ঐন্দ্রিলার 'মিরাকল' যেভাবে মিলিয়ে দিল তারাপীঠের বামাক্ষ‍্যাপা ও প্রেমিক সব‍্যসাচীকে

Aindrila Sharma: কীভাবে সাদামাটা অভিনেতা থেকে বাস্তবের বামাচরণ হলেন অভিনেতা সব্যসাচী চৌধুরী?

জয় তারা... শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা ছাড়িয়ে বীরভূমের লালমাটির তারাপীঠের এই জয়ধ্বনি ছড়িয়ে পড়েছিল বাংলার ঘরে ঘরে। রাত দশটায় গ্রাম-শহরের বিভেদ ঘুচিয়ে বাংলার অধিকাংশ ঘরের চোখ থাকত টেলিভিশনের দিকে। বঙ্গের বিনোদুনিয়ায় আবির্ভাব ঘটেছিল তারা মায়ের। সেই ধর্ম-ভক্তি আর বিশ্বাসের আবহ এবং জ্বলন্ত অভিনয়ের দর্পণে ধরা দিয়েছিলেন অভিনেতা সব্যসাচী চৌধুরী। নাট্যমঞ্চ, 'ঝুমুর' ধারাবাহিক আর একাধিক অভিনয়ের আবহেই উঠে এসেছিলেন হাওড়ার সব্যসাচী। মেধাবী ছেলেটির অভিনয় প্রতিভা মুগ্ধ করেছিল বাংলাকে। পর্দার 'বামাচরণ' অচিরেই হয়ে উঠেছিলেন বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এমনকী, পরিস্থিতি যে পর্যায়ে গিয়েছিল, তাতে সব্যসাচী না তারাপীঠের সেই সন্ন্যাসী বামাক্ষ্যাপা! এই প্রশ্নেও মশগুল হয়েছিলেন রাজ্যের গ্রামগঞ্জের ধারাবাহিক-প্রিয় জনতা!

আর এখন? ফের এক অন্যরকম জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছেছেন তিনি। ঘনিষ্ঠমহলে আপাদমস্তক শান্ত স্বভাবের এই মানুষটিই ফের উঠে এসেছেন নতুনভাবে। ২০২১-এ প্রেমিকা ঐন্দ্রিলা শর্মার সঙ্গে তাঁর অবস্থান সোশ্যাল দুনিয়ায় অন্যতম করে তুলেছে তাঁকে। যা আজও বিবর্তিত। হাওড়ার বেসরকারি হাসপাতাল, ঐন্দ্রিলার নতুন করে বাঁচার লড়াই, রাতের পর রাত প্রেমিক সব্যসাচীর জেগে থাকাও আলোচনার কেন্দ্রে এনেছে তাঁকে। অনেকেই বলেন, কর্তব্য পালন করলেও সব্যসাচীর তারকা-পরিচিতি এবং একজন প্রেমিকার অসময়ে এইভাবে এগিয়ে থাকা সামগ্রিকভাবে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছে তাঁকে।

কিন্তু কীভাবে সাদামাটা অভিনেতা থেকে বাস্তবের বামাচরণ চট্টোপাধ্যায় হলেন অভিনেতা সব্যসাচী চৌধুরী? এই প্রশ্নের আবহেই জেনে নেওয়া প্রয়োজন। আসলে কে এই সব্যসাচী।

আরও পড়ুন: লড়ে দেখালেন ঐন্দ্রিলা, এভাবেও ফিরে আসা যায়

হাওড়ার বেলুড় এলাকার বনেদী পরিবারের সন্তান সব্যসাচী। বরাবর প্রতিপত্তিশালী চৌধুরীদের পুত্র পড়াশুনায় ছিলেন মেধাবী। বিদেশে উচ্চশিক্ষা। ইংল্যান্ডের নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অক্সফোর্ড ব্রুক্স থেকে ডার্ক ট্যুরিজমে স্নাতকোত্তর। পড়া শেষ করে ইংল্যান্ডেই প্রশিক্ষণ। কাজ শুরু। কিন্তু কে শোনে কার কথা! জীবনকে প্রতিষ্ঠানের বাইরে নতুন করে দেখার তাগিদে, কিছুদিন ইংল্যান্ডে অভিজ্ঞতা অর্জন করে ফিরলেন দেশে। বারণ করলেন পরিবারের অনেকেই। কিন্তু সব্যসাচী চলে এলেন নিজের দেশে।

অভিনয়ে হাতেখড়ি
থিয়েটারের সংক্ষিপ্ত-পর্ব কাটিয়ে বরাবর মৌলিক প্রতিভার বশে, সব্যসাচী পা দিলেন অভিনয় জগতে। 'এসো মা লক্ষ্মী' ধারাবাহিকে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বের চরিত্রে অভিনয় দিয়ে শুরু হল পুরোদমে কাজ। সেইভাবে আর কেরিয়ারের জন্য পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। কেরিয়ারগ্রাফে তখন তীব্র লড়াই চললেও স্বপ্নের মায়াজালে সব্যসাচী ছিলেন বিভোর। এলো একের পর এই সুযোগ। 'অগ্নিজল' ধারাবাহিকে অভিনয়। বড় সুযোগ পেলেন 'ভক্তের ভগবান শ্রীকৃষ্ণ' ধারাবাহিকে। সেখানে যুধিষ্ঠির চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে জনপ্রিয় হলেন আর এক কৃষ্ণ সব্যসাচী। এরপর ২০১৭ সাল নাগাদ 'ঝুমুর' (Jhumur) ধারাবাহিক। যা সব্যসাচীর পরিচয়ে আগমন ঘটালো প্রেমিক সত্তার। বরাবর ঈশ্বর সংক্রান্ত ধারাবাহিকের অভিনয়-খোলস ছাড়িয়ে সব্যসাচী হয়ে উঠলেন অনন্য। অনবদ্য। সঙ্গে তখন নবীন অভিনেত্রী, বন্ধু ঐন্দ্রিলা। এরপর 'ওম নমঃ শিবায়' ধারাবাহিকে বিষ্ণুর চরিত্র। 'জড়োয়ার ঝুমকো'-য় অর্ণবের ভূমিকায় অভিনয় করতে করতেই এল বড় সুযোগ। 'সাত ভাই চম্পা'-য় পেলেন রাজা নক্ষত্রজ্যোতির চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব। তারপর সব্যসাচীর অভিনয়-জীবনে ঝড় আনল 'মহাপীঠ তারাপীঠ' ধারাবাহিক। দীর্ঘদিন চলা এই পর্বে বামাক্ষ্যাপার চরিত্রে দাগ কাটলেন সব্যসাচী। অতি জনপ্রিয় হলেন সব্যসাচী চৌধুরী। তারপর একাধিক ওয়েবসিরিজ, বিজ্ঞাপন, শর্ট ফিল্ম-এ অভিনয় ইন্ডাস্ট্রিতে কদর বাড়িয়েছে তাঁরও। সম্প্রতি বন্ধু ঐন্দ্রিলার সঙ্গেই 'ভাগাড়' ওয়েবসি রিজে তাঁর অভিনয় নজর কেড়েছে ফের।

বামাক্ষ্যাপা সব্যসাচী
২০১৯ সাল। তারাপীঠ তারার কাহিনি নিয়ে ধারাবাহিক তৈরির পথে এগোলেন নৈরিতা দাসেরা। একটি বেসরকারি জনপ্রিয় বিনোদন চ্যানেলের জন্য দাসানি স্টুডিওতে শুরু হল শুটিং।

যদিও এই ধারাবাহিকের প্রধান চরিত্র বামাচরণের  প্রথমেই নির্বাচিত হননি সব্যসাচী। একাধিক অভিনেতার জন্য অডিশনের একদিন ডাক পড়ল সব্যসাচীর। বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেবতার চরিত্রে অভিনয়ে পটু সব্যসাচীর জন্য নির্ধারিত হয় ওই চরিত্র। হয় লুক টেস্ট। তখনও এই ধারাবাহিক চলবে কি চলবে না, এই  সন্দিহান প্রযোজকরা। শুরু হলো কাজ।

৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯
বেসরকারি ওই জনপ্রিয় বিনোদন চ্যানেলে শুরু হল 'মহাপীঠ তারাপীঠ' ধারাবাহিক সম্প্রচার। প্রধান ভূমিকায় সব্যসাচী চৌধুরী এবং তারার ভূমিকায় অভিনেত্রী নবনীতা দাস। ক্রমশ এক সপ্তাহ অতিবাহিত হওয়ার পরেই জনপ্রিয় হতে শুরু করল রাত দশটায় সম্প্রচারিত এই ধারাবাহিক। মাসখানেক যেতেই টিআরপি রেটিংয়ে প্রথমের দিকে উঠে এল নতুন শুরু হওয়া এই ধারাবাহিক। লোকমুখে প্রচলিত হল বামার নাম। অর্থাৎ সব্যসাচীর অভিনয়, বাচনভঙ্গি প্রায় বাস্তবের বামাক্ষ্যাপাকে নামিয়ে আনল পর্দায়। জানা যায়, সব্যসাচী এই চরিত্রে অভিনয়ের জন্য শারীরিক গঠন থেকে শুরু করে কথা বলার ভঙ্গি, সবক্ষেত্রেই বিশেষ প্রশিক্ষণও নিয়েছিলেন।

২০২০ সাল। প্রায় একবছর অতিক্রম করলেও 'মহাপীঠ তারাপীঠ' ধারাবাহিকের জনপ্রিয়তা কমেনি। ক্রমশ বাড়তে থাকে টিআরপি রেটিং। এদিকে 'ঝুমুর' একাধিক দেবদেবী ধারাবাহিকে অভিনয় করলেও এই একটি ধারাবাহিক প্রবল জনপ্রিয় করে তোলে সব্যসাচীকে।

২০২১। প্রায় একই থাকে এই ধারাবাহিকের অবস্থান। ঠিক এই সময়েই ঐন্দ্রিলাকে নিয়ে ফের বিধ্বস্ত হচ্ছেন অভিনেতা। প্রেমিকার শরীরের মারণরোগ, তাঁর চিকিৎসা সংক্রান্ত কাজে যোগ দিয়েছেন সব্যসাচী। কিন্তু এর মধ্যেও চলছে শুটিং। ধারাবাহিকের প্রধান চরিত্রের ভূমিকা পালন করেও সব্যসাচীর প্রেমিকা সঙ্গ, তাঁর জীবন লড়াইয়ে চলছে সমান সংযোগ।

২০২২। প্রায় ৭৮১টি এপিসোড সম্পুর্ণ করার পর এই ধারাবাহিক নিয়ে শুরু হয় টানাপড়েন। সময় পরিবর্তন নিয়ে ওঠে প্রশ্ন। অবশেষে প্রায় তিন বছর কাটিয়ে ২০২২ এর ফেব্রুয়ারি নাগাদ শেষ হয় এই ধারাবাহিক। শোনা যায়, প্রায় তিনবছর পর নিজের দাড়ি সম্পূর্ণ কাটান সব্যসাচী। যা বহুদিন চরিত্রের জন্য রেখে দিতে হয়েছিল পোড়খাওয়া এই অভিনেতাকে।

কিন্তু শেষের দিকেও প্রায় ৬.১ টিআরপি রেটিং এবং আইএমডিবি-র রেটিংয়ে ৫.৭ নম্বর পাওয়া এই ধারাবাহিকের হঠাৎ বন্ধ হওয়া নিয়ে ওঠে প্রশ্ন। শুরু হয় বিতর্কও। বলা হয়, ওই বিনোদন চ্যানেলে প্রচারিত 'মা' ধারাবাহিকের পর, 'মহাপীঠ তারাপীঠ' এমন একটি ধারাবাহিক, যা বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। এমনকি বলা হয়, বাংলার অন্যতম জনপ্রিয় ধারাবাহিকের হিসেবে প্রায় প্রথমের দিকে ছিল এই ধারাবাহিক। যা সম্পূর্ণত সব্যসাচী চৌধুরীর ভূমিকায় সম্ভব হয়েছিল বলেও দাবি ওঠে।

অর্থাৎ যে অভিনেতা কয়েকটি কাজ এবং নাটকের মঞ্চেই সীমাবদ্ধ ছিলেন এতদিন, সেই অভিনেতাই ক্রমশ হয়ে উঠলেন অসাধারণ। অনবদ্য এবং জনপ্রিয়।

প্রেমিক সব্যসাচী
২০১৭ সালে বহরমপুর থেকে আসা ২০ বছরের নবীন অভিনেত্রী যে মেয়েটির হাত ধরেছিলেন তিনি। যে 'ঝুমুর' ধারাবাহিকে হওয়া পরিচয়ে প্রেমের গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন সব্যসাচী, তার বিচ্ছেদ ঘটেনি আজও। প্রেমিকা ঐন্দ্রিলার জীবন বদলে দেওয়ার কারিগর হিসেবে বারবার উঠে এসেছে তাঁর নাম। আজ যে সব্যসাচী রাতের পর রাত জাগছেন হাসপাতালের করিডরে। এই সব্যসাচীকেই দেখা গিয়েছিল ঐন্দ্রিলা দ্বিতীয়বার ক্যান্সার আক্রান্ত হলে তাঁর সঙ্গে থাকতে। যে কর্তব্য তিনি তাঁর দায়বদ্ধতা থেকে করেছেন! সাধারণভাবে এই প্রশ্ন উঠলেও আসলে প্রেমিক সব্যসাচীর এই ভূমিকা নাড়িয়ে দিয়েছিল বিচ্ছেদ-মিলনের দোলাচলে দুলতে থাকা বিশ্বকে।

ঠিক কী করেছিলেন তিনি? অনেকেই বলেন, প্রেমিক হিসেবে, প্রেমের জন্য, সম্পর্কের জন্য, প্রিয় মানুষের জন্য যা যা প্রয়োজন, বিনা স্বার্থে যেটুকু করা প্রয়োজন সকলের, তার চেয়ে অনেক বেশি করেছেন তিনি! কেন? ঐন্দ্রিলার ভেঙে পড়ার মুহূর্তে ভরসা জুগিয়েছেন, পাশে থেকেছেন সব্যসাচী। যা প্রিয়ের জন্য সর্বাধিক দরকার শুধু নয়, কাছের মানুষের বিপদের সময় সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনও। আর সেই মৌলিক চিত্রই দেখেছে এই দেশ। নেটমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছেন তাঁরা। যা তাঁদের কাছে ব্যক্তিগত, অতি সাধারণ, তাই-ই যেন দূরত্বের পৃথিবীতে হয়ে উঠেছে বিরল। সব্যসাচীময় হয়েছেন ঐন্দ্রিলা। আর জীবনের 'বিগ বস' ঐন্দ্রিলা জড়িয়েছেন সব্যসাচীকে।

'অন্য' সব্যসাচী
'দৃষ্টি একই থাকে, দৃষ্টিকোণ বদলায় বারবার।' মৌলিক অভিনেতা সব্যসাচীর লেখক-সত্তার প্রথম নিদর্শনের ভূমিকায় উঠে এসেছিল এই বাক্যই। ২০২২ এর ২৮ ফেব্রুয়ারি, কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় তাঁর হাত ধরে বার্তা প্রকাশনের তরফে প্রকাশ পায় তাঁর লেখা প্রথম বই 'দলছুটের কলম'। সব্যসাচী বলেছিলেন, ''বরাবর ফেসবুকে লিখতাম। নিজের কথা বলতাম। অনেকেই বলতেন বই হিসেবে প্রকাশের। অবশেষে ইচ্ছাপূরণ। বই বেরল।'' যে বই লেখার রসদ ছিলেন প্রেমিকা ঐন্দ্রিলাও। যিনি বই পড়তে খুব একটা ভালো না বাসলেও সব্যসাচীর বই লেখার তাগিদ, উপকরণে তাঁর ভূমিকা ছিল সর্বাধিক। এই বই মূলত, বিভিন্ন সময়ের অনুভূতির কথার সমষ্টি। 'বামাক্ষ্যাপা'র টেলিভিশনপর্ব শেষ হতেই বই লেখার কাজ শেষ করেন সব্যসাচী। বইমেলায় প্রকাশিত তাঁর প্রথম বই। যা সমাদৃত হয় পাঠক মহলে।

'ব্যবসায়ী' সব্যসাচী
চলতি বছরেই বন্ধু, জনপ্রিয় অভিনেতা 'মন্টু পাইলটে'র সঙ্গে হাত মেলান 'বামা'। সৌরভ দাসের সঙ্গে মিলে সল্টলেকের সেক্টর একে খোলেন একটি রেস্তোরাঁ। 'হোদোলস্' নামের ওই রেস্তোরাঁর মাধ্যমে সব্যসাচী শুরু করেন নতুন কাজ।

অভিনয়ে সাফল্য। লেখক হিসেবে পরিচিতি। নতুন উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার মধ্যেই, আবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টার মধ্যেই ফের বিপর্যয়। একদিন আগেই (৩১ অক্টোবর) নিজের জন্মদিনে যে প্রিয় মানুষটির কাছ থেকে শুনেছিলেন 'বেঁচে টাকার কারণ তিনি', সেই ঐন্দ্রিলা আজ ফের শয্যাশায়ী। ১ নভেম্বর থেকে নতুন লড়াই লড়ছেন তিনি। যে প্রেমিকার জন্য একদিন নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে, ধারাবাহিকের মায়া ত্যাগ করে দিনরাত পড়ে থাকতেন সব্যসাচী, আজ আবার সেই তাঁর জন্যই রাতের পর রাত জাগছেন তিনি।

প্রিয় মানুষের জন্য হয়তো এটাই করণীয়! তবু সব্যসাচী ব‍্যতিক্রম হয়ে রইলেন।

More Articles