আর কত গুলিগোলা! AI দিয়ে সীমান্তে জঙ্গি কার্যকলাপ আটকানো সম্ভব ভারতে?
AI Border Security: ইজরায়েলের মতো দেশের সীমান্ত কম্পিউটারাইজড থার্মাল ইমেজিং সিস্টেম সম্বলিত নিরাপত্তা বলয়ে মোড়া। কোনও প্রাণী, মানুষ বা যানবাহন সীমান্ত টপকালেই সে খবর তাদের কাছে পৌঁছয়।
পরামাণু শক্তিধর দুই দেশের মধ্যে 'যুদ্ধ বিরতি’ চলছে। ‘বিরতি’ শব্দের মধ্যেই একটা শঙ্কা লুকিয়ে থাকে, বিরতি মানেই এই বুঝি তা শেষ হয়ে গেল! বিরতি কতদিন স্থায়ী হবে, বিরতি পরবর্তী পদক্ষেপ কী এই সমস্ত প্রশ্ন এক দিকে, আর ঠিক অন্যপিঠে রয়েছে পহেলগাঁওয়ের নারকীয় ঘটনা। যে স্বাভাবিক প্রশ্ন উঠে এসেছিল তা হলো, কাশ্মীরের মতো সেনা অধ্যুষিত জায়গায় কী করে হাজার দুয়েক পর্যটকদের কোনও নিরাপত্তা রক্ষী ছাড়াই রাখা হয়েছিল? কাশ্মীরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা শুধুই কি সেনা নির্ভর? এই প্রযুক্তিবিশ্বে সবুজ ঘাসের গালিচায় বুটের ভারী আওয়াজ ছাড়াও কি নিরাপত্তা বজায় রাখা সম্ভব?
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে, বুটের সংখ্যার চেয়ে প্রযুক্তি বড়— একথা তুমুল তার্কিকও মানবেন। এই সময়ে দাঁড়িয়ে পহেলগাঁওয়ের ঘটনা শুধু নারকীয় সন্ত্রাসই নয়, আমাদের বুদ্ধিমত্তার গোড়ায় করাঘাতও। দেশের সুরক্ষা নীতির পরিভাষায় যেটি ইন্টেলিজেন্স ফেলিওর নামে বহুল পরিচিত। বিশ্বের তাবড় তাবড় শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো ইতিমধ্যেই এআই ভিত্তিক জাতীয় সুরক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়ন করে ফেলেছে, সেখানে ভারত কেন এই নিয়ে পদক্ষেপ করছে না? ভারতের মতো জনবহুল দেশের চারিদিকে প্রায় পনেরো হাজার কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। এআই নির্ভর জাতীয় সুরক্ষা ব্যবস্থা এখন আর বিলাসিতা নয়, সময়ের দাবি । ভারত কেন যে কোনও সীমান্তবর্তী আঘাতের আগাম খবর দিতে পারছে না এখনও?
জম্মু-কাশ্মীরের মতো অশান্ত জায়গায়, বা দেশের অন্য সীমান্ত অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলার জন্য ভারতের তিন কেন্দ্রীয় সংস্থা RAW, IB, ও NIA হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করে । কিন্তু আমলাতান্ত্রিক, প্রোটোকল নির্ভর এই ব্যবস্থা জঙ্গিহানার পরে পরিস্থিতি সামাল দিতে কার্যকরী হলেও সম্ভাব্য জঙ্গি হানার খবর দিতে প্রায় ব্যর্থই। মানুষ নির্ভর এই ব্যবস্থায় আক্রমণের আগে কেন খবর পাওয়া যাচ্ছে না বা হামলা হওয়ার আগেই আটকানো গেল না কেন- এই জাতীয় প্রশ্ন তাই বড্ড বেসুরো।
আরও পড়ুন- পুলিশের নজর এড়িয়েই বৈসরনে পর্যটকরা! নিরাপত্তার যে যে গাফিলতি স্বীকার কেন্দ্রের
গত কয়েক বছরে কাশ্মীরের পরিকাঠামো উন্নয়নে ও পর্যটনে প্রশাসন এত গুরুত্ব দিয়েছে যে লোকালয়ে বা যে সমস্ত দর্শনীয় স্থানগুলির যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত, সেখানে সর্বক্ষণের নজরদারির ব্যবস্থা রয়েছে। সেই দিক থেকে বৈসরন উপত্যকা ব্যতিক্রম, কারণ সেখানে ঘোড়া ও পায়ে হেঁটে ছাড়া যাওয়ার উপায় নেই। এই তথ্য সন্ত্রাসবাদীরা তথা গোটা দুনিয়া জানত।
ইজরায়েলের মতো দেশে নজরদারির জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার হচ্ছে অনেক দিন ধরেই। তাদের গোয়েন্দা সংস্থা এআই ব্যবহার করে ফোনের মেটাডেটা, সোশ্যাল মিডিয়ায় আদানপ্রদান হওয়া বিভিন্ন মেসেজ, স্যাটেলাইট ভিত্তিক বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে সম্ভাব্য হুমকির হদিশ পাচ্ছে। পাশাপাশি প্রতিরক্ষা দফতরের প্রত্যক্ষ নজরদারি তো আছেই। তাদের সীমান্ত কম্পিউটারাইজড থার্মাল ইমেজিং সিস্টেম সম্বলিত নিরাপত্তা বলয়ে মোড়া। কোনও প্রাণী, মানুষ বা যানবাহন সীমান্ত টপকালেই সে খবর তাদের কাছে পৌঁছয়।
অপরদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শঙ্কাপ্রবণ এলাকায় প্রতি মুহূর্তে ড্রোনের নজরদারি চালায় এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেই ছবি এআই-এর সাহায্যে বিশ্লেষণ করে। সেখানে কোনও সম্ভাব্য আশঙ্কার হদিশ পেলে সেই এলাকাকে আরও জুম করে বিশ্লেষণ করে প্রতিরক্ষা বিভাগের নজরে আনে। সেই সঙ্গে আমেরিকার ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি (NSA) ও ডিপার্টমেন্টাল হোমল্যান্ড সিকিউরিটির (DHA) সর্বক্ষণের বিভাগীয় তদন্ত তো আছেই।
এআই কীভাবে আমাদের দেশের নিরাপত্তা, বিশেষ করে সীমান্ত নজরদারি ব্যবস্থা উন্নত করতে সাহায্য করতে পারে?
আরও পড়ুন- কীভাবে গাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধে AI ব্যবহার করল ইজরায়েল?
সমাধান খোঁজার আগে, একবার দেখে নেওয়া যাক কী কী সম্পদ আছে ভারতের? রয়েছে অগণিত দক্ষ ইঞ্জিনিয়র, ডেটা সায়েন্টিস্ট। পাশ্চাত্যের তথ্য প্রযুক্তি কাজের জন্য উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ইঞ্জিনিয়র ভারত সরবরাহ করে। ডিআরডিও-র নিজস্ব ল্যাবরেটরি ছাড়াও রয়েছে অজস্র তথ্যপ্রযুক্তি স্টার্টআপ। এসব প্রযুক্তিগত সুবিধা নিয়ে ভারত যা করতে পারে—
প্রথমত, এআই সহযোগে স্পর্শকাতর এলাকায় অহেতুক লোকজনের আনাগোনা, কোনও বিশেষ জায়গায় মানুষের সারাক্ষণের অনলাইন অ্যাক্টিভিটি, অরণ্য এলাকায় হঠাৎ মানুষের উপস্থিতি, এসব তথ্যের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ প্রয়োজন। যদি কোনও গণ্ডগোল ধরা পড়ে, তা তৎক্ষণাৎ নজরে আনা।
দ্বিতীয়ত, বৈসরনের মতো লোকালয় থেকে বিচ্ছিন্ন এলাকায় রীতিমতো অত্যাধুনিক ড্রোনের সাহায্যে নজরদারি চালানো উচিত, যাতে কোনও গুলির আওয়াজ, একাধিক লোকের উদ্দেশ্যহীনভাবে বিচরণ বা কোনও অসামঞ্জস্য নজরে পড়ে।
তৃতীয়ত, এআই-এর ফেসিয়াল রিকগনিশন ব্যবস্থার ব্যবহার। আমাদের মুখমণ্ডলে অনেকগুলো নোডাল পয়েন্ট রয়েছে, যেমন গ্লাবেলা, গ্যানাথিয়ন, ম্যান্ডিবল ইত্যাদি। বয়সের ভারে বা খাদ্যাভ্যাসজনিত কারণে যদি চেহারায় কোনও হেরফের হয়, তাও এদের অবস্থান বা দু'টি নোডাল পয়েন্টের মধ্যে দূরত্বের বিশেষ তারতম্য হয় না। উন্নত বিশ্ব দাগী আসামিদের ধরার ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে। বিভিন্ন ব্যস্ত জায়গার (বাস স্ট্যান্ড, রেল স্টেশন, হসপিটাল ইত্যাদি) সিসিটিভি ফুটেজ পরীক্ষা করে দেখা উচিত কোনও সন্দেহভাজন ব্যক্তির দেখা পাওয়া যাচ্ছে কিনা। সীমান্তবর্তী এলাকার সমস্ত উৎস থেকে পাওয়া তথ্য সন্দেহজনক ব্যক্তির তথ্যভাণ্ডার আরও সমৃদ্ধ করবে।
চতুর্থত, ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে সোশ্যাল মিডিয়ার বিভিন্ন কন্টেন্ট ও ডার্ক ওয়েব পর্যবেক্ষণ করা উচিত।
পাশাপাশি, আমাদের সীমান্তগুলোতে থার্মাল ইমেজিং সিস্টেম চালু করা দরকার, যাতে কোনও হুমকি এলেই, তা সেন্ট্রাল সার্ভার সিস্টেমে সংকেত পাঠাতে পারে।
এই সমস্ত কাজ একসঙ্গে না হলেও আমাদের যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোয় বিভিন্ন কেন্দ্রীয় সংস্থা, রাজ্য পুলিশ, বিএসএফ, আর্মি, ন্যাশনাল ক্রাইম ব্যুরো, সব তথ্য একত্রিত করে একটা ডেটা ক্লাউড তৈরি করা যেতে পারে, যেটা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ব্যবহার করা যাবে। এই একবিংশ শতাব্দীতে গুলি-বন্দুক দিয়ে সন্ত্রাস নির্মূল করা সম্ভব নয়, দরকার উন্নতমানের অ্যালগরিদম আবিষ্কার করা। হামলার পরে তা কাটাছেঁড়া করার চেয়ে দেশের সীমান্তবর্তী নিরাপত্তা ব্যবস্থা এতটাই নিশ্ছিদ্র করা উচিত যে কোনও সন্ত্রাসী হামলার চক্রান্ত শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই যেন সেনার কাছে খবর চলে আসে। আরও পুলওয়ামা বা বৈসরন যেন না দেখতে হয় দেশবাসীকে।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত। মতামতের দায় ইনস্ক্রিপ্টের নয়