ছিল ধনীদের বিলাস! কীভাবে মধ্যবিত্ত মহিলাদের 'জাতীয় পোশাক' হয়ে উঠল নাইটি?

Evolution of Nightie: বেবিডল তো আর আপামর জনজাতির চাহিদা নয়, চাহিদা হচ্ছে পাতলা সুতির নরম নাইটির।

ব্যবহারে ব্যবহারে জরাজীর্ণ। খুব সংবেদনশীল মন নিয়ে কান পাতলে মুক্তির হাহাকারও শুনতে পাওয়া যেতে পারে। তবু মুক্তি নেই। ছিঁড়ে যাক, রিফু করে বগলের ফাটা অংশ চেপে আরও মাস ছয়েক তো বটেই। সুতো ফেঁসে যাক, ফের টেনে আরও মাস চারেক। রং উঠে, চটে যাক বাঙালি মহিলাদের দেহ ছেড়ে যায় না নাইটি। জাতীয় পোশাক বললেও ভুল হয় না। শুধু বাঙালি কেন, সারা দেশেই অধিকাংশ মহিলাদের রাত পোশাক মানেই নাইটি! তবে সেই নাইটির শ্রেণি চরিত্র আলাদা আলাদা। ধনকুবের মহিলাদের, বা অন্তত সেই পরিবারের নাইটি অভিজাত। তার নাম আলাদা, গড়ন আলাদা। তার নাম নাইটগাউন। আবেদনময়ী নাইটির নাম বেবিডল। নাইটি এখন নিম্ন মধ্যবিত্ত। তবে হামেশাই তো এমন ছিল না। এখন নাহয় নানান বাহারি নাম, নানা গড়ন। রাতপোশাক শুধুই এখন ঘুমের পোশাক নয়। কীভাবে ভারতের মহিলাদের কাছে এত জনপ্রিয় হয়ে উঠল সর্বাঙ্গ ঢাকা এই ওয়ানপিস?

নাইটির শুরুয়াদ

নাইটির জন্ম ভিক্টোরিয়ান যুগে। সেই সময়ের আগে রাতের পোশাকের কোনও অস্তিত্বই ছিল না। জানলে অবাক ও আরাম দুই লাগে যে মানুষজন সাধারণত তখন অন্তর্বাস পরেই ঘুমাতেন। আকর্ষণীয় দেখতে নাইট গাউনগুলি প্রথম বাজারে আসে ১৯ শতকে। তবে তখন তা গাউন, মানে অভিজাতদেরই তাতে অধিকার। ধনী ছাড়া নাইট গাউন কেনার সামর্থ ছিল না সকলের। নাইটি পরে ঘুমোয় মানে সে মানুষের বিলাসী যাপন। সে স্বভাবতই বেশ ধনী।

তবে শুধুই তো ধনী হওয়ার সাক্ষ বহন করা নয়। নাইটগাউনের যথেষ্ট কার্যকারিতাও ছিল! শীতের রাতে শরীর গরম রাখত নাইটি। লম্বা হাতা আর গোড়ালি পর্যন্ত লম্বা নাইটি তৈরি হতো সেই সময়। দেখতে আকর্ষণীয় তো বটেই, নকশা করাও বেশ সহজ। এই ভিক্টোরিয়ান নাইটগাউনগুলি থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই পরবর্তীকালে জ্যাকেটওয়ালা নাইটি, বিয়ের রাতের বিশেষ অন্তর্বাসও তৈরি হতে থাকে।

আরও পড়ুন- ফুটপাথ থেকে কেনা হয়েছিল অমিতাভের পোশাক! ‘ডন’ কেন আজও এক ম্যাজিক?

নাইটির বিবর্তন

১৯২০-র দশকে নাইটির বিবর্তন

১৯২০-র দশকে, রাতের পোশাকগুলি তৈরি হতো দিনের পোশাকের নকশার প্রতিলিপি থেকেই। সম্পূর্ণ দৈর্ঘ্যের গাউনের পাশাপাশিই ছিল ছোট এবং ফ্যাশনেবল রাত পোশাক। এগুলি অবশ্যই জনসমক্ষে পরার মতো না। একেবারে ঠি শোয়ার ঘরের জন্যই তা তৈরি।

১৯৩০-এর নাইটি
তিরিশের দশক হলিউডের গ্ল্যামার সর্বস্বতার যুগ। হলিউড তারকাদের পোশাক সাধারণ মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলল ব্যাপক। তারকাদের সিল্ক গাউন, পালক এবং পশম সজ্জিত, লেসের কাজ করা চোখ ধাঁধানো রাত পোশাক হয়ে উঠল মহিলাদের রাত্রিকালীন কামনা। জ্যাকেটের সঙ্গে আলাদা করে রাত পোশাকের ব্যবহার বাড়ল। এখনও খানিকটা তেমন পোশাকের কদর রয়েছে বৈকি।

নাইটির নকশা বদল

বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী জীবন শুধু যে অর্থনৈতিকভাবে বদল ঘটিয়েছিল তা তো নয়। সামাজিক বদলও ছিল ব্যাপক, এবং এই বদলের প্রভাব পড়েছিল রাত পোশাকেও। বিলাসিতার জীবন থেকে রাতারাতিই সরে আসতে হয়েছিল বড় অংশের মানুষকে। প্রয়োজনের জন্য ফ্যাশন ছাড়া কোনও বিনোদনের দৃশ্যকল্পেই ফ্যাশনের ব্যাপক বদল ঘটানোর মতো মানসিকতা ও সামর্থের ঘাটতি ছিল। যুদ্ধের অনেক পরে অবশ্য ফ্যাশন শিল্পে ফের গতি আসে। ফরাসি ফ্যাশন ডিজাইনার 'ক্রিশ্চিয়ান ডিওর' মহিলাদের জন্য দুর্দান্ত কিছু পোশাক ডিজাইন করেন। ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে, জনসাধারণের এই নয়া পোশাক কেনার সামর্থ্য রয়েছে। লেস, সূক্ষ্ম সূচের কাজ করা সাটিনের গাউন এল বাজারে। হালকা সেই রাত পোশাকের বাজার বাড়ল হু হু করে। ক্রিশ্চিয়ান ডিওর চেয়েছিলেন মহিলাদের 'গ্ল্যামার' শুধু মাত্র বাইরের জগতের জন্য নয়। তাঁর নিজস্ব সময়ে, শোবার মতো ব্যক্তিগত সময়েও মহিলারা মোহময়ী হয়ে উঠতে পারেন। সেই কারণেই এই চোখ টানা রাত পোশাকের নির্মাণ।

সমসাময়িক নাইটির বিবর্তন

১৯৬০-এর দশকে ফ্যাশন জগতে বিবিধ বিপ্লব ঘটে। এর ঠিক আগের দশকেই 'ক্লাসিক' রাতপোশাকের বাজার ছিল চড়া। ষাটের দশক এবং তার পরে অর্থনীতির দরজা যেই উদার হতে শুরু করল, নাইট গাউন খর্ব হতে হতে কামোদ্দীপক 'বেবিডল' হয়ে উঠল। ফিতে, পশম, পালক এবং সাটিনের ম্যাচিং অন্তর্বাস আর তার উপর নাইটগাউন ফ্যাশনে শ্রেণি তৈরি করল ফের। আর নাইটি হলো সেই নিম্ন মধ্যবিত্ত যুবতীর ভরসা যার কাছে বিশ্বযুদ্ধ পেরিয়ে গেলেও পৃথিবীটা বদলায়নি। রাত পোশাকে বিলাসের চেয়েও যার কাম্য কেবলই আরাম। ঘাম মোছার বড় এক পোশাক। ভারতের মহিলাদের ক্ষেত্রে এই পোশাকের কদর কোনও ফ্যাশন বা বিলাস থেকে তাই ঢের দূরে। প্রচণ্ড গরমে, সারা দিনের কাজ, ঘুম থেকে উঠে সংসার সামলানোর অলিখিত বিধান! শাড়ি সায়া ব্লাউজের ত্রিস্তরীয় ফাঁদ থেকে বেরিয়ে মহিলারা তাই নাইটির শরণে এলেন। সারা দেহ ঢাকা, ফলে 'লোকলজ্জা'র ডর নেই। এদিকে কাজ করতেও সুবিধে, হাওয়া ঢোকে বেশ। ঢিলাঢালা সুতির নাইটি তাই হয়ে উঠল মহিলাদের সারাদিনের বিশ্বস্ত সঙ্গী।

আরও পড়ুন- ২০০ পলিথিন ব্যাগ দিয়ে পোশাক! অসম্ভবকে যেভাবে সম্ভব করলেন ২২ বছরের যুবতী

২০১২ সালে, বিজেপির প্রয়াত নেত্রী সুষমা স্বরাজ জাতীয় টেলিভিশনে এক কথোপকথনে জানিয়েছিলেন গঙ্গায় ডুব দেওয়ার জন্য নাইটিই ছিল তাঁর পছন্দের পোশাক। বাঙালি অধিকাংশ মহিলাদের তো 'জাতীয় পোশাক'ই নাইটি বলা যায়। সেখানে সে নিছক রাত পোশাক নয়। নাইটের ঘেরাটোপ ছাড়িয়ে সে সারাদিনই মহিলার শরীরে আরাম জোগায়। বাইরে যেতে হলে, কলতলায় জল ভরতে গেলে অমন নাইটি পরে 'বেআব্রু' কি বেরনো যায়? টোটকা আবিষ্কার করলেই মেয়েরাই। নাইটির উপর ওড়না বা গামছা নিয়ে বিচিত্র এক প্রয়োজনীয় ফ্যাশন স্টেটমেন্ট তৈরি হলো। মফসসলের দিকে এই দৃশ্য তো চোখ সওয়াই। শুধু কি মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত? বলিউডের গল্পে উঠে এল নাইটি। ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে বলিউডের বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র নাইটিকে ফ্যাশনের ধারায় নিয়ে আসে। ১৯৬৮ সালের পড়োসান সিনেমায় সায়না বানু হোক বা এই হাল ফিলের তারে জমিন পর সিনেমার টিসকা চোপড়া। ম্যাক্সি বা নাইটি হয়ে উঠল সব ঘরের পোশাক।

নাইটির জনপ্রিয়তার মূলে রয়েছে দু'টি মূল ক্ষেত্র, এক, সারাদিন পরে থাকার জন্য এমন নির্ভরযোগ্য পোশাক আর নেই। দ্বিতীয়ত এই পোশাক মহিলাদের থেকে যৌন আকর্ষণের কেন্দ্রটি সরিয়ে দিল অনেকখানি। বেবিডল তো আর আপামর জনজাতির চাহিদা নয়, চাহিদা হচ্ছে পাতলা সুতির নরম নাইটি তৈরি। তাতে কোনও যৌন উদ্দীপক নেই, আছে কেবল আরাম। যে কোনও শরীরে তা মানানসই। সাধারণ শ্রমজীবী মহিলাদের কাছে তাই নাইটি স্রেফ রাত পোশাক নয়, সারাদিনের বিশ্বস্ত পরিধান।

তাহলে কি নাইটি কোনও ফতোয়ামুক্ত পোশাক? একেবারেই না। ২০১২ সালে, বেঙ্গালুরুর স্কুল ৭ টি স্কুল নির্দেশিকা জারি করে যে, বাচ্চাদের বাসে তোলা বা স্কুলে ছাড়তে আসার সময় অভিভাবকরা নাইটি পরে আসতে পারবেন না কারণ পোশাকটি 'অশালীন'। ২০১৮ সালে অন্ধ্রপ্রদেশের একটি গ্রামে মহিলাদের দিনের বেলা নাইটি পরা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। সন্ধ্যা ৭ টার পরে নাইটি পরার অনুমতি ছিল কেবল।

তবে নাইটি তার মাহাত্ম্য হারায়নি। পাড়ার মুদিখানা যাওয়া হোক, কলতলায় জল ভরা হোক, সারাদিনের ঘাম, দৌড় শেষে রাতের বিছানায় আরামের প্রসঙ্গে হাফপ্যান্ট, হালকা গেঞ্জি, কাফতানকে ১০ গোল দেবে আজও, নাইটিই।

 

More Articles