ভারতের নিজস্ব মেসেজিং অ্যাপ: হোয়াটস অ্যাপকে টেক্কা দিতে পারবে আরাত্তাই?
Arattai App: চেন্নাইয়ের সংস্থা জোহো লঞ্চ করেছে ভারতের নিজস্ব ম্যাসেজিং অ্যাপ আরাত্তাই (Arattai)। ইতোমধ্যেই তা যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়েছে। শ্রীধর ভেম্বুর মস্তিষ্ক প্রসূত এই অ্যাপলিকেশন।
মার্কিন ম্যাসেজিং অ্যাপ ছেড়ে কি ভারতীয় ম্যাসেজিং অ্যাপে মজবে ভারতবাসী? দিনশেষে জাতীয়তাবাদে সুড়সুড়ি দেওয়ার প্রবণতা যতই লক্ষ্য করা যাক, আরাত্তাই (Arattai) কিন্তু তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো কাজ করেছে। সে এমন একটি ম্যাসেজিং প্ল্যাটফর্ম বানিয়েছে যা প্রায় হোয়াটস অ্যাপের সমতুল্য। শুধু তাই নয়, তাঁদের দাবি ডেটাও নাকি সম্পূর্ণ সুরক্ষিত। তবে আজকাল অনেকেই মনে করেন ডেটা সুরক্ষার বিষয়টা আদতে সোনার পাথর বাটি। অলীক কল্পনার মতো ডেটা সুরক্ষা বলে কিছু হয় না। তবুও অশান্ত মনকে শান্ত করার মতো আমরাও বলি ডেটা সুরক্ষিত আছে। তবে এই রাজনৈতিক উত্তাল সময়ে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভ্রান্ত নীতির মাহেন্দ্রক্ষণে এই মেসেজিং অ্যাপ কি ভারতবাসীর মন জয় করতে পারবে? দিনশেষে জাতীয়তাবাদের সুড়সুড়ি দিয়ে কি হোয়াটসঅ্যাপ-কে দশ গোল দিতে পারবে? হোয়াটসঅ্যাপ গোপনীয়তা নীতি বিতর্কের সময় আরাত্তাই অ্যাপটির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। হাজার হাজার ভারতীয় ব্যবহারকারী এটিকে একটি নিরাপদ ভারতীয় বিকল্প হিসেবে ডাউনলোডও করেছেন।
চেন্নাইয়ের সংস্থা জোহো লঞ্চ করেছে ভারতের নিজস্ব ম্যাসেজিং অ্যাপ আরাত্তাই (Arattai)। ইতোমধ্যেই তা যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়েছে। শ্রীধর ভেম্বুর মস্তিষ্ক প্রসূত এই অ্যাপলিকেশন। শ্রীধর ভেম্বুর ইতিহাস জানলে চমকে উঠতে হয়। শ্রীধর ভেম্বু প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি সফল কেরিয়ার গড়ে তোলেন। তবে, তিনি কর্পোরেট জগতের ঐতিহ্যবাহী সাফল্য ছেড়ে ভারতে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর সবচেয়ে অনন্য উদ্যোগগুলির মধ্যে একটি হলো তামিলনাড়ুর টেনকাসির একটি ছোট গ্রামে তাঁর কোম্পানি, জোহোর সদর দফতর এবং কার্যক্রম প্রতিষ্ঠা করা। তিনি বিশ্বাস করেন যে প্রতিভা কেবল বড়ো শহরগুলিতে সীমাবদ্ধ নয় এবং গ্রামীণ এলাকায়ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা উচিত। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চাকরি ছেড়ে ভারতের একটি গ্রামে একটি বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন, যা আজ বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ গ্রাহকদের সেবা করে। ভারতীয় ব্যবসা এবং শিল্পে তাঁর অপরিসীম অবদানের জন্য, ভারত সরকার তাঁকে ২০২১ সালে দেশের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান পদ্মশ্রী দিয়ে সম্মানিত করে। শ্রীধর ভেম্বুর এই পদক্ষেপ 'মেক ইন ইন্ডিয়া' এবং 'আত্মনির্ভর ভারত'-এর মতো উদ্যোগের একটি উজ্জ্বল উদাহরণ, যা দেখায় যে কীভাবে একজন ভারতীয় উদ্যোক্তা বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতার মধ্যে দেশে অবস্থান করে একটি সফল এবং জনপ্রিয় পণ্য তৈরি করেছেন।
আরও পড়ুন
প্রযুক্তির দুনিয়ায় নয়া বিপ্লবের নাম অ্যাজেন্টিক AI, জানেন কী কী করতে পারে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা?
ভারতে হোয়াটস অ্যাপের বিপুল জনপ্রিয়তার মাঝেই আত্মপ্রকাশ করেছে আরাত্তাই। নামের অর্থই আড্ডা, যা অনেকটা দেশীয় ঘরোয়া মেজাজ তৈরি করে। কিন্তু এই অ্যাপ আর হোয়াটস অ্যাপের মধ্যে বেশ কিছু মৌলিক পার্থক্য আছে। প্রথমত, নিরাপত্তার প্রশ্নে। হোয়াটস অ্যাপ অনেকদিন ধরেই সমস্ত বার্তার ক্ষেত্রে এন্ড টু এন্ড সাবস্ক্রিপশন (end-to-end encryption) চালু করেছে। ফলে ব্যবহারকারীর কথোপকথন তৃতীয় কারও পক্ষে পড়া সম্ভব নয়। আরাত্তাই বর্তমানে এই সুবিধা কেবল ভয়েস ও ভিডিও কলের ক্ষেত্রে দিচ্ছে। জোহো সংস্থা জানিয়েছে, চ্যাট বার্তার জন্য ভবিষ্যতে পূর্ণ নিরাপত্তা যুক্ত হবে, তবে এখনও তা হয়নি। তাই এই মুহূর্তে নিরাপত্তায় হোয়াটস অ্যাপ কিছুটা এগিয়ে। এরপরেই আসে ডেটা ব্যবহার ও বিজ্ঞাপন নীতি। হোয়াটস অ্যাপ যেহেতু মেটার মালিকানাধীন, তাই ব্যবহারকারীর ডেটা তাদের বিজ্ঞাপনভিত্তিক ব্যবসায় কাজে লাগে। আরাত্তাই স্পষ্ট জানিয়েছে, এতে কোনো বিজ্ঞাপন থাকবে না এবং সমস্ত ডেটা ভারতের ভেতরেই সংরক্ষিত হবে।
জোহো বরাবরই প্রাইভেসি রক্ষার কথা বলে এসেছে, আর সেটাই আরাত্তাই-র বড় শক্তি। ফিচারের দিক থেকে দু'টি অ্যাপই প্রায় কাছাকাছি। দু'টোতেই গ্রুপ চ্যাট, ভয়েস ও ভিডিও কল, ছবি বা ভিডিও পাঠানোর সুবিধা আছে। তবে আরাত্তাই কিছু অভিনবত্ব দেখিয়েছে যেমন অ্যানড্রয়েড টিভির-এর জন্য সরাসরি অ্যাপ, যা হোয়াটস অ্যাপ এখনও দিতে পারেনি। তবে সামগ্রিক ফিচারের দিক থেকে হোয়াটস অ্যাপ অনেক বেশি সমৃদ্ধ, কারণ এতে স্ট্যাটাস, চ্যানেল বা ব্যবসায়িক ব্যবহারযোগ্য নানা সুবিধা যুক্ত হয়েছে। ব্যবহারকারীর সংখ্যায় বিরাট ফারাক। ভারতে হোয়াটস অ্যাপের ব্যবহারকারী ৪০০ মিলিয়নের বেশি। আরাত্তা তুলনায় একেবারেই নতুন। যদিও লঞ্চের পর প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ডাউনলোড করছে, কিন্তু হোয়াটস অ্যাপের সমান জনপ্রিয়তা পেতে এখনও অনেক পথ বাকি। হোয়াটস অ্যাপের বছরের পর বছর ধরে বিশাল সার্ভার ও অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। আরাত্তাতে এখনও ওটিপি বিলম্ব, মেসেজ সিঙ্কের সমস্যা, কিংবা কলের গ্লিচ নিয়ে অভিযোগ আছে। জোহো জানিয়েছে, আরও উন্নত করার চেষ্টা চলছে।
হঠাৎ করে আরাত্তাই জনপ্রিয় হওয়ার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। সম্প্রতি হোয়াটস অ্যাপের গোপনীয়তার নীতি নিয়ে বিতর্ক শুরু হওয়ার পর ব্যবহারকারীরা নিরাপদ বিকল্প খুঁজতে শুরু করেন, আর এই সময়েই আরাত্তাই এল বিকল্প হিসেবে। এছাড়া, দেশে বিদেশি অ্যাপের পরিবর্তে দেশীয় প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করার প্রবণতা বা জাতীয়তাবাদী অনুভূতিও জনপ্রিয়তাকে বাড়িয়েছে। আরাত্তাই ব্যবহারকারীর প্রাইভেসি এবং ডেটা ভারতের মধ্যে সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, পাশাপাশি বিজ্ঞাপনও নেই যা অনেকের কাছে আকর্ষণীয়। এই নতুনত্বের সঙ্গে জোড়া লেগেছে শ্রীধর ভেম্বুরের প্রখ্যাত উদ্যোক্তা পরিচয় বিদেশি ক্যারিয়ার ত্যাগ করে দেশে ফিরে গ্রামীণ এলাকায় কর্মসংস্থান ও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান গড়ার গল্প ব্যবহারকারীদের আস্থা ও আগ্রহ তৈরি করেছে। মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনার ঢেউও ডাউনলোড বাড়াতে ভূমিকা রেখেছে। এই সব কারণে হঠাৎই আরাত্তাইয়ের জনপ্রিয়তা বেড়ে গেছে।
আরও পড়ুন
কোনও প্রযুক্তি নয়, এক রাজার নামেই নামকরণ! অবাক করবে ‘ব্লুটুথ’-এর ইতিহাস
হঠাৎ আরাত্তাই জনপ্রিয় হওয়ার কারণ শুধু প্রযুক্তি বা প্রাইভেসির নয়, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সাম্প্রতিক সময়ে হোয়াটস অ্যাপ এবং অন্যান্য বিদেশি প্ল্যাটফর্মকে ঘিরে গোপনীয়তা, ডেটা শেয়ারিং এবং বিদেশি প্রভাব নিয়ে বিতর্কের ঢেউ ভারতীয় রাজনৈতিক মহলে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। জাতীয়তাবাদী অনুভূতি এবং দেশীয়করণের প্রসার রাজনৈতিকভাবে উস্কানি দিয়েছে, যার ফলে ভারতীয় ব্যবহারকারীরা দেশীয় বিকল্পগুলোকে সমর্থন করতে উৎসাহিত হয়েছেন। কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য স্তরের প্রচারাভিযান, মেক ইন ইন্ডিয়া ও আত্মনির্ভর ভারত উদ্যোগের আলোচনাও এমন প্রযুক্তি উদ্যোগের দিকে মনোযোগ বাড়িয়েছে। ফলে আরাত্তাই শুধু একটি প্রযুক্তি অ্যাপ হিসেবে নয়, একটি রাজনৈতিক ও জাতীয়তাবাদী প্রতীক হিসেবেও ধরা হচ্ছে, যা হঠাৎ জনপ্রিয়তার মূল কারণগুলোর সঙ্গে যুক্ত। গত কয়েক দিনে আরাত্তাই অ্যাপের জনপ্রিয়তা চোখে পড়ার মতো বেড়েছে; নতুন ব্যবহারকারীর সংখ্যা মাত্র তিন দিনের মধ্যে দৈনিক ৩,০০০ থেকে হঠাৎ করে ৩,৫০,০০০-এ পৌঁছেছে। জোহো কর্পোরেশনের প্রধান বিজ্ঞানী শ্রীধর ভেম্বু জানিয়েছেন, নভেম্বরে একটি বড়ো আপডেটের পরিকল্পনা রয়েছে, এতে নতুন ফিচার, বিপণন প্রচারাভিযান অন্তর্ভুক্ত থাকবে। অ্যাপটিতে বর্তমানে উন্নয়নাধীন, নতুন ফিচার যোগের পাশাপাশি কোডের ত্রুটি সংশোধন করা হচ্ছে। শ্রীধর ভেম্বু বলেন, 'আমরা আরাত্তাইয়ের জন্য অনেক কিছু পরিকল্পনা করেছি, দয়া করে আমাদের কিছু সময় দিন। ধন্যবাদ এবং সমর্থনের জন্য ধন্যবাদ! জয় হিন্দ।'
আরাত্তাই অ্যাপের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে রাজনৈতিক নেতাদের সমর্থনও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং রাজ্যস্তরের বিজেপি নেতারা প্রকাশ্যে এটিকে সমর্থন জানিয়েছেন এবং ভারতীয় ব্যবহারকারীদের দেশীয় প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করার আহ্বান জানিয়েছেন। এই সমর্থন ও প্রচার অ্যাপটির গ্রহণযোগ্যতা ও ডাউনলোড বাড়াতে সাহায্য করেছে। আগের দেশের মেসেজিং অ্যাপগুলো— যেমন বটিম, হাইমেসেজ, এবং চ্যাটইন্ডিয়া— ভারতের বাজারে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব রাখতে পারেনি। প্রযুক্তিগত দিক থেকে এগুলো হোয়াটস অ্যাপের মতো শক্তিশালী সার্ভার এবং নির্ভরযোগ্যতা দিতে পারেনি, যার কারণে বার্তা বিলম্ব, কলের গ্লিচ এবং লগইন সমস্যা স্বাভাবিক ছিল। ফিচারের দিক থেকেও এই অ্যাপগুলো গ্রুপ চ্যাট, ভিডিও কল, স্ট্যাটাস বা ব্যবসায়িক ব্যবহারের মতো বৈশিষ্ট্যে হোয়াটস অ্যাপের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেনি। এছাড়া ব্যবহারকারীর সংখ্যা কম থাকায় নেটওয়ার্ক ইফেক্ট তৈরি হয়নি— যেখানে মানুষ বেশি ব্যবহারকারী আছে, সেই প্ল্যাটফর্মই বেছে নেয়। এর ফলে, পর্যাপ্ত মিডিয়া কভারেজ বা রাজনৈতিক সমর্থনও মেলেনি, যা ব্র্যান্ড আস্থা গড়ার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করেছে। এই সব কারণে দেশের আগের মেসেজিং অ্যাপগুলো বাজারে টিকে থাকতে ব্যর্থ হয়েছে। এবার দেখার আরাত্তাই মার্কিন ম্যাসেজিং অ্যাপকে টেক্কা দিতে পারে কিনা?
Whatsapp
