প্রধান বিচারপতিকে জুতো মারা আসলে সাংবিধানিক বিচারব্যবস্থাকেই নস্যাৎ করার প্রক্রিয়া
BR Gavai: হাজার হাজার বছর ধরে কোণঠাসা হয়ে থাকা সেই দলিত সমাজ থেকে উঠে আসা বলেই কি অন্ধবিশ্বাসীদের এ হেন আক্রমণের মুখে প্রধান বিচারপতি?
গত সোমবারের ঘটনা। ঘড়ির কাঁটা তখন সকাল ১১টা বেজে ৩৫ মিনিটে থমকেছে। সুপ্রিম কোর্টের ১ নম্বর রুমে প্রধান বিচারপতি বিআর গভাইয়ের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে চলছে শুনানি। ঠিক সেই সময়েই 'ধামাকা', যা এ দেশের ইতিহাসে আগে কখনও ঘটতে দেখা যায়নি। সংবাদমাধ্যম বলছে, ওই সময় রাকেশ কিশোর নামে এক আইনজীবী স্লোগান দিতে শুরু করেন। বলতে থাকেন, ''সনাতন ধরম কা অপমান, নেহি সহেগা হিন্দুস্তান।'' অর্থাৎ, “সনাতন ধর্মের অপমান সহ্য করব না।” এর পরই চমক। স্লোগান দিতে দিতে রাকেশ খুলে ফেলেন তাঁর স্পোর্টস শ্যু। কেউ কেউ বলছেন, রাকেশ সে দিন প্রধান বিচারপতিকে লক্ষ্য করে জুতো ছুঁড়েছিলেন। আবার কেউ বলছেন, কিছু একটা ছুঁড়েছিলেন তিনি।
কিন্তু কেন? সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যাচ্ছে, গত ১৬ সেপ্টেম্বর মধ্যপ্রদেশের খাজুরাহো মন্দির কমপ্লেক্স নিয়ে এক মামলার শুনানি চলছিল প্রধান বিচারপতির বেঞ্চে। সেখানকার জাভারি মন্দিরে মুখমণ্ডলহীন ৭ ফুট উঁচু বিষ্ণুমূর্তির সংস্কার চেয়ে আবেদন করেছিলেন এক আইনজীবী। আর অন্ধবিশ্বাসের উপর করা সেই মামলাটি খারিজ করতে গিয়ে প্রধান বিচারপতি আইনজীবীর উদ্দেশ্যে বলেন, ''যদি আপনি সত্যিই বিষ্ণুর ভক্ত হন, তবে যান, প্রার্থনা করুন। দেবতাকে বলুন যেন উনি নিজেই কিছু করেন। খাজুরাহো একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। এর জন্য এএসআইয়ের অনুমতি নেওয়া প্রয়োজন।''
আরও পড়ুন- ‘আমিত্ব’ ভারতীয় সংবিধানের মূল নয়, মনমোহনের জয় ও পরাজয় সেই মূলেই লুকিয়ে
নানা বিতর্কিত পর্ব পেরিয়ে আসা অযোধ্যার বাবরি মসজিদে এই সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশেই নির্মিত হয়েছে রাম মন্দির। যা এক সময় বিজেপির নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল। সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়েছে। সেই সুপ্রিম কোর্টেই বিষ্ণুমূর্তি সংক্রান্ত মামলা খারিজ হয়ে যাওয়ায় রেগে কাঁই আইনজীবী রাকেশ। তাই প্রধান বিচারপতিকে তিনি জুতো ছুড়ে প্রতিবাদ করতে চেয়েছিলেন বলে সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যাচ্ছে। তাঁকে তল্লাশি করে পাওয়া গিয়েছে স্লোগান লেখা চিরকুট। যদিও রাকেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের তরফে কোনও অভিযোগ দায়ের হয়নি। তাই মুক্তি তিনি পেয়েছেন। আর মুক্তির পর ফের গর্জে উঠেছেন। প্রধান বিচারপতির উপর এই আক্রমণ নিয়ে দেশ জুড়ে সমালোচনার ঝড় উঠলেও, এ জন্য বিন্দুমাত্র অনুতপ্ত নন রাকেশ। বরং তাঁর দাবি, ‘পরমাত্মা’ তাঁকে দিয়ে এই কাজ করিয়ে নিয়েছেন (গত লোকসভা ভোটের সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দাবি করেছিলেন, তিনি কিছুই নন। তিনি ঈশ্বরের তৈরি একটি যন্ত্র মাত্র। ঈশ্বর তাঁকে দিয়ে কাজ করাতে চান। আর তিনি সেই কাজ করেন। এই বক্তব্যের সঙ্গে রাকেশের দাবির কী অদ্ভুত মিল!)। রাকেশের বক্তব্য, ''উনি অ্যাকশন নিয়েছেন। আমি রিঅ্যাকশন দিয়েছি। যে ভাবে পারেন দেখুন। আমি ভয় পাই না। কোনও আফশোস নেই আমার।''
২০১৪ সাল থেকে বিজেপি জমানা শুরু হওয়ার পর থেকে, এ দেশের তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষ বা সংখ্যালঘুদের উপরে গেরুয়াবাহিনীর নানা অত্যাচারের দৃশ্য সামনে এসেছে। যেন দীর্ঘকাল ধরে বোতলবন্দি থাকা দৈত্য বেরিয়ে এসেই শুরু করেছে নৃশংসতার একের পর এক পর্ব। কখনও গোরক্ষাবাহিনীর শিকার হয়েছে উত্তর প্রদেশের দাদরির মহম্মদ আকলাখ। আবার কখনও দৈত্যের কবলে যোগীরাজ্য হাথরসের দলিত তরুণী। 'ডাবল ইঞ্জিন' শাসিত রাজ্যগুলি যেন এমন উদাহরণ তুলে ধরায় একে অপরকে ছাপিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। এ বার সেই তাণ্ডবের আঁচ পৌঁছে গেল সুপ্রিম কোর্টের অন্দরেও।
কেজি বালাকৃষ্ণণের পর দেশের দ্বিতীয় দলিত প্রধান বিচারপতি বিআর গভাই। দেশের সংবিধান প্রণেতা ডক্টর বিআর আম্বেদকর তাঁর শ্রদ্ধার পাত্র। সংবিধানকে তিনি মানেন 'ভীমস্মৃতি' হিসাবে। দলিত সম্প্রদায়ের জন্য আম্বেদকরের লড়াইয়ের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা তাঁর। হাজার হাজার বছর ধরে কোণঠাসা হয়ে থাকা সেই দলিত সমাজ থেকে উঠে আসা বলেই কি অন্ধবিশ্বাসীদের এ হেন আক্রমণের মুখে প্রধান বিচারপতি?
আরও পড়ুন- সংবিধানের দলিত, দলিতের সংবিধান: একটি বোঝাপড়া
শুধু কি তাই, কারণ আরও আছে। চলতি বছরের ৫ অক্টোবর মহারাষ্ট্রের অমরাবতীতে সংগঠনের জন্মের শতবার্ষিকী পালন করেছিল এ দেশের শাসকদল বিজেপির মেরুদণ্ড আরএসএস। সেই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল প্রধান বিচারপতি বিআর গভাইয়ের মা কমল গভাইকে। কিন্তু সেই আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দিয়ে কমল আরএসএসের কর্তাদের স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন, তিনি আম্বেদকরপন্থী। তিনি কোনও সাম্প্রদায়িক অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন না। দলিত পরিবারের কাছ থেকে আসা এই উত্তরকে কি 'অপমান' হিসাবে দেখছে আরএসএস? এর উপর বিষ্ণমূর্তি সংক্রান্ত মামলা খারিজ করে দেওয়া কি যোগ করেছে নতুন মাত্রা? প্রধান বিচারপতি রাকেশের এ হেন কীর্তিকে পাত্তা দিতে চান না। বস্তুত পুলিশের হাত থেকে রেহাইও পেয়ে গিয়েছেন রাকেশ। কিন্তু, এই ক্ষমা নতুন করে কোনও বিপদের পথ খুলে দেবে না তো?
আজকাল গেরুয়াবাহিনীর বড়, মেজ, সেজ বা ছোট, যে কোনও হর্তাকর্তার সঙ্গে অল্পস্বল্প আলাপেই শুনতে পাই, এ দেশে এক দিন ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠিত হবে। প্রতিষ্ঠা পাবে ঋকবেদের যুগের সমাজতন্ত্র। তাঁদের বক্তব্য, ঋকবেদের যুগে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই জাতিগত বিভাজন ছিল না। ছিল শুধুমাত্র কর্মগত শ্রেণী বিভাজন। সেই সমাজতন্ত্র না কি এ দেশে আগতপ্রায়। হয়তো সেই অনাগত সময়ের নতুন সংবিধানও লেখা চলছে নাগপুরের কোনও বৃক্ষকোটরে। বর্তমান সংবিধানকে সরিয়ে যা হয়তো এক দিন ঠাঁই পাবে দেশনেতাদের টেবিলে টেবিলে। হয়তো তার সপ্তম অধ্যায়ের ক-এর দাগের তিন নম্বর প্যারাগ্রাফ দেখে রোজ সকালে টিভি বা রেডিওয় প্রচার করে দেওয়া হবে, আজ কী খাওয়া যাবে বা কী খাওয়া যাবে না। অথবা এ নিছকই আমার কষ্টকল্পনা।
কিন্তু তাই বা কী করে বলি! রবিবারই দিল্লির বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী রেখা গুপ্ত সর্বভারতীয় একটি ব্রাহ্মণ সম্মেলনে বলেছেন, ''সমাজে যদি কেউ জ্ঞানের শিখা প্রজ্বলিত করে, তবে তা হল ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়। তাঁরা কেবল ধর্মগ্রন্থই নয়, অস্ত্রেরও পুজো করেন। এই অস্ত্র এবং ধর্মগ্রন্থের মাধ্যমেই আমরা সমাজ ও দেশকে রক্ষা করতে পারি।'' আলো কি ক্রমে আসিতেছে না কমে আসিতেছে?
Whatsapp
