পৃথিবীর সব ক-টি সমুদ্রকে কীভাবে প্লাস্টিকমুক্ত করছেন বয়ান স্ল্যাট?
The Ocean Cleanup : বর্তমানে বয়ান স্ল্যাটের এই সংস্থা বিশ্বব্যাপী নদী থেকে সমুদ্রে প্রবাহিত মোট প্লাস্টিক দূষণের আনুমানিক ১-৩ শতাংশ আটকে দিচ্ছে। আপনিও যুক্ত হতে চান এই বিরাট কর্মকাণ্ডে?
আমাদের লক্ষ্য হল ২০৪০ সালের মধ্যে সমুদ্রে ভেসে থাকা প্লাস্টিকের ৯০% সরিয়ে ফেলা। এর জন্য দরকার আপনার সাহায্য। আমরা এমন এক ভবিষ্যতের পথে এগোতে চাই যখন প্লাস্টিক আর আমাদের সমুদ্রকে দূষিত করবে না।
এটা রাষ্ট্রসঙ্ঘের বা তার কোনও সহযোগী প্রতিষ্ঠানের কোনও ঘোষণা নয়। প্লাস্টিক দূষণ রুখতে কোনও বড় দেশের অঙ্গীকারও নয়। জানলে অবাক হবেন পৃথিবীর প্রায় তিনভাগ জুড়ে থাকা সমুদ্রের বুক থেকে প্লাস্টিক ও জঞ্জাল দূর করার এমন আশ্চর্য প্রতিজ্ঞা করেছেন এক তরুণ ও তাঁর সহযোগীদল। সেই তরুণের নাম বয়ান স্ল্যাট। আর তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংস্থা বা এনজিওর নাম ‘দ্য ওশান ক্লিনআপ’। সোজা কথায় পরিবেশকে বাঁচাতে এক অভিনব যুদ্ধে নেমেছেন ডাচ যুবক বয়ান স্ল্যাট।
তবে লড়াইয়ের এই ভাবনাটা শুরু হয়েছিল আজ থেকে অনেক বছর আগে ২০১১ সালে, যখন বয়ান স্ল্যাটের বয়স মাত্র ১৬ বছর। গ্রিসে স্কুবা ডাইভিং করতে গিয়ে বয়ান দেখলেন সেখানে মাছের চেয়ে প্লাস্টিকের ব্যাগ বেশি। এটাই এই বিশ্বের পরিণতি, এমনটা ভেবে ব্যাপারটা এড়িয়েই যেতে পারতেন তিনি। কিন্তু বয়ানের মাথায় এল অন্য ভাবনা। তিনি নিজেকেই প্রশ্ন করে বসলেন, আমরা কি এগুলো পরিষ্কার করে ফেলতে পারি না?
আরও পড়ুন-
প্লাস্টিক, ডিজে, গাছ কাটা — সোনাঝুরি হাটের যে কুৎসিত দশা চোখে দেখা যায় না
সেই ভাবনা থেকেই এর ঠিক দু-বছর পর, ২০১৩ সালে সমুদ্র থেকে প্লাস্টিক দূর করার একটি অসাধারণ প্রকল্পে নেমে পড়লেন সেই ডাচ যুবক। যে-বয়স ডিস্কো থেক থেকে দুনিয়ার বিনোদন জগতে ভেসে যাওয়ার সময় সেই বয়সেই পরিবেশের কথা চিন্তা করে ‘দ্য ওশান ক্লিনআপ’ প্রতিষ্ঠা করে ফেললেন বয়ান স্ল্যাট। 'দ্য ওশান ক্লিনআপ'-এর কাজ হল সমুদ্রে ভাসমান প্লাস্টিক পরিষ্কার করা এবং প্লাস্টিক সমুদ্রে মেশার পথটিকে রুখে দেওয়া।

প্লাস্টিকে ভর্তি সমুদ্র
কাজটি এক আকাশ না হোক, সমুদ্রসমান তো বটেই। কিন্তু এই বিশাল কাজ করার সাহস ও অর্থ বয়ান স্ল্যাট পেলেন কোথা থেকে? সত্যি বলতে কী যখন বয়ানের মাথায় সমুদ্র পরিস্কারের পোকা কিলবিল করছে তখন তিনি নেহাতই যুবক। তাঁর হাতে অর্থ কোথায়? মাথায় ঢুকল ক্রাউড-ফান্ডিংয়ের কথা। অর্থাৎ নিজের নেই তো কী হয়েছে, ভাল কাজের জন্য অন্যের থেকেই অর্থ চাওয়া যাক। যার ইচ্ছে হবে তিনি নিশ্চয়ই দেবেন। আর সকলকে অবাক করে দিয়ে ক্রাউড-ফান্ডিংয়ের মাধ্যমে ২.২ মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করে ফেললেন বয়ান স্ল্যাট।
‘দ্য ওশান ক্লিনআপ’ তাদের ওয়েবসাইটে লিখছে ১৬০টি দেশের ৩৮,০০০-এর বেশি সমর্থকের সহায়তায় মাত্র ১০০ দিনে সংগ্রহ হয়ে গেল ২ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি অর্থ। ক্রাউডফান্ডিং প্ল্যাটফর্ম এবিএন আমরো’স সিডস-এর মতে, মোট ২,১৫৪,২৮২ মার্কিন ডলার সংগ্রহ সেই সময়ের ইতিহাসের সবচেয়ে সফল অলাভজনক ক্রাউডফান্ডিং প্রচারের ফসল। অনেকে জানতই না যে আসলে ‘দ্য ওশান ক্লিনআপ’ কী করতে চলেছে। তবুও পৃথিবীর ভবিষ্যতের কথা ভেবে সমুদ্র পরিষ্কার করার জন্য বিপুল অর্থ দান করেছে গোটা পৃথিবীর মানুষ। আর এই বিপুল অর্থ আর ভালবাসাই বয়ান স্ল্যাটকে যুগিয়ে দিল সমুদ্র সাফাইয়ের এক বুক সাহস।

প্লাসিক পরিস্কারক পাম্প
প্রশ্ন উঠতেই পারে, কেমন করে হয় এই সমুদ্র পরিষ্কারের কাজ? সোজা কথায় প্রতি বছর কোটি-কোটি টন প্লাস্টিক নানাভাবে সমুদ্রে এসে মেশে। ফেলে দেওয়া বোতল, স্ট্র, মাছ ধরার জাল, ক্রেট, ভাঙা খেলনা, জুতো এবং অচেনা প্লাস্টিকের টুকরো প্রভৃতির দ্বারা প্রতিদিন ভরে যাচ্ছে আমাদের সমুদ্র। কিছু মানুষ কখনও ভাবেই না যে এক সময় এগুলোই জঞ্জাল হয়ে ফিরে আসবে আমাদের কাছে।
তথ্য অনুযায়ী, এর বর্জ্য পদার্থের ৮০%-এর বেশি আসে নদী থেকে। তাই ‘দ্য ওশান ক্লিনআপ’ দুটো পথে সমাধান খোঁজার চেষ্টা করেছে — এক, বিশাল সমুদ্রে ভাসমান প্লাস্টিক সংগ্রহ করে ফেলা এবং দুই, নদীতে ইন্টারসেপ্টর মেশিন বসিয়ে প্লাস্টিক বা বর্জ্যকে সমুদ্রে পৌঁছানোর আগেই আটকে দিয়ে তা তুলে ফেলা। এখনও পর্যন্ত, ‘দ্য ওশান ক্লিনআপ’ ৮টি দেশে ১৭টি ইন্টারসেপ্টর বসিয়েছে। আর সবচেয়ে বড় বিষয় হল এই সমুদ্র পরিষ্কার কী করে হচ্ছে বা কাজের অগ্রগতি কতটা তা আপনি ঘরে বসেই সংস্থার ওয়েবসাইটে গিয়ে ট্র্যাক করতে পারেন। ‘দ্য ওশান ক্লিনআপ’-এর কাজের একটা ক্ষেত্র হল ‘গ্রেট প্যাসিফিক গারবেজ প্যাচ’ বা হাওয়াই এবং ক্যালিফোর্নিয়ার মাঝে ভাসমান বিশাল একটা আবর্জনার অঞ্চল। এখানে জমে আছে ১.৬ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটারের ঘনীভূত প্লাস্টিক বর্জ্য, যা ভেসে বেড়াচ্ছে এবং বাড়ছে।
আরও পড়ুন-
৬০৪টি তাজমহলকে ঢেকে ফেলতে পারে ভারতের প্লাস্টিক-বর্জ্য! সামনে এল যে ভয়ঙ্কর তথ্য
এই গারবেজ প্যাচ বেড়ে চলার কারণ ফি বছর আনুমানিক ১১.৫ থেকে ২৪.১ লক্ষ মেট্রিক টন প্লাস্টিক নদীপথ হয়ে সমুদ্রে প্রবেশ করছে। তথ্য অনুযায়ী, এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি প্লাস্টিক জলের চেয়ে কম ঘনত্বের। ফলে সমুদ্রে পৌঁছেও তা ডুবে যায় না। যত বেশি প্লাস্টিক জলে ফেলা হচ্ছে, ততই ‘গ্রেট প্যাসিফিক গারবেজ প্যাচে’ মাইক্রোপ্লাস্টিকের ঘনত্ব বাড়তে থাকছে।
কিন্তু ঠিক কতটা জায়গা নিয়ে আছে এই আবর্জনার স্তুপ? আকারের একটা উপমা পেলে আমাদের পক্ষে নিশ্চয়ই এর বিশালতাকে বুঝতে অনেক সুবিধে হবে। আগেই বলা হয়েছে গ্রেট প্যাসিফিক গারবেজ প্যাচের আনুমানিক আয়তন প্রায় ১৬ লক্ষ বর্গকিলোমিটার। আকারের হিসেবে তা টেক্সাসের দ্বিগুণ বা ফ্রান্সের আকারের তিন গুণ। এই গারবেজ প্যাচে বিজ্ঞানীদের ইতিহাসের সবচেয়ে বিস্তৃত স্যাম্পলিং প্রক্রিয়া চালাতে গিয়ে ব্যবহার করতে হয়েছিল ৩০টি নৌকা বা বোট, ৬৫২টি সারফেস নেট এবং প্যাচের উপর দিয়ে আকাশ থেকে আবর্জনার ছবি তোলার জন্য ২টি বিমান।
বয়ান স্ল্যাট যখন সমুদ্র পরিস্কারের ভাবনা চিন্তা করছেন তখনই তাঁর মাথায় খেলে গিয়েছিল সমুদ্রে গিয়ে মেশা নদীগুলোকে পরিস্কারের পরিকল্পনার কথা। রাষ্ট্রসঙ্ঘের ২০২৫ সালের সমুদ্র সম্মেলনে ‘দ্য ওশান ক্লিনআপ’ ঘোষণা করেছে ৩০ সিটিজ প্রোগ্রাম– যার মূল লক্ষ্য হল ২০৩০ সালের মধ্যে নদী থেকে সমুদ্রে মেশা প্লাস্টিক দূষণ এক-তৃতীয়াংশ কমিয়ে ফেলা। এশিয়া ও আমেরিকার ৩০টি গুরুত্বপূর্ণ শহরে চালু করা হবে এই আয়োজন। বিশ্বের ২০টি সবচেয়ে বেশি দূষণ সৃষ্টি করা নদীতে টানা পাঁচ বছরের কাজের অভিজ্ঞতাই ফের তাঁদের এই কাজে সামিল করেছে। কারণ বিশ্বব্যাপী সমুদ্র প্লাস্টিক দূষণের বিরুদ্ধে লড়াই, এর একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
এর পরের তথ্যটি আপনাকে অবাক করতে বাধ্য। এখনও পর্যন্ত ‘দ্য ওশান ক্লিনআপ’ সমুদ্রে প্রবেশের আগে নদী পথে প্রায় ২.৯ কোটি কিলোগ্রাম বর্জ্য আটকে দিতে পেরেছে। বর্তমানে বয়ান স্ল্যাটের এই সংস্থা বিশ্বব্যাপী নদী থেকে সমুদ্রে প্রবাহিত মোট প্লাস্টিক দূষণের আনুমানিক ১–৩ শতাংশ আটকে দিচ্ছে। আপনিও যুক্ত হতে চান এই বিরাট কর্মকাণ্ডে? ‘দ্য ওশান ক্লিনআপ’ ওয়েবসাইটে গেলেই দেখবেন খোলা আছে নানা পথ। নিজে থেকেই নিতে পারেন আপনার বাড়ির কাছ দিয়ে বয়ে চলা সমুদ্রে মেশা নদীটিতে প্লাস্টিক বর্জ্য না ফেলার উদ্যোগ। দিতে পারেন ডোনেশন, অথবা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিতে পারেন এর নানা কাজের আপডেট। হতে পারেন সিটিজেন সায়েন্টিস্ট। সোজা কথায় চাইলেই বয়ান স্ল্যাটের মতো আপনিও হয়ে যেতে পারেন সমুদ্র পরিস্কারের একজন অংশীদার।
তথ্য ঋণ ও ছবি: THE OCEAN CLEANUP
Whatsapp
