সিসমোগ্রাফ থেকে রিখটার স্কেলের ইতিহাস | ভূকম্পন কীভাবে মাপা হয়?

Seismographs and Richter Scale: ১৮৭৫ সালে ফিলিপো সোচ্চি সর্বপ্রথম ভূকম্পন ধরার জন্য পেন্ডুলামের ব্যবহার করেন। কম্পনের প্রকৃতি অনুযায়ী, পেন্ডুলামের দোলনের ফলে কাগজের উপর লিপিবদ্ধ হত সে রেখাচিত্র।

কয়েকদিন আগেই শহর কলকাতায় ভূমিকম্প হয়েছে; আতঙ্কিত হয়ে মানুষজন বহুতল অফিস থেকে রাস্তায়ও নেমে পড়েন। ইন্টারনেটের কল্যাণে সেই দৃশ্য আমরা সকলেই দেখেছি । যদিও সেই ভূমিকম্পের তীব্রতা খুবই কম, রিখটার স্কেলে ৫.৭; পরে জানা যায় এর উৎপত্তিস্থল আমাদের প্রতিবেশী দেশ, বাংলাদেশের নরসিংদীর মাধবদী।

সাধারণত কোনো ভূমিকম্প হলে লোকজন আগে জিজ্ঞেস করে এর তীব্রতা কত? উৎস কোথায়? ইত্যাদি। কমবেশি আমরা সকলেই জানি সিসমোগ্রাফ যন্ত্রের সাহায্যে পরিমাপ করা হয় ভূ-কম্পন, আর রিখটার স্কেলে মাপা হয় তীব্রতা। কিন্তু আমরা কি জানি সিসমোগ্রাফ কী করে তৈরি হলো বা রিখটার স্কেল কীভাবে কাজ করে? আর কোনো ভাবে কি ভূকম্পন পরিমাপ করা যায়?

সিসমোগ্রাফের ইতিহাস অনেক পুরনো; ১৩২ খ্রিস্টাব্দে, হান গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী, চ্যাং হেং সর্বপ্রথম তৈরি করেন সিসমোস্কোপ। গঠনটা ছিল অভিনব; ব্রোঞ্জের তৈরি পাত্রের চারপাশে ড্রাগনের মাথা লাগানো আর নিচের দিকে আছে ব্যাঙের মুখ। কোনোরকম কম্পন শুরু হলেই ড্রাগনের মুখে থাকা বল নিচে ব্যাঙের মুখে পড়ে টং করে আওয়াজ হত, আর বোঝা যেত কোনদিকে ভূমিকম্প হচ্ছে। তবে, চ্যাং-এর সেই যন্ত্রে কম্পনের তীব্রতা মাপার কোনো উপায় ছিল না। তারপরে, পরিস্থিতি বদলেছে; বিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টায় বারংবার বদল হয়েছে যন্ত্রের নকশা। অষ্টাদশ শতাব্দীতে, পালমিয়েরি নামক এক ব্যক্তি  বৈদ্যুতিক বর্তনী নির্ভর একটি যন্ত্র বানালেন, যেটিতে কম্পনের রেকর্ড রাখা যেত। তার দু'দশক পরে, ১৮৭৫ সালে ফিলিপো সোচ্চি সর্বপ্রথম ভূকম্পন ধরার জন্য পেন্ডুলামের ব্যবহার করেন। কম্পনের প্রকৃতি অনুযায়ী, পেন্ডুলামের দোলনের ফলে কাগজের উপর লিপিবদ্ধ হত সে রেখাচিত্র। তারপর, ১৮৮০ সালে, ইউইং, গ্রে ও জন, নামক তিন বিজ্ঞানী প্রথম আধুনিক রেকর্ডিং সিসমোগ্রাফ তৈরি করেন। সেখান থেকেই শুরু হয় আধুনিক সিসমোলোজির যাত্রা।

আরও পড়ুন

NISAR: ভূমিকম্প থেকে জলবায়ুর পরিবর্তনের কথা জানাবে স্যাটেলাইট! ‘নিসার’-র থেকে কী কী জানা যাবে?

ঠিক কী ভাবে কাজ করে এই যন্ত্র?

এই যন্ত্রটি মূলত দাঁড়িয়ে আছে জড়ত্বীয় বলবিদ্যার পরিচিত কিছু নিয়মের উপর। পেন্ডুলাম গোত্রের একটি ভারী বস্তু তারের মাধ্যমে একটি কাঠামোর মধ্যে ঝোলানো থাকে; ভূমিকম্পের সময় কাঠামোটি নড়ে ওঠে, অপরদিকে জাড্য ধর্মের জন্যে, ভরটি স্থির থাকার চেষ্টা করে। এই দুইয়ের টানাপোড়েনে যে আলোড়নের সৃষ্টি হয়, তারই নাম সিসমোগ্রাম। এতে থাকা সুক্ষ সুক্ষ রেখাচিত্রের বিশ্লেষণে জানা যায় কম্পনের গতি প্রকৃতি, তীব্রতা, উৎস, স্তায়িত্ত্ব, ইত্যাদি।

তবে, এখনকার সময়ে সিসমোগ্রাফ আর কাগজ-কালির লেখচিত্র নয়, উন্নত প্রযুক্তির সেন্সর ও অ্যালগরিদমের কল্যাণে, এটি এতই সূক্ষ্ম ও সুবেদি হয়ে উঠেছে যে, ভূকম্পন ছাড়াও বিভিন্ন সুক্ষাতিসুক্ষ কম্পন সে স্বতন্ত্র ভাবেই রেকর্ড করে রাখতে পারে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ভূমিকম্প মাপা বিশেষ স্কেলটি  উদ্ভাবন করেছিলেন মার্কিন ভূমিকম্প বিজ্ঞানী চার্লস রিখটার এবং জার্মান বিজ্ঞানী বেনো গুতেনবার্গ ।

এই রিখটার স্কেল আসলে কী?

বিজ্ঞানে শক্তির পরিমাপ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে শক্তির পরিমাপ করার কোনো উপায় এতদিন বিজ্ঞানীদের জানা ছিল না। শুরু থেকেই রিখটার এবং তাঁর সহকর্মী গুতেনবার্গ চেষ্টা করছিলেন কোনো ভাবে যদি ভু-কম্পনে নির্গত শক্তির পরিমাপ করা যায়। অবশেষে, ১৯৩৫ সালে এই দুই বিজ্ঞানী একটি লগারিদম-ভিত্তিক স্কেলের প্রচলন করেন, যার ফলে ভূমিকম্পের মাত্রা বা আকার নির্ধারণ করা সহজ হয়।

এই স্কেলটির মাত্রা সাধারণত ১-১০ পর্যন্ত হয়; ৩ পর্যন্ত বলা হয় ছোট ভূমিকম্প, ৩-৭ মাত্রার ভূমিকম্পকে বলে মধ্যম মানের ভূমিকম্প, তার উপরে গেলেই তা বিধ্বংসী আকার ধারণ করে। রিখটার স্কেলে মান এক ইউনিট বাড়লে তীব্রতা বাড়ে ১০ গুণ, অর্থাৎ ৩ মাত্রার ভূমিকম্পের  চেয়ে ৫ মাত্রার ভূমিকম্প ২০ গুণ তীব্র। যে লগারিদম ব্যবহার করা হয়েছে, তার ভিত্তি বা বেস ১০; সুতারং ৩ ও ৫ মাত্রার ভূমিকম্পের তীব্রতার পার্থক্য নিম্নলিখিত উপায়ে গণনা করা হয়;  তীব্রতার পার্থক্য = 10 × (৫ - ৩) = ২০।

আরও পড়ুন

ভয়াবহ ভূমিকম্পের কবলে বাংলাদেশ, ক্ষয়ক্ষতি ঠিক কতটা?

শুরুর দিকে, এই স্কেলে কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল, বিশেষ করে শক্তিশালী ভূমিকম্পের তরঙ্গের পরিমাপের সময় বারবার স্যাচুরেশন সমস্যায় পড়তে হত। অর্থাৎ একটা নির্দিষ্ট মানের উপরে গেলে যন্ত্রের কাঁটা আটকে যেত, ফলে বেশি মাত্রার ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে রিডিং অনেক সময় ঠিক আসত না। আরেকটি বড় সমস্যা ছিল, এটি শুধু সর্বোচ্চ তরঙ্গের উচ্চতা দেখে মাত্রা নির্ধারণ করত। ফলে কম্পনে মোট কত শক্তি নির্গত হয়েছে বা কোথায় বড় ফল্ট দেখা গিয়েছে, অথবা ফাটলের সঠিক মাপ কী, এসব কিছু জানা যেত না।

এইসব দুর্বলতাগুলো সংশোধনের জন্য পরবর্তীতে রিখটার স্কেল আপডেট করেন বিজ্ঞানী রিখটার ও গুতেনবার্গ। প্রবর্তন করেন আরও উন্নত দু'টি স্কেল-বডি-ওয়েভ ম্যাগনিটিউড স্কেল ও সারফেস-ওয়েভ ম্যাগনিটিউড স্কেল। প্রথমটির সাহায্যে পৃথিবীর ভূ-গর্ভে প্রাথমিক তরঙ্গ (P-Wave) ও মাঝারি তরঙ্গের (S-Wave) গণনা করা হয়। দ্বিতীয় স্কেলটি, পৃথিবীর পৃষ্ঠ বরাবর প্রবাহিত লাভ ও রেলে তরঙ্গগুলোর মাত্রা গণনা করার কাজে ব্যবহুত হয়।

সত্তরের দশকের শেষের দিকে জাপানি বিজ্ঞানী কানামোরি এবং মার্কিন বিজ্ঞানী হ্যাঙ্কস মিলে তৈরি করেন আধুনিক এক স্কেল, মোমেন্ট ম্যাগনিটিউড স্কেল। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে মোমেন্ট ম্যাগনিটিউড স্কেল রিখটার স্কেলের থেকে বেশি নির্ভুল পরিমাপ করে, কিন্তু রিখটার স্কেল এতই জনপ্রিয় ভূমিকম্পের মাত্রা বললেই এখনও রিখটার স্কেলের নামটাই ঘুরতে থাকে সাধারণ মানুষের মাথায়।

যাইহোক, আধুনিক প্রযুক্তির যুগে আমরা আর অল্পতে খুশি নই, সিসমোগ্রাফের মাধ্যমে ভূমিকম্পের খুঁটিনাটি তো জানা গেল, কিন্তু এর আগাম পূর্বাভাস মিলবে কি? এখনও পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের কাছে এর কোনো সদর্থক উত্তর নেই। তবে তাঁরা চেষ্টা করছেন সুপার-কম্পিউটিং ও মেশিন লার্নিং পদ্ধতি ব্যবহার করে ফল্ট লাইন বরাবর চাপ, পাথরের গঠনের আকস্মিক পরিবর্তন বিষয়ক গবেষণা করছেন— যদি ভবিষ্যতে কোনোদিন আশার আলোর মুখ দেখা যায়।

 

More Articles