“২০১৫ সালে ভারতীয় হলাম, কেন ফের ২০০২ সালের তালিকায় আমাদের যাচাই?” হলদিবাড়ির পুনর্বাসন শিবির থেকে যে প্রশ্ন উঠছে

Teen Bigha corridor: ২০১৫-র প্রতিশ্রুতি ছিল শুধু পরিচয়পত্র পাওয়া নয় বরং অন্য নাগরিকদের মতো একই সুবিধে পাওয়ার সুযোগ। কিন্তু বাস্তবে তাঁদের দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষায় রাখা হয়েছে।

আমরা সরকারকে বলেছি, আপনারাই তো ২০১৫ সালে আমাদের ভারতীয় বানিয়েছেন, তাহলে এখন আমাদের নাম ২০০২ সালের ভারতের ভোটার তালিকার সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে হবে কেন?

ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাছেই হলদিবাড়ি পুনর্বাসন শিবিরের একটি ছোট দু'ঘরের কোয়ার্টারে ৫২ বছর বয়সি শিশির রায় তাঁর এসআইআর (স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন) ফর্মটি ভাঁজ করতে করতে ক্লান্ত ও ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন। তিনি আরও বলেন,

আমাদের যুক্তি শোনার পর সরকারী কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আপাতত এই বিষয়টি এসআইআর ফর্মে লিখতে হবে না, তাঁরা কমিশনকে (নির্বাচন কমিশন) জানিয়ে দেবেন। এটাই বর্তমান অবস্থা, কিন্তু এখনও কিছুই চূড়ান্ত হয়নি। এই বিষয়টি আমাদের নতুন উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

শিশির ভারত-বাংলাদেশ স্থলসীমা চুক্তি (এলবিএ) কার্যকর হওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার বাসিন্দা হন ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই রাতে। তার আগে তিনি ছিলেন বাংলাদেশের পঞ্চগড় জেলার মানুষ। ওই চুক্তির মাধ্যমে দু'দেশের মধ্যে ৬৮ বছরের পুরনো 'ছিটমহল' জটিলতার অবসান ঘটে এবং ১৬২টি ছিটমহলের বিনিময় সম্পন্ন হয়। বহু প্রজন্ম ধরে আইনগত অনিশ্চয়তায় থাকা কয়েক হাজার মানুষকে দুই দেশই কথা দিয়েছিল, তাদের পূর্ণ নাগরিকত্ব দেবে এবং নিজের জমির অধিকার দেবে।

দশ বছর পর, হলদিবাড়ির সুসজ্জিত কিন্তু ভেঙে পড়া এই আবাসগুলির দিকে তাকালে, সেই প্রতিশ্রুতিগুলি এখনও অনেক দূরের কথা বলে মনে হয়।

হলদিবাড়ি পুনর্বাসন শিবিরের ৫২ বছর বয়সি শিশির রায় (ছবি: জয়দীপ সরকার)

হলদিবাড়ির মতোই আরও দু'টি পুনর্বাসন কেন্দ্র—দিনহাটা ও চ্যাংরাবান্ধা, এখন সেই মানুষদের আশ্রয়স্থল, যারা ২০১৫ সালে ছিটমহল বিলুপ্ত হলে, বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতীয় ছিটমহলগুলো থেকে ভারতে চলে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাঁদের নতুন ঠিকানা হলো সরকারি জমিতে সারি করে তৈরি দুই ঘরের ছোট বাড়ি— চারদিকে টিন, কাঁটাতার আর অনিশ্চয়তার বেষ্টনী।

কাগজে-কলমে এই পরিবারগুলিই 'ভাগ্যবান' সংখ্যালঘু, যাঁরা পুনর্বাসনের অধিকার পেয়েছিলেন। ছিটমহল বিনিময়ের পর নতুন করে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত হওয়া অঞ্চলগুলো থেকে ৯০০-র কিছু বেশি মানুষ ভারতে আসেন এবং তাঁদের পশ্চিমবঙ্গের শিবিরগুলিতে রাখা হয়। অপরদিকে, ভারতের ভেতরের বাংলাদেশি ছিটমহলগুলিতে থাকা ১৫,০০০-এর বেশি মানুষ সেখানেই থাকার সিদ্ধান্ত নেন এবং বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে যান, নিজেদের ঘরেই বাস করতে থাকেন। কিন্তু কোচবিহার জুড়ে ছড়িয়ে থাকা এই তিনটি শিবিরের বাসিন্দাদের কাছে বাস্তব ছবি কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন। হলদিবাড়ির বাসিন্দা দ্বিজেন বর্মন বলেন,

এখান থেকে দিনহাটা বা চ্যাংরাবান্ধা যেতে বাসে একদিকে তিন-চার ঘণ্টা লাগে, আর যাতায়াতে খরচ হয় ৩০০ টাকা, এটাই আমাদের পুরো দিনের আয়। তাই আমরা যাই না। এক শিবিরের মানুষরা অন্য শিবিরের লোকজনকে খুব একটা দেখতেও পান না।

সরকারের দেওয়া কোয়াটারগুলিতে ছিল একটি ছোট ঘর, একটি সামান্য বড় ঘর, সরু মতো রান্না করার জায়গা আর একটি বাথরুম, এটিই ছিল স্থায়ী পুনর্বাসনের প্রথম ধাপ। কিন্তু এক দশক পর আজ সেই ঘরগুলির দেওয়ালে স্যাঁতসেঁতে, বড় বড় অংশে প্লাস্টার খসে পড়ছে। বাসিন্দারা এও অভিযোগ করেছেন, তাঁরা এখনও এই বাড়িগুলির মালিকানার কোনো কাগজপত্র পাননি।

তিনবিঘা করিডর এবং ছিটমহলবাসীদের পূনর্বাসন কেন্দ্র (ছবি: জয়দীপ সরকার)

চ্যাংরাবান্ধার পানিশালা শিবিরে যশোধরা বর্মন নিজের দরজায় দাঁড়িয়ে খসে পড়া রংয়ের দিকে তাকিয়ে বলেন,

ওখানে আমাদের নিজের বিশাল কাঁচা বাড়ি ছিল, খোলা মাঠ, সুপারি বাগান, চাষের জমি, ফলের বাগান, আর বেশ কিছু পুকুর। সবকিছু ছেড়ে এসে এই বদ্ধ ঘরে থাকা খুব কষ্টের। আর দেখুন, যে ঘরগুলো এখন আমাদের ঠিকানা, সেগুলো মাত্র ১০ বছরের মধ্যেই ভেঙে পড়ছে। বাড়ির অবস্থা যেমন করুণ, আমাদের অবস্থাও তেমনই।

একদিকে নতুন করে নাগরিকত্ব নিয়ে অনিশ্চয়তা। অন্যদিকে প্রতিদিনের জীবিকার প্রশ্ন। এই দুইয়ের মাঝে শিবিরের প্রায় ৩০০ পরিবার নিজেদেরই প্রশ্ন করছে, এই দেশে এসে আমরা আসলে কী পেলাম?

অস্থায়ী আশ্রয়ই হয়ে গেল স্থায়ী

বাংলাদেশের পাটগ্রামের বাসিন্দা সদানন্দ বর্মন এখন পানিশালা শিবিরে থাকেন। টিনের ছাউনি দেওয়া একটি নিচু ঘরের সামনে প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে এদেশে আসার সিদ্ধান্তের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন,

ওখানে রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল, ধর্মীয় উস্কানিও ছিল। আমরা ভাবলাম, ভারত বড় দেশ নিশ্চয়ই আমাদের জন্য ভালো কিছু হবে। সরকার আমাদের কিছু সামান্য জিনিসপত্র দিয়ে এখানে এনেছিল।

কিন্তু সেই আশা বেশিদিন থাকেওনি। তিনি আরও বলেন,

আমাদের একটি সরকারি কৃষি খামারের টিনের ঘরে রাখা হয়েছিল। চার বছর পরে এই বাড়িগুলো আর একটি ট্রাভেল পাস দেওয়া হয়— তিন মাস পরপর পুনঃনিশ্চিত করতে হয়! মাথার উপর এই ছাদের বাইরে আমরা আর কিছু পাইনি।

আরও পড়ুন

“আমাদের নাম কি বাদ পড়বে?”: এসআইআর আতঙ্কে উত্তরবঙ্গের রাজবংশীরা

এখানের মানুষদের কথায় বারবারই এই বিশ্বাসভঙ্গের অনুভূতি ফিরে আসে। জীবিকার জন্য এখন দ্বিজেন্দ্র বর্মন টোটো চালান।তিনি বলেন,

আমাদের ভারতে আনার পর সরকার প্রতিটি পরিবারকে একটি বাড়ি, পাঁচ লাখ টাকা নগদ সাহায্য আর পাঁচ কাঠা জমি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। ১০ বছর পেরিয়ে গেলেও আমরা কিছু পাইনি। যে ঘরে রাখা হয়েছে সেগুলোর কোনো রেজিস্ট্রি নেই। আমাদের কাছে নাগরিকত্ব প্রমাণের কোনো কাগজও নেই। তাহলে কি আমাদের ঠকানো হয়নি? এখন যদি আমাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠায়, আমরা চলে যাব।

পূনর্বাসন কেন্দ্রের স্থানীয় বাসিন্দা (ছবি: জয়দীপ সরকার)

২০১৫ সালে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা ছিটমহল ফেরত আসা মানুষদের পুনর্বাসন ও পরিকাঠামো তৈরির জন্য ১,০০৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প ঘোষণা করেছিল। এর মধ্যে শুধু পুনর্বাসনের জন্য বরাদ্দ ছিল ১০৮ কোটি টাকা। হলদিবাড়ি, দিনহাটা এবং চ্যাংরাবান্ধার মতো শিবিরগুলিকে তখন অস্থায়ী ট্রানজিট হিসেবে ধরা হয়েছিল, কিছুদিন এখানে থাকার পর পরিবারগুলিকে জমি দিয়ে স্থানীয় কোনো জায়গায় অন্তর্ভুক্ত করার কথা ছিল। কিন্তু দশ বছর পরও এই শিবিরগুলিতেই তাদের থাকতে হচ্ছে। মিনতি বর্মন প্রশ্ন করেন,

শুধু মাথার উপর ছাদ থাকলেই কী পরিবারে আয় হবে? ভারতের কোনো সাংসদ বা বিধায়ক আমাদের চেনে না, শুধু নির্বাচনের সময় ছাড়া।

টিনবিঘার ওপারে নিজের জমিতে কাজ করাতেন তিনি। কিন্তু এখানে এসে মিনতিকেই রোজগারের জন্য খোঁজ করতে হয়। তিনি বলেন,

মহিলারা দিনে ৩০০ টাকা, পুরুষরা ৪০০ টাকা মজুরি পায় মাঠে শ্রমিকের কাজ করলে। প্রতিটি বাড়ির অবস্থা একই। যেসব পরিবারে বয়স্ক মানুষ আছে, তাঁদের কষ্ট সবচেয়ে বেশি। কারণ তাঁরা কাজ করতে পারেন না। তাঁদের অবস্থা খুবই খারাপ।

কেন এই উদ্বেগ এত গভীরে, তা বুঝতে গেলে ছিটমহলের ভৌগোলিক বাস্তবতায় ফিরে তাকাতে হয়— এক দেশের সম্পূর্ণভাবে অন্য দেশের ঘেরাটোপে থাকা বিচ্ছিন্ন ছোট ছোট ভূখণ্ড। ১৯৪৭-এর পর দশকের পর দশক ধরে ১১১টি ভারতীয় ছিটমহল পড়ে ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান, বাংলাদেশের ভেতরে, আর ৫১টি পাকিস্তানি, বাংলাদেশি ছিটমহল ছিল ভারতের ভেতরে। সেখানে বসবাসকারী মানুষরা পুরোপুরি শাসিত হতেন না সেই রাষ্ট্রের দ্বারা, যারা তাদের দাবি করত, কিন্তু আবার কোনো সময় গ্রহণও করত না সেই রাষ্ট্র, যার ভূখণ্ডে তারা ঘেরা অবস্থায় থাকতেন। তাঁদের ছিল না স্কুল, হাসপাতাল, রাস্তা, পুলিশ, এমনকি সবচেয়ে জরুরি সেই নথিপত্রও ছিল না।

১৯৭৪ সালের ইন্দিরা-মুজিব ভূমি সীমান্ত চুক্তির মধ্যেই প্রথমবার গুরুত্ব দিয়ে এই সমস্যার সমাধান খোঁজার চেষ্টা শুরু হয়েছিল। সেই চুক্তিতে ছিটমহল বিনিময় এবং বিতর্কিত জমিগুলির নিষ্পত্তির প্রস্তাব ছিল। কিন্তু বাস্তবে সেই বিনিময় সম্পূর্ণ হতে লেগে যায় আরও ৪০ বছরের বেশি সময়— ২০১১ সালের প্রোটোকল এবং ২০১৫ সালে ভারতের সাংবিধানিক সংশোধনের পর পুরো প্রক্রিয়া শেষ হয়।

২০১৫ সালের ৩১ জুলাই মধ্যরাতে ছিটমহলগুলি আনুষ্ঠানিকভাবে মানচিত্র থেকে মুছে যায়। যারা যেখানে ছিলেন, সেখানে থেকেই চারপাশে থাকা দেশের নাগরিক হয়ে যান। সামান্য কয়েকজন যেমন হলদিবাড়ি, দিনহাটা এবং চ্যাংরাবান্ধা শিবিরের পরিবারগুলি নিজেদের ঘরবাড়ি, জমিজমা, স্মৃতি সবকিছু ফেলে রেখে দেশ বদলানোর সিদ্ধান্ত নেন।

বাংলাদেশের আগের ছিটমহলগুলি দ্রুতই আশপাশের ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হয়। কয়েক বছরের মধ্যেই ১১১টি ছিটমহলের প্রায় সব জায়গায় বিদ্যুৎ, পাকা রাস্তা এবং সরকারি সুবিধা পৌঁছে যায়। স্থানীয়রা এখন নিয়মিত ভোট দেন, স্কুল-চিকিৎসার সুবিধা নেন, সাধারণ নাগরিকের মতোই জীবনযাপন করেন।

পূনর্বাসন কেন্দ্র হলদিবাড়ি (ছবি: জয়দীপ সরকার)

ভারতের ছবিটা কিছুটা আলাদা। প্রাক্তন বাংলাদেশি ছিটমহলগুলি ভারতের অংশ হওয়ার পর সেখানে পরিকাঠামো উন্নত হয়েছে, মানুষ স্থানীয় ও বিধানসভা নির্বাচনে ভোট দিচ্ছেন। কিন্তু যারা ছিটমহল ছেড়ে ভারতে এসেছিলেন এবং শিবিরে ঠাঁই পেয়েছেন, তাঁদের জন্য নাগরিক হওয়ার পথ ছিল ভীষণই সমস্যার, এখন যা অসম্পূর্ণও বটে।

হলদিবাড়ির এক যুবক বলেন,

আমাদের একটা ভারতীয় ঠিকানা আছে ঠিকই, কিন্তু ভারতীয় জীবন নেই।

এই অস্থিরতার মাঝেই একটি নতুন প্রজন্ম বড় হচ্ছে। দুর্বল ভিত্তির উপর কোনোভাবে নিজেদের ভবিষ্যৎ দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন তাঁরা।

হলদিবাড়ি শিবিরের ২১ বছর বয়সি লাবণী বর্মন এখন হলদিবাড়ি কলেজ থেকে বিএ পাশ করছেন। তাঁদের পরিবারে তিনিই প্রথম গ্র্যাজুয়েট। তিনি শান্তভাবে বলেন,

আমার পড়াশোনা করার সুযোগ আছে, সময়ও আছে, কিন্তু আমি এমএ বা উচ্চশিক্ষায় যাব না। লাভ কী? এই রাজ্যের সর্বত্র দেখুন কত শিক্ষিত যুবকরাও বেকার। এসব দেখে আর পড়ার ইচ্ছেই থাকে না।

লাবণীর কথাতেই একটি বড় হতাশা প্রতিফলিত হয়। ২০১৫-র প্রতিশ্রুতি ছিল শুধু পরিচয়পত্র পাওয়া নয় বরং অন্য নাগরিকদের মতো একই সুবিধে পাওয়ার সুযোগ। কিন্তু বাস্তবে তাঁদের দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষায় রাখা হয়েছে। কাগজে-কলমে নাগরিক হলেও, বারবার নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে হয়। এই কারণেই এসআইআর (Special Intensive Revision) নিয়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।

হলদিবাড়ি শিবিরে শীতকালীন সবজির গাছের পাশে দাঁড়িয়ে প্রদীপ রায় বলেন,

আমরা ভারতীয় হয়েছি ১০ বছর হলো। এই দেশ খারাপ নয়, বাংলাদেশও খারাপ ছিল না। কিন্তু ধর্মের রাজনীতির জন্যই আমরা ঘরবাড়ি হারিয়েছি, সেটা এখানে এসেও দেখছি। এখন শুনছি, আমাদের নাম যদি এসআইআর-এ না ওঠে, তাহলে আবার বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেবে। পাঠাক। অন্তত এই ভয় তো শেষ হবে।

এখনও পর্যন্ত পুনর্বাসন শিবিরগুলির বাসিন্দাদের ক্ষেত্রে এসআইআর যাচাই কীভাবে প্রযোজ্য হবে, সে বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের কোনো সরকারি ঘোষণা নেই। কারণ ২০০২ সালের ভারতের ভোটার তালিকায় তাঁদের কারও নামই ছিল না। স্থানীয় কর্মকর্তারা শুধু বলেন,

অপেক্ষা করুন, এখনও কিছু চূড়ান্ত হয়নি।

কিন্তু এই অনিশ্চয়তাই পুরনো ক্ষত আবারও ফিরিয়ে এনেছে।

টিনবিঘা আন্দোলনের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে যুক্ত অধিকারকর্মী দিপ্তিমান সেনগুপ্ত বলেন,

এটা সত্যি যে এই মানুষগুলোর এখনও নাগরিকত্বের কোনো সরকারি ঘোষণা পত্রে নেই, এবং যেসব বাড়িতে তাঁরা থাকেন তারও কোনো মালিকানার কাগজ নেই। এসব ইচ্ছাকৃতভাবে করা হচ্ছে, এই মানুষগুলোকে চাপ, ভয় আর উদ্বেগের মধ্যে রাখতে। রাজ্য সরকার কেন্দ্রকে জানানো উচিত এবং চাপ সৃষ্টি করা উচিত কিন্তু সেটাই তো হচ্ছে না।

আরও পড়ুন

‘সভ্যতা’ থেকে বিচ্ছিন্ন আজও | টোটোপাড়ায় এসআইআর যে প্রশ্ন তুলছে

ইতিহাসকে নতুনভাবে সাজানো

হলদিবাড়ির এই উদ্বেগকে বুঝতে হলে টিনবিঘার কথা বলতেই হয়। এই সরু করিডোর একসময় আন্তর্জাতিক শিরোনাম হয়েছিল, আর এখন আবার বিতর্কের কেন্দ্রে ফিরে আসছে। ১৯৭৪ সালের ইন্দিরা-মুজিব চুক্তিতে বাংলাদেশের দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা ছিটমহলে নিরবিচ্ছিন্ন যাতায়াতের জন্য ভারতের টিনবিঘা জমি-পট্টির উপর দিয়ে রাস্তাটির অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। বহু বছরের বিক্ষোভ আর বিলম্বের পর ১৯৯২ সালে করিডোরটি খোলা হয়, প্রথমে সীমিত সময়ের জন্য। ২০১১ সালে ভারত ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নেয়, ফলে দহগ্রাম কার্যত আর ছিটমহল থাকে না। আজ টিনবিঘাকে আবার নতুনভাবে পড়া হচ্ছে— কোচবিহারের রাজনৈতিক মহলে এটি এখন কথিত 'ভৌগোলিক ছাড়'-এর প্রতীক হিসেবে ঘুরিয়ে দেখানো হচ্ছে।

বিজেপির শিবপ্রসাদ রায় টিনবিঘা নিয়ে একটি পুস্তিকা এনেছেন, সেখানে তিনি দাবি করছেন,

নেহরু চুক্তি অনুযায়ী দহগ্রাম ভারতের। ছিটমহলের বিনিময়ে ছিটমহল চাই। টিনবিঘা বা কুচলিবাড়ি ছিটমহল নয়, এটা ভারতের ন্যায্য দাবি।

তিনি ঐতিহাসিক চুক্তিগুলিকে বেছে বেছে ব্যাখ্যা করে এমন ইঙ্গিত দিচ্ছেন যে ভারত আরও জমি রাখতে পারত বা ভিন্ন বিনিময় দাবি করতে পারত। স্থানীয়রা বলছেন, এমন রাজনৈতিক প্রচারে সবচেয়ে উপেক্ষিত হচ্ছেন সেই মানুষগুলো, যাদের জীবনই এসব চুক্তিতে ওলটপালট হয়েছিল।

অধিকারকর্মী দিপ্তিমান সেনগুপ্ত বলেন,

একসময় ভূমি সীমান্ত চুক্তির বিরোধীরা বলত, তারা ‘ভারতের ভূমি’ রক্ষা করছে। আজ সব দলই ছিটমহল সমস্যার সমাধান করার কৃতিত্ব নিচ্ছে, আর একই শক্তিগুলো এখন আবার টিনবিঘাকে ব্যবহার করছে। এবারের উদ্দেশ্য বিভাজনকে আরও উস্কে দেওয়া, অথচ যাদের জীবন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, তারা এখনও নথি ছাড়াই কোনো ভাবে টিকে আছে।

হলদিবাড়ি শিবিরে ৯০ বছরেরও বেশি ঢুলি বর্মন খাটিয়ায় বসে আছেন, সাদা পাতলা চুল বাঁধা। তিনি প্রশ্ন করেন,

ওরা কি আবার আমাদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেবে? তাহলে আমাদের এখানে আনার মানে কী ছিল? এসব দেখে মনে হয়, আমি কি আমার জন্মভূমিতেই মরতে পারব না? অন্য দেশে মরতে হবে? গরিব মানুষের তো কোনো দেশই থাকে না!

টিনবিঘা জংশন থেকে একটি রাস্তা হলদিবাড়ি হয়ে ভারতের শেষ গ্রাম ধাপড়ার দিকে গিয়েছে। তার মাঝখানে বাংলাদেশের দহগ্রাম-পাটগ্রামের রাস্তা। দু'দেশের পুলিশ কাঁটাতারের ধারে পাহারা দেয়; দু'পাশের মানুষ একে অপরকে এবং একে অপরের গাড়িকে দেখতে পায়। অনেকেই হয়ত পুরনো পরিচিত, আত্মীয়ও; তবু সেই কাঁটাতারের ওপারে একটি কথাও আদান-প্রদান করা যায় না।

জংশনের কাছে বছরের পর বছর ধরে টিনের চালের চায়ের দোকান চালিয়ে আসছেন দিলীপ সাজোয়াল। সীমান্তের ওপারের মানুষের সঙ্গে কথা বলা নিয়ে প্রশ্ন করতেই মাথা নাড়েন তিনি। সতর্ক করে বলেন,

বেশি কথা বলবেন না, এখানে-সেখানে ঘুরবেন না সমস্যা হবে।

ভয়, বিপদ, অনিশ্চয়তা আর অভাব— চিটমহলের সেই পুরনো দিন আবারও ফিরে এসেছে তাঁদের জীবনে, একটা সময় তাঁরা ভেবেছিলেন অবশেষে হয়ত এ সব থেকে মুক্তি পেয়েছেন।

মানচিত্র থেকে চিটমহল মুছে যাওয়ার দশ বছর পরও, সেই আতঙ্ক এখনও তাঁদের মনের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়। নাগরিক হিসেবে কাকে গণ্য করা হবে? কারা এই দেশের অংশ বলে বিবেচিত হবে? আর কতবার একই মানুষকে প্রমাণ করতে হবে তাঁরা সত্যিই কারা? হলদিবাড়ির ঘরগুলির ভেতর ঘুরতে থাকা এই প্রশ্নগুলির জবাব কোনো সরকারি কর্মকর্তাই দিতে চান না।

 

(মূল প্রতিবেদনটি প্রাথমিক ভাবে দ্য ওয়্যার-এ প্রকাশিত হয়েছিল।)

More Articles