হাসিনার থাকা ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত: জয়শঙ্কর, দালাই লামার পথেই হাঁটছেন হাসিনা?

Sheikh Hasina India stay: ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর জানান, হাসিনা ভারতে আছেন ঠিকই, কিন্তু এটি কোনো রাজনৈতিক আশ্রয় নয়, ভারত সরকারের বিশেষ সিদ্ধান্তও নয়। আর কতদিন থাকতে চান, তা তিনিই ঠিক করবেন।

বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন ভারতে আছেন, এই খবর নতুন নয়। কিন্তু তাঁর অবস্থানকে ঘিরে সম্প্রতি রাজনৈতিক ঝড় তৈরি হয়েছে, তার মধ্যেই বড় কূটনৈতিক উত্তরটি দিলেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর। তাঁর কথায়, হাসিনা ভারতে আছেন ঠিকই, কিন্তু এটি কোনো রাজনৈতিক আশ্রয় নয়, ভারত সরকারের বিশেষ সিদ্ধান্তও নয়। তিনি এসেছেন এক জটিল পরিস্থিতি থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখে। আর কতদিন থাকতে চান, তা তিনিই ঠিক করবেন।

নয়াদিল্লিতে হিন্দুস্তান টাইমস লিডারশিপ সামিটে সাংবাদিক রাহুল কানওয়ালের প্রশ্নের উত্তরে জয়শঙ্কর বলেন, বিষয়টি রাজনৈতিক নয়। তিনি যে পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলেন, সেই কারণেই এখানে আছেন। সময়টি দু'দেশের সম্পর্ক বোঝার জন্য আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

এই কথায় ভারত নিজের অবস্থান স্পষ্ট জানালেও, আসলে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি এখন বড় ধরনের অস্থিরতার মধ্যে রয়েছে। কারণ শেখ হাসিনার ভারতে থাকা শুধু ‘ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত’, তবে এমন সরল হিসেবেই বিষয়টি শেষ হচ্ছে না। এর পেছনে রয়েছে ঢাকার ভেতরে অস্থির রাজনীতি, আন্তর্জাতিক চাপ, এবং ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের মতো বিষয়গুলি।

আরও পড়ুন

শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠাবে ভারত?

বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় হাসিনার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণার পর থেকেই রাজনৈতিক সংকট চরমে ওঠে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন, এবং আন্দোলন দমনের অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়। এই দিনই তিনি ভারতে এসেছিলেন। ঢাকার অন্তর্বর্তী সরকার এখন তাঁকে ফেরত চাইছে, এমন খবরও আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। কিন্তু ভারত তার তেমন তাড়া দেখাচ্ছে না।

জয়শঙ্কর সরাসরি বলেন,

ভারত কার সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে, তা ভারতই ঠিক করবে। এতে অন্য দেশের নির্দেশের প্রশ্ন নেই।

বাংলাদেশের নতুন সরকারের বার্তা স্পষ্ট হলেও, দিল্লি সময় নিচ্ছে, এটাই পরিস্থিতিকে আরও সংবেদনশীল করে তুলছে। কারণ ভারতের বাংলাদেশের সঙ্গে কৌশলগত ভারসাম্য বজায় রাখাও জরুরি।

জয়শঙ্কর বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও এক গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত দেন। তাঁর ভাষায়, বাংলাদেশের সংকটের গোড়া লুকিয়ে আছে নির্বাচনের প্রশ্নে। দেশের আগের নির্বাচনগুলো কেমন হয়েছিল, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। তাই ভবিষ্যতের পথ দেখাতে হলে প্রথমে দরকার বিশ্বাসযোগ্য ভোট। তাঁর ইঙ্গিত স্পষ্ট, গণতান্ত্রিক পথেই বাংলাদেশকে আবার দাঁড়াতে হবে। আর সে দায়িত্ব বাংলাদেশের জনগণের।

কিন্তু বাস্তব সত্য হলো, হাসিনার ভারতে থাকা বাংলাদেশের রাজনৈতিক মানচিত্রকে আমূল বদলে দিয়েছে। চিন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত— তিন পক্ষই এখন ঢাকার উপর নজর রাখছে। হাসিনার অনুপস্থিতিতে নতুন ক্ষমতার সমীকরণ কোন দিকে ঝুঁকবে, তা নির্ধারণ করবে ভবিষ্যৎ আঞ্চলিক রাজনীতি। 

শেখ হাসিনা এখনও প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করেননি। তিনি কতদিন ভারতে থাকবেন তাও জানা নেই। কিন্তু তাঁর নীরবতাই এখন সবচেয়ে জোরালো প্রতিধ্বনি। কারণ তাঁর অবস্থান যত দীর্ঘ হচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনীতির অনিশ্চয়তাও তত গভীর হচ্ছে। আর সেই অনিশ্চয়তা ছড়িয়ে পড়ছে পুরো দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে।

স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য মনে করেন, শেখ হাসিনা ইস্যুতে ভারত খুব সতর্ক অবস্থান নিয়েছে, যেন 'ধরি মাছ, না ছুঁই পানি' ধরনের কূটনীতি। তাঁর মতে, বাংলাদেশের প্রতি ভারতের দৃষ্টিভঙ্গির এখন দুটি দিক স্পষ্ট। একদিকে, সেখানে দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা ভারতবিরোধী জনমত ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়াকে ভারত গুরুত্ব দিচ্ছে। সেই কারণে বাংলাদেশে বর্তমানে প্রভাবশালী রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি, জামায়াত-সহ অন্যান্য গোষ্ঠীর সঙ্গে দূরত্ব না রেখে বরং নরম-বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাইছে দিল্লি।

অন্যদিকে, দু'দেশের শীর্ষস্তরের রাজনীতিকরা ভালোভাবেই জানেন— ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক বহুস্তরীয় এবং তা অটুট রাখা দু'পক্ষেরই স্বার্থে, বলে উল্লেখ করেন স্নিগ্ধেন্দু। তাঁর দাবি, তাই ভারত চায় না তার দীর্ঘদিনের মিত্র শেখ হাসিনাকে সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করতে, আবার প্রকাশ্যে এমনও দেখাতে চায় না যে তাঁকে নিঃশর্ত আশ্রয় দিচ্ছে। তিনি বলেন, ফলে দিল্লি এখন এক ধরনের ভারসাম্য নীতি নিচ্ছে, একটু অপেক্ষা করে পরিস্থিতি বুঝে নেওয়া, অর্থাৎ 'দেখা যাক কী হয়' ধরনের কৌশল। স্নিগ্ধেন্দুর মতে, এই ভারসাম্য রক্ষার অংশ হিসেবেই ভারত খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য মানবিক সহায়তার কথাও বলেছে, যাতে বাংলাদেশের নতুন ক্ষমতার সমীকরণের দিকে তারা বন্ধুত্বপূর্ণ একটি সংকেত পাঠাতে পারে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক আলতাফ পারভেজ মনে করেন, শেখ হাসিনার ভারতে অবস্থানকে ঘিরে ভারত যে ব্যাখ্যা দিচ্ছে, তার মধ্যেই বড় ধরনের স্ববিরোধিতা রয়েছে। তিনি বলেন,

বাংলাদেশের হাজার হাজার সাধারণ মানুষ চিকিৎসার জন্য প্রচুর টাকা খরচ করে ভারতে যেতে চাইলেও সহজে ভিসা পান না। সেখানে একজন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শুধু নিজের ইচ্ছায় যতদিন খুশি ভারতে থাকতে পারবেন, এ ধারণা বাস্তবতার সঙ্গে মেলে না।

আরও পড়ুন

হাসিনার পথে হাঁটছেন ইউনূস, জুলাই নিয়ে আমরা গর্বিত: সিপিবি-র সাধারণ সম্পাদক

তাঁর মতে, এখানেই জয়শঙ্করের বক্তব্যে ‘ফাঁকি’ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তিনি আরও বলেন,

শেখ হাসিনা আসলে গত দেড় দশক ধরেই ভারতের রাজনৈতিক ছায়া ও কূটনৈতিক নিরাপত্তার উপর নির্ভর করে চলেছেন। এই নির্ভরতা শুধু তাঁর দল নয়, ভারতের জন্যও ক্ষতিকর হয়েছে। ভারতের যাঁরা স্বাধীনভাবে নীতিনির্ধারণ নিয়ে ভাবেন, তাঁরা সহজেই বুঝতে পারবেন, একতরফা ভরসায় সম্পর্ক দীর্ঘমেয়াদে টেকে না।

তাঁর মতে,

হাসিনা যতদিন ভারতের মাটিতে থাকবেন, ততদিন দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক পথে ফেরানো আরও কঠিন হয়ে উঠবে। এতে উভয় দেশেরই ক্ষতি হবে, এমনকি পরিস্থিতি আত্মঘাতী পর্যায়ে পৌঁছতে পারে। কারণ সাধারণ মানুষের মধ্যে ইতোমধ্যেই ভারতবিরোধী মনোভাব বাড়ছে, আর রাজনৈতিক শক্তিগুলির মধ্যেও এ নিয়ে সন্দেহ তৈরি হচ্ছে।

আলতাফ পারভেজ ভারতীয় নীতিনির্ধারণ নিয়েও সরাসরি প্রশ্ন তোলেন। তাঁর কথায়,

বাংলাদেশের প্রতি ভারতের বিদেশনীতি 'লীগনির্ভর' অর্থাৎ একটি দলকে কেন্দ্র করে সাজানো নীতি  একটি বড় ভুল। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা যত দ্রুত বদলাচ্ছে, ভারতের উচিত হবে দেশটির সব পক্ষের সঙ্গে সমান ও বাস্তবসম্মত সম্পর্ক গড়ে তোলা। না হলে এই একদিকমুখী নীতি ভবিষ্যতে আরও বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে।

প্রসঙ্গত, ভারত অতীতে বহুবার রাজনৈতিক নেতা ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বদের আশ্রয় দিয়েছে। শেখ হাসিনা এর প্রথম উদাহরণ নন। ১৯৫৯ সালে দালাই লামা চিনের দমন-পীড়ন এড়িয়ে ভারতে এসে থাকেন, আজও তিনি এখানেই। শ্রীলঙ্কার তামিল রাজনীতিকরা গৃহযুদ্ধের সময় তামিলনাড়ুকে নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। আফগানিস্তানের নেতা, সাংবাদিক ও কূটনীতিকরাও তালিবান শাসনের থেকে পালিয়ে বছরের পর বছর ভারতে থাকছেন। আর বাংলাদেশের সঙ্গেও ভারতের আশ্রয়, সম্পর্ক বহু পুরনো। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা কয়েক বছর ভারতেই আত্মগোপনে ছিলেন। সামরিক শাসনের বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বহু নেতা-কর্মীও ভারতে নিরাপত্তা খুঁজেছিলেন। নেপালের রাজনীতিবিদ ও রাজপরিবারের সদস্যরাও রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় দিল্লি ও গুরগাঁওয়ে থাকতেন।

এখন প্রশ্ন একটাই, দালাই লামার মতোই কি শেষ পর্যন্ত ভারতে দীর্ঘস্থায়ীভাবে থেকে যাবেন শেখ হাসিনা?

More Articles