টলাতে পারে না ৪০ কেজি বিস্ফোরকও! কীভাবে তৈরি হল দেশের প্রথম কেবল স্টেড ব্রিজ?

India's First Cable-stayed Bridge : ২১৩ কেজি সমান প্রবল ঝড়ো হাওয়া অথবা মারাত্মক বিস্ফোরণ সবেতেই অবিকল থাকবে এই অভিনব সেতুটি।

আর মাত্র মাস দুয়েক, তারপরই চালু হয়ে যেতে পারে দেশের প্রথম কেবল-স্টেড ব্রিজ। দুর্গম জম্মু কাশ্মীরের পথ এবার হতে পারে আগের থেকে অনেক সুগম। অভিনব এই ব্রিজ নির্মাণের কাজ প্রায় শেষের পথে। উত্তর রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই বছরের মে মাসের মধ্যে সেতুটির ডেক প্রস্তুত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। একবার প্রস্তুত হলে, জম্মু থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে নির্মিত সেতুটিতে ১০০ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা বেগে ট্রেন চলবে। কাটরা এবং বানিহালকে জুড়বে এই সেতু। কেবল তারের সাহায্যেই জোড়া রয়েছে এই বিশেষ সেতু।

এতদিন যাবৎ এই অঞ্চল ছিল খুবই দুর্গম, অথচ জনপ্রিয়তা কোনও অংশেই কম ছিল না এখনকার। ফলে সেই কথা মাথায় রেখেই কাজ শুরু করে রেল কর্তৃপক্ষ। অত্যাধুনিক এই সেতুর রয়েছে বিশেষ কিছু ক্ষমতা। জানা গিয়েছে ২১৩ কিমি প্রতি ঘণ্টায় বইতে থাকা ঝড়কেও অনায়াসে রুখে দিতে পারে এই সেতু। শুধু তাই নয় ২৯০ মিটার দীর্ঘ এই সেতুটিতে লাগানো রয়েছে বেশ কিছু সেন্সর। ৪০ কেজি বিস্ফোরকও সেতুটির কোনও ক্ষতি করতে পারবে না, বলেই জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

আরও পড়ুন - পৃথিবীর উচ্চতম সেতুর উপর দিয়ে বন্দে ভারত! মেঘের উপর দিয়ে এবার যে গন্তব্যে যাবে ট্রেন

দুর্গমতাকে জয় করার মোহ মানুষের চিরকালীন। ঠিক এই কারণেই সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করার কাজ করে চলেছেন বিশেষজ্ঞরা। কর্মকর্তাদের মতে, ইতিমধ্যেই এই আঞ্জি সেতুর ৪৭টি বিভাগের মধ্যে ৪১টির কাজ সম্পন্ন হয়ে গিয়েছে। বাকিগুলিও এপ্রিলের শেষের দিকে বা মে মাসের প্রথম সপ্তাহে শেষ হয়ে যাবে বলেই আশাবাদী তাঁরা।

নির্মীয়মাণ এই সেতুটির আর ৫২.৫ মিটার অংশের কাজ বাকি। যা অনায়াসেই মাস দুয়েকের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। মোট ৯৬টি কেবল তথা তার দিয়ে তৈরি হওয়া সেতুটি নির্মাণের সময়ই পরীক্ষা চালিয়েছে আইআইটি রুরকি এবং আইআইটি দিল্লি। নির্মাণ সম্পূর্ণ হওয়ার পরও নিয়মিত পরীক্ষা করা হবে সেতুটি। যেহেতু ওই এলাকায় নিয়মিত ধস কিংবা ভূমিকম্প হয় তাই এর স্বাস্থ্যের দিকে নজর রাখার জন্য এই বিশেষ পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

বর্তমানে, উধমপুর থেকে কাটরা সেকশনের মধ্যে ট্রেন চলাচল করার কথা জানা গিয়েছে। ১১১ কিলোমিটার কাটরা থেকে বানিহাল লাইনের প্রকল্পের কাজ বর্তমানে চলছে এবং আঞ্জি ও চেনাবের সেতু সহ এই বিভাগের ৫২ কিলোমিটার মহারাষ্ট্র-সদর দফতর কোঙ্কন রেলওয়ে দ্বারা নির্মিত হচ্ছে। পাশাপাশি জানা গিয়েছে, এই পথে বানিহাল এবং বারামুল্লাও ট্রেন দ্বারা সংযুক্ত হবে।

প্রকল্পটি সম্পন্ন হলে কী কী বিশেষ সুবিধা পাওয়া যেতে পারে?

দেশের প্রথম কেবল-স্টেড ব্রিজ নির্মাণের কাজ একবার সম্পূর্ণ হলে, এই USBRL প্রকল্পটি কাশ্মীর উপত্যকাকে জাতীয় রেল নেটওয়ার্কের সাথে সংযুক্ত করবে। আঞ্জি ব্রিজ হল এমন একটি সেতু যা একটি একক তোরণে নির্মিত এবং এর উভয় প্রান্তে সুড়ঙ্গ রয়েছে। কাটরা প্রান্তে একটি টানেলের দৈর্ঘ্য ৫ কিমি এবং কাশ্মীরের প্রান্তে আরেকটি টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ কিমি। উভয় দিকেই স্থাপন করা হয়েছে নির্দিষ্ট একটি ট্র্যাক। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আঞ্জি সেতুর তারের স্থিত অংশটি ৪৭২.২৫ মিটার যেখানে সেতুটির মোট দৈর্ঘ্য ৭২৫.৫ মিটার, যা একটি বাঁধ সহ চারটি অংশে বিভক্ত। জানা গিয়েছে, ২০১৭ সালেই প্রথম এই বিশেষ সেতু নির্মাণের কাজ শুরুর পরিকল্পনা করা হয়। যদিও মূল ক্যাবল-স্টেড ব্রিজের কাজটি শুরু হয় ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে। প্রবল ঝড়ো হাওয়া এবং ৪০ কেজি সমান বিস্ফোরক সহ্য করা পাশাপাশি সেতুটিতে একটি সমন্বিত মনিটরিং সিস্টেমও থাকবে যেখানে বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য সেন্সর লাগানো থাকবে, যা সেতুটির সবকিছু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যবেক্ষণ করবে।

রেলওয়ে আধিকারিকদের মতে, সেতুটি হিমালয়ের ইয়ংফোল্ড পর্বতে অবস্থিত যেখানে পথ খুবই দুর্গম। অসংখ্য ভাঁজ, গিরিখাত সমন্বিত। এছাড়া এই অঞ্চল ভূমিকম্প প্রবণও বটে। ফলে সবধরনের সাবধানতার কথাই মাথায় রাখা হয়েছে।

আরও পড়ুন - ৫ ঘণ্টায় কামরূপ-কামাক্ষা! বন্দে ভারত এক্সপ্রেসের নতুন ট্রেন ছুটবে যে পথে…

জানেন এই বিশেষ ক্যাবল স্টেড ব্রিজ কীভাবে কাজ করে?

হাউ স্টাফ ওয়ার্কস-এর একটি প্রতিবেদন অনুসারে বল হয়, প্রাথমিক ভাবে ঝুলন্ত লেনের কারণে কেবল-স্টেড সেতুটিকে ঝুলন্ত সেতুর একটি বৈচিত্র বলে মনে হয়। কেবল-স্টেড সেতুগুলি ঝুলন্ত সেতুগুলির থেকে আলাদা কারণ এগুলিতে অ্যাঙ্কোরেজ বা দুটি টাওয়ারের প্রয়োজন হয় না। পরিবর্তে, তারগুলি রাস্তা থেকে একটি একক টাওয়ার পর্যন্ত প্রসারিত হয়, যা পুরো ওজন বহন করে।

একটি কেবল-স্টেড সেতুর টাওয়ার কম্প্রেশনাল স্ট্রেস শোষণ এবং মোকাবিলা করতে পরে। বিভিন্ন পদ্ধতিতে পাকদন্ডি রাস্তার সাথে একটি রেডিয়াল বিন্যাসে তারগুলো লাগানো হয়। উদাহরণস্বরূপ, একটি একক খুঁটির সাথে সংযুক্ত একাধিক মাছ ধরার লাইনের মতো তারগুলি রাস্তার বিভিন্ন স্থান থেকে টাওয়ারের একক পয়েন্টে পৌঁছায়। তারগুলি সমান্তরাল কনফিগারেশনে বিভিন্ন পয়েন্টে রাস্তা এবং টাওয়ারের সাথে সংযোগ স্থাপন করে। প্রকৌশলীরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপে প্রথম কেবল-স্টেড ব্রিজ তৈরি করেছিলেন, কিন্তু তার অন্তর্নিহিত নকশাটি ১৬ শতকের এবং ক্রোয়েশিয়ান উদ্ভাবক ফাউস্ট ভ্রাঙ্কিকের। ভ্রাঙ্কিক ছিলেন একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী। তাঁর বই ‘ম্যাচিনি নোভা’-তে প্রথম একটি কেবল-স্টেড ব্রিজের স্কেচ লক্ষ্য করা যায়।

আজকাল অবশ্য এই ক্যাবল-স্টেড ব্রিজ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কারণ ৫০০ থেকে ২৮০০ ফুট পর্যন্ত এই দীর্ঘ স্প্যানগুলির মধ্যে কম খরচে একটি ঝুলন্ত সেতুর সমস্ত সুবিধা প্রদান করে এটি৷ এতে ইস্পাতের ব্যবহারও কম, তাছাড়া খুবই তাড়াতাড়ি এর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব। প্রচুর পরিমাণে ইস্পাত এবং কংক্রিটের পরিবর্তে এক্ষেত্রে একটি বা দুটি গাছের শিকড়ই যথেষ্ট বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। ফলে দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় এর মতো বিকল্প আর কীই বা হতে পারে!

 

More Articles