত হিন্দি গবেষককে
ওরসিনি শুধু একজন বিদেশি অধ্যাপক নন, তিনি ভারতের সাহিত্য-ইতিহাসের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যাকার। তাঁর গবেষণা ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে হিন্দি ও উর্দু সাহিত্য নিয়ে নতুনভাবে ভাবার সুযোগ দিয়েছে। তাঁর বই দ্য হিন্দু পাবলিক স্পিয়ার (The Hindi Public Sphere) বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত। বিফোর দ্য ডিভাইড (Before the Divide) বইটি অনেক গবেষককে বুঝতে সাহায্য করেছে যে, 'হিন্দি' ও 'উর্দু' আলাদা ধর্ম বা সম্প্রদায়ের ভাষা নয়, বরং একে অপরের মধ্যে মিলিত সাহিত্যিক ঐতিহ্য। তাঁর কাজের মাধ্যমে অনেক ভারতীয় ছাত্রছাত্রী বুঝতে পেরেছেন, সাহিত্য মানে শুধু ভাষার সৌন্দর্য নয়, বরং সময়ের রাজনীতি ও সংস্কৃতির প্রতিফলন।ভারতের ভাষা ও সাহিত্যিক ইতিহাস বোঝার জন্য হিন্দি-উর্দু-ফারসি-সংস্কৃত সব ভাষার পারস্পরিক সম্পর্ক জানা জরুরি। তাঁর গবেষণা বিদেশি দৃষ্টিকোণ থেকেও ভারতীয় সাহিত্যের মর্যাদা ও বৈচিত্র্য তুলে ধরেছে। তাঁর গবেষণায় এক বিশেষ দিক হলো, ভারতের সাহিত্যকে তিনি কেবল ভারতীয় হিসেবে নয়, বিশ্বসাহিত্যের অংশ হিসেবে বিশ্লেষণ করেন। এভাবেই তিনি ভারতীয় সাহিত্যকে আন্তর্জাতিক পাঠকের কাছে তুলে ধরেছেন।
উল্লেখ্য, ফ্রান্সেসকা ওরসিনির কাছে বৈধ ভারতীয় ভিসা ছিল। তবুও দিল্লি বিমানবন্দরে পৌঁছনোর পর তাঁকে ভারতে ঢুকতে দেওয়া হলো না। ইমিগ্রেশন বিভাগের দাবি, আগের সফরে তিনি পর্যটক ভিসার নিয়ম ভেঙেছিলেন। তবে কী নিয়ম ভাঙা হয়েছিল বা তার প্রমাণই বা কী তা স্পষ্ট করে জানায়নি কোনো সরকারি দফতর। এই অস্পষ্টতার কারণেই এখন প্রশ্ন উঠছে, ওরসিনিকে কি সত্যিই কেবল প্রশাসনিক কারণে ফিরিয়ে দেওয়া হলো, না কি তাঁর গবেষণার বিষয়বস্তু বা মতামতের জন্য তাঁকে আটকানো হলো?
এই ঘটনার পর থেকে শিক্ষাজগতে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। অনেক অধ্যাপক ও গবেষক বলেছেন, যদি একজন আন্তর্জাতিক মানের গবেষককেও ভারতে ঢুকতে না দেওয়া হয়, তাহলে আমাদের দেশের একাডেমিক পরিবেশ কতটা উন্মুক্ত? এই প্রশ্ন শুধু ওরসিনিকে ঘিরে নয়, বরং পুরো ভারতের গবেষণা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়েই। কারণ, এমন সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতে বিদেশি গবেষকদের ভারত নিয়ে কাজ করতে নিরুৎসাহিত করতে পারে। ফ্রান্সেসকা ওরসিনির মতো গবেষকরা ভারতীয় সাহিত্যকে সারা বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছেন। তাঁকে দেশে ঢুকতে না দেওয়া শুধু দুঃখজনক নয়, বরং একটি প্রতীকী ঘটনা। এই ঘটনা আবারও মনে করিয়ে দিয়েছে— জ্ঞানের জগৎ যতই বড়ো হোক না কেন, যদি সেখানে রাজনীতি বা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ বাড়ে, তবে গবেষণা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা শুধু কথার মধ্যেই সীমিত থেকে যাবে।

Whatsapp
