মায়াবতীর বিশ্বাসঘাতকতায় পড়ে যায় সরকার, যে অভাবনীয় প্রতিশোধ নিয়েছিলেন বাজপেয়ী...
Atal Bihari Vajpayee & Mayawati: হঠাৎ মায়াবতী সদর্পে বলে ওঠেন, "আরিফ লাল বোতাম টেপো!" লাল বোতাম অর্থাৎ সরকারের বিরুদ্ধে ভোট, অর্থাৎ অটল বিহারী বাজপেয়ীর ১৩ মাসের সরকারের অবধারিত পতন!
১৬ এপ্রিল ১৯৯৯। দিল্লির আকাশে সূর্য তখন ডুবন্ত, অন্ধকার নামতে কিছুটা দেরি। সংসদের লবি দিয়ে হেঁটে আসছেন এক বৃদ্ধ। আকাশে অন্ধকার না ঘনালেও অন্ধকার ঘনিয়েছে তাঁর মুখে। দেওয়াল লিখন তিনি পড়ে ফেলেছেন। গদিচ্যুত হওয়ার শুধু সময়ের অপেক্ষা। এমনই দুর্ভাবনা নিয়ে হাঁটছেন, হঠাৎ পেছন থেকে একটি আওয়াজ শুনতে পেলেন তিনি। "চিন্তা করবেন না, সব ভালোই হবে," ভেসে আসে এক মহিলার কণ্ঠস্বর। কণ্ঠস্বরটি ছিল উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতীর। যে বৃদ্ধকে উদ্দেশ্য করে মায়াবতী আশ্বাস দিচ্ছিলেন তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী।
দিনসাতেক আগেই অশোকা হোটেলে আয়োজিত হয়েছে বিলাসবহুল টি-পার্টি। সেখানেই সুব্রহ্মণ্যম স্বামীর পৌরহিত্যে বিশেষ বৈঠক করেছেন সনিয়া গান্ধি এবং জয়ললিতা। বৈঠক শেষে NDA সরকার থেকে নিজের সমর্থন ফেরত নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন জয়ললিতা। তাঁর দলের ৩০ জন সাংসদ সমর্থন ফিরিয়ে নেওয়ায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায় অটল বিহারী বাজপেয়ী নেতৃত্বাধীন সরকার। আসলে ১৯৯৮ সালে জয়ললিতা দু'টি শর্তস্বরূপ অটলকে সমর্থন করেছিলেন। তাঁর দু'টি দাবি ছিল। প্রথমত, তামিলনাড়ুতে অপশাসনের দোহাই দিয়ে করুণানিধির নেতৃত্বাধীন ডিএমকে সরকারকে বরখাস্ত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, তাঁর এবং তাঁর দলের অন্যান্য নেতাদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সংস্থা যে তদন্ত চালাচ্ছে তা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। কিন্তু বছর ঘুরে গেলেও কোনওটাই বাস্তবায়িত না হওয়ায় AIADMK সিদ্ধান্ত নেয় NDA সরকারের থেকে সমর্থন ফিরিয়ে নেওয়ার।
জয়ললিতা সমর্থন ফিরিয়ে নেওয়ায় বাজপেয়ী সরকার কার্যত ভেন্টিলেশনে চলে যায়। অনাস্থা প্রস্তাব পাশ হয় অটলের বিরুদ্ধে। ১৭ এপ্রিল সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করতে নির্দেশ দেওয়া হয় তাঁকে। এই নির্দেশ পেতেই রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু হয়ে যায় দুই শিবিরে। লালকৃষ্ণ আডবাণী এবং প্রমোদ মহাজন যোগাযোগ শুরু করেন সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে। শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, যদি মায়াবতীকে নিজেদের দিকে আনা যায় তাহলে সরকার বাঁচলেও বাঁচতে পারে। মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টির খাতে ছিল ছয়টি ভোট। ছয় সাংসদ নিয়ে মায়াবতী ছিলেন কার্যত কিং বা কুইন মেকার।
আরও পড়ুন- ‘অটল মুখোশ মাত্র!’ এক চিঠিতেই বিজেপির ‘কম্পিউটার ম্যানে’র জীবন শেষ করেছিলেন বাজপেয়ী
আডবাণী এবং মহাজন সফল হয়েছিলেন মায়াবতীকে নিজেদের দিকে আনতে। বাজপেয়ী সরকারের পক্ষে ভোট না দিলেও, ভোটাভুটি থেকে বিরত থাকার প্রতিশ্রুতি দেন মায়াবতী। সেই কথাই ১৬ এপ্রিল বিকেলে অটল বিহারী বাজপেয়ীকে বলছিলেন তিনি। কিন্তু মায়াবতীর এই সিদ্ধান্তে বেজায় ক্ষুব্ধ হন তৎকালীন বিএসপি সাংসদ এবং বর্তমানে কেরলের রাজ্যপাল আরিফ মহম্মদ খান। আরিফের যুক্তি ছিল পরিষ্কার। উত্তরপ্রদেশে মুসলমান ভোটব্যাঙ্কে ভালোরকম দখল ছিল বহুজন সমাজ পার্টির। সেই রাতে আরিফ মায়াবতীকে জানান, বিজেপিকে সমর্থন করলে মুসলিম ভোটব্যাঙ্কে তার প্রভাব পড়বে। ইতিমধ্যেই দু'বার বিজেপির সমর্থনে সরকার গড়ে উত্তরপ্রদেশে মুসলমান সম্প্রদায়ের বিরাগভাজন হয়েছেন মায়াবতী। আরিফ মহম্মদ খানের কথায় চিন্তায় পড়ে যান মায়াবতী। রাতে আরিফ মহম্মদ খান নিজের এক পুরনো কংগ্রেসি বন্ধুকে ফোন করেন। এই বন্ধুর হাত ধরেই আশির দশকে কংগ্রেসে প্রবেশ করেন আরিফ। কিন্তু রাজীব গান্ধি তিন তালাক বিরোধী বিল পাশ করাতে সম্মত না হওয়ায় কংগ্রেস ছেড়ে দেন তিনি। পরদিন সাত সকালে মায়াবতীর দরজায় হাজির হন আরিফের সেই বন্ধু, শরদ পাওয়ার। বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ শরদ পাওয়ার মায়াবতীকে বোঝান কেন বিজেপিকে সমর্থন করা উচিত নয়। একইসঙ্গে তিনি জানান মায়াবতী এনডিএ সরকারকে সমর্থন না করলে সরকার পড়ে যাবে। এদিকে, এই মিটিংয়ের কথা জানতে পেরে যান আডবাণী। তৎক্ষণাৎ তিনি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রঙ্গরাজন কুমারমঙ্গলমকে পাঠান মায়াবতীর সঙ্গে দেখা করতে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জানান, যদি মায়াবতী বিজেপিকে সমর্থন করেন তাহলে পরদিন সকালেই উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নেবেন তিনি।
অবিশ্বাস প্রস্তাবে ভোটাভুটি হওয়ার কথা ছিল ১৭ এপ্রিল বিকেলে। মুখ্যমন্ত্রী পদের প্রস্তাব দেওয়ায় বিজেপি খানিকটা নিশ্চিন্ত ছিল মায়াবতীকে নিয়ে। অটল বিহারী বাজপেয়ী ভেবেছিলেন বিকেলের ভোটাভুটিতে আসবে না বহুজন সমাজ পার্টি। বিকেল পর্যন্ত নিশ্চিন্ত ছিলেন তিনি। কিন্তু অটল বিহারীর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায় সূর্য অস্ত যেতেই! সংসদে ভোটাভুটিতে হাজির হন মায়াবতীসহ বিএসপির ছয় সাংসদ। কোনদিকে যাবেন মায়াবতী তা নিয়ে তখনও অনিশ্চয়তা ছিল দুই শিবিরে। দীর্ঘ তর্ক-বিতর্কের পর শুরু হয় ভোটাভুটি। লোকসভায় রাখা ইলেকট্রনিক স্ক্রিনে ফুটে উঠছিল পক্ষে এবং বিপক্ষে থাকা ভোটের সংখ্যা। হঠাৎ করেই মায়াবতী সদর্পে বলে ওঠেন, "আরিফ লাল বোতাম টেপো!" লাল বোতাম অর্থাৎ সরকারের বিরুদ্ধে ভোট, অর্থাৎ অটল বিহারী বাজপেয়ীর ১৩ মাসের সরকারের অবধারিত পতন! ভোটাভুটি শেষ হলে ইলেকট্রনিক স্ক্রিনে দেখা যায় সরকারের পক্ষে ভোট পড়েছে ২৬৯টি এবং বিপক্ষে পড়েছে ২৭০টি। শেষ পর্যন্ত মাত্র ১ ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়ে পতন হয় সরকারের। চোখে জল নিয়ে প্রধানমন্ত্রী পদ ছাড়েন বাজপেয়ী এবং একইসঙ্গে শপথ নেন মায়াবতীকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার।
অটল বিহারী বাজপেয়ীর সরকার ফেললেও সরকার গড়তে অক্ষম হন সনিয়া গান্ধি। প্রথমে যাঁরা সমর্থন করেছিলেন তাঁদের অধিকাংশই সনিয়ার নেতৃত্ব মানতে অস্বীকার করেন। সর্বপ্রথম বিরোধ করেন মুলায়ম সিং যাদব। কংগ্রেসের অন্দরেও উঠতে থাকে বিরোধ। সনিয়ার সঙ্গে বিরোধিতার জেরে কংগ্রেস থেকে আলাদা হয়ে ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টি গড়েন শরদ পাওয়ার। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হন সনিয়া গান্ধি। অবশেষে রাষ্ট্রপতি লোকসভা ভঙ্গ করার নির্দেশ দেন এবং দেশে পুনরায় লোকসভা নির্বাচন হয়। এবার তৃণমূল কংগ্রেস, জনতা দল (ইউনাইটেড), ডিএমকে, শিরোমনি অকালি দল প্রভৃতি দলের সঙ্গে জোট গড়ে সরকার গড়ে বিজেপি। NDA জোটকে বাইরে থেকে সমর্থন করে তেলুগু দেশম পার্টি। ফের নিজের হারানো কুর্সি ফিরে পান বাজপেয়ী। তবে মায়াবতীর থেকে প্রতিশোধের সুযোগ আসে তিন বছর পর।
২০০২ সালে উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচনে ১৪৫ আসন জিতে সবচেয়ে বড় দল হিসেবে উঠে আসে সমাজবাদী পার্টি। ৯৮টি আসন জেতে বহুজন সমাজ পার্টি এবং বিজেপি জেতে ৮৮টি। বিএসপি এবং বিজেপি জোট বেঁধে সরকার গড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রশ্ন আসতেই পারে, তিন বছর আগে যখন মুসলমান ভোটের দোহাই দিয়ে বাজপেয়ী সরকারকে সমর্থন দেওয়া হয়নি তাহলে এখন কেন তাদের সঙ্গেই সরকার গড়ার কথা ভাবা হলো? সংক্ষিপ্ত উত্তর হতে পারে, রাজনীতিতে নীতির বড়ই অভাব। তবে মায়াবতী যতটা না জোট করতে চেয়েছিলেন, অটল বিহারী বাজপেয়ী চেয়েছিলেন তার চেয়ে বেশি। এর পিছনে ছিল এক দীর্ঘকালীন রাজনৈতিক অভিসন্ধি। বাজপেয়ী উত্তরপ্রদেশের দলিত ভোট বিজেপির পকেটস্থ করতে চেয়েছিলেন। কয়েক মাস একসঙ্গে সরকার চালিয়েই মায়াবতীও সেটি বুঝতে পারেন। বিজেপিকে রুখতে ২০০৩ সালের ২৫ অগাস্ট মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে দেন মায়াবতী। রাজ্যপালকে অনুরোধ করেন বিধানসভা ভঙ্গ করে দেওয়ার। মায়াবতী চেয়েছিলেন, ২০০৪ লোকসভা নির্বাচন পর্যন্ত উত্তরপ্রদেশে যেন রাষ্ট্রপতি শাসন জারি থাকে। চেয়েছিলেন লোকসভার সঙ্গেই যেন হয় বিধানসভা নির্বাচন।
আরও পড়ুন- ইন্দিরাকে প্রধানমন্ত্রী করেছিলেন, ইন্দিরার হাতেই শেষও হয়ে যান! কে ছিলেন কামরাজ?
কিন্তু রাজ্যপাল বিষ্ণুকান্ত শর্মা কেন্দ্র সরকারের নির্দেশ মেনে রাষ্ট্রপতি শাসন শুরু করতে অস্বীকার করেন। অটল বিহারী বাজপেয়ী গত চার বছর ধরে এই পরিস্থিতির অপেক্ষাই করছিলেন। মায়াবতীকে নাস্তানাবুদ করতে বিজেপি দ্বারস্থ হয় মায়াবতীর চিরশত্রু মুলায়ম সিং যাদবের। বিজেপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলে রাজ্যপালের কাছে সরকার গড়ার আর্জি রাখেন মুলায়ম সিং যাদব। তাঁকে সমর্থন করতে এগিয়ে আসেন উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিং, রাষ্ট্রীয় লোকদলের নেতা চৌধুরী অজিত সিং এবং উত্তরপ্রদেশের 'একদিনের মুখ্যমন্ত্রী' জগদম্বিকা পাল। এই তিন নেতার সঙ্গেই অতীতে সংঘাত হয়েছে মুলায়মের। সেই নিয়ে অন্যদিন বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে, এখন মূল কাহিনিতে ফেরা যাক।
মোট ১৬০ জন বিধায়কের স্বাক্ষরিত চিঠি নিয়ে মুলায়ম হাজির হন রাজ্যপালের কাছে। কিন্তু রাজ্যপাল তাঁকে সরকার গড়ার অনুমতি দেন না। তিনি জানান ২০৩ জন বিধায়কের সমর্থন না হলে সরকার গড়তে দেওয়া যাবে না। এমতাবস্তায় মুলায়ামের কাছে দু'টি পথ খোলা ছিল, হয় বহুজন সমাজ পার্টি থেকে বিধায়ক ভাঙিয়ে আনো, নয় বিজেপি থেকে বিধায়ক ভাঙিয়ে আনো। স্বাভাবিকভাবেই কেন্দ্রে ক্ষমতায় বসে থাকা দলের থেকে বিধায়ক ভাঙিয়ে আনা বিপজ্জনক। তাই পালোয়ান নেতা ভাঙচুর করলেন বহুজন সমাজ পার্টিতে। ১৫ জন বিধায়ক মুলায়ামকে সমর্থন করলেন। কিন্তু অঙ্কের হিসেবে তাতেও তো ২০৩ ছোঁয়া যায় না। কিন্তু এবার আর রাজ্যপাল মুলায়ম সিং যাদবকে বাধা দিলেন না। কার নির্দেশে বাধা দিলেন না, তা স্পষ্ট।
২৯ অগাস্ট উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নেন মুলায়ম সিং যাদব। একইসঙ্গে তাঁকে রাজ্যপাল জানালেন, ২০ দিনের মধ্যে বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করতে হবে। মুলায়ম মুখ্যমন্ত্রী হতেই শোরগল পড়ে যায় বহুজন সমাজ পার্টিতে। আগে ১৫ জন বিধায়ক মুলায়মকে সমর্থন করেছিলেন কিন্তু তিনি মুখ্যমন্ত্রী হতেই বিএসপির আরও ৪০ জন বিধায়ক তাঁকে সমর্থন করেন। বিধানসভায় সহজেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করেন মুলায়ম এবং ২০০৭ পর্যন্ত উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সি সামলান। এভাবেই মায়াবতীকে বিশ্বাসঘাতকতার উচিত শিক্ষা দিয়েছিলেন বাজপেয়ী। তাঁর অঙ্গুলিহেলনেই সরকার গড়া সত্ত্বেও চার বছর ক্ষমতা থেকে দূরে থাকতে হয়েছিল মায়াবতীকে। পরবর্তীকালে অবশ্য ২০০৭ সালেই এককভাবে ক্ষমতায় আসেন মায়াবতী।