স্পেস স্টেশনে খুন! কীভাবে কিনারা করবে ফরেন্সিক?
Murder in Space: মাধ্যাকর্ষণের অভাবে রক্তের কণাগুলো উড়ানের গা বেয়ে নীচের দিকে নামতে পারে না, পরিবর্তে পৃষ্ঠটান রক্তের ফোঁটাগুলির আকৃতি, আকার ধরে রাখে।
গত শতাব্দীতে পৃথিবীর তাবড় শক্তিদের মাঝে রেষারেষি ছিল— মহাকাশে কে প্রথম নভোযান পাঠাবে? প্রথম সফল চন্দ্রাভিযানের শিরোপা কার ঝুলিতে থাকবে? অথবা প্রথম কোন দেশের মানুষ বা কোন প্রাণী সফল নভোযাত্রার অংশ হবে? সময় সারণী বেয়ে সেই লড়াইয়ে অংশ নিয়েছেন এলন মাস্কের মতো ধনকুবেররা— পৃথিবীব্যাপী ব্যবসার কিয়দাংশ যদি মহাকাশে ছড়িয়ে দেওয়া যায়— যদি সেখানে একটি কলোনি গড়ে তোলা যায়! শক্তিশালী রাষ্ট্রের সঙ্গে এখন শিল্পপতিরা সামিল হয়েছেন এই দক্ষ যজ্ঞে। সেজন্য অনেক স্পেস স্টেশন তৈরি করা দরকার মহাশূন্যে, যেখান থেকে এইসব নভোযান চালনা করা সম্ভব। এই সব নভোস্টেশনে পৃথিবীর বাছাই করা বুদ্ধিমান ও সাহসী মানুষরা থাকবেন কাজের প্রয়োজনে। ক্ষেত্রবিশেষ তাঁদের এই নভোবাস কয়েক মাস পর্যন্ত দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে, সে দৃষ্টান্ত এখান আর বিরল নয়। সদ্য সুনীতা উইলিয়ামসরা ধরাধামে ফিরেছেন অনাকাঙ্খিত দীর্ঘ মহাকাশ সফরের পর।
ছোট্ট একটি কেবিনে কয়েক মাস ধরে দু'জন বন্দি থাকলে যেকোনও মন কষাকষি থেকে আরম্ভ করে নানা ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হতেই পারে। বাছাই করা প্রতিভাবান কয়েকজন মানুষও কি নিজেদের মধ্যে ঝামেলা করবেন, তাও মহাকাশযানের ভিতরে আটক থাকা অবস্থায়? হ্যাঁ, পরিস্থিতি তেমন হলে একজন অন্যকে খুনও করতে পারেন। ১৯৮০ সালে রাশিয়ান মহাকাশচারী ভ্যালেরি রিউমিন মহাকাশে আটকে থাকা অবস্থায় তাঁর ব্যক্তিগত ডায়েরিতে লিখেছিলেন— "একটা ৫মিটার X ৬মিটার সাইজের কেবিনে দু'জন মানুষকে মাস দুয়েক বন্দি করে রাখলে খুন হওয়ার সবরকম পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।” যদি তেমন কোনও অঘটন ঘটে যায়, প্রশাসনের পরের কাজ হলো খুন কীভাবে হলো, তার অনুসন্ধান। কারণ দু'জন মহাকাশচারী থাকলে কে খুনি, সেটা সহজেই অনুমেয়। প্রথম প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে দরকার ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞের। তাঁরা প্লেস অফ অকারেন্স বা অকুস্থল পরিদর্শন করবেন। পৃথিবীর সমস্ত দেশে খুনের ঘটনায় যেরকম হয় আর কী। কিন্তু এখানে একটা গণ্ডগোল আছে, অকুস্থল হচ্ছে মহাশূন্যে থাকা স্পেস স্টেশন, যেখানকার গ্র্যাভিটি বা মহাকর্ষ প্রায় শূন্য বলে চলে। এই রকম অতি ক্ষীণ মহাকর্ষে বা মাইক্রো গ্র্যাভিটিতে প্রচলিত ফরেন্সিকের কাজকর্ম করা একরকম অসম্ভব। এইরকম পরিস্থিতিতে কী করে বিচার সহায়ক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে অপরাধের কিনারা করা যায়, তার জন্য সদ্য তৈরি হয়েছে ফরেন্সিক বিজ্ঞানের এক নতুন বিভাগ— অ্যাস্ট্রো ফরেন্সিকস।
আরও পড়ুন- চাঁদে বা মহাকাশে কীভাবে অন্তর্বাস কাচেন মহাকাশচারীরা? অবাক করবে যে তথ্য
আসলে ধারালো বা ভোঁতা অস্ত্র ব্যবহার করে খুনের ঘটনার কিনারা করতে আহত বা নিহতদের শরীর থেকে রক্ত ছড়িয়ে পড়ার প্যাটার্ন (blood spatter pattern) বিশ্লেষণ খুবই কার্যকরী ভূমিকা রাখে। পদার্থবিদ্যা, বিশেষ করে ফ্লুইড ডাইনামিক্সের মতো কঠিন অঙ্ক ব্যবহার করে এক্ষেত্রে রক্তের ফোঁটার সম্ভাব্য গতিপথ নির্ধারণ করা হয়। এক্ষেত্রে আহত বা নিহত ব্যক্তির শরীর থেকে কী কোণে রক্ত পার্শ্ববর্তী দেওয়ালে ধাক্কা খাচ্ছে, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফরেন্সিকের পরিভাষায় এটি অ্যাঙ্গেল অফ ইমপ্যাক্ট নামে পরিচিত। সাধারণত রক্তের দাগের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের অনুপাতের সাহায্যে এই কোণ (θ) পরিমাপ করা হয়। গাণিতিকভাবে লিখলে লেখা যায়, θ = sin⁻¹ ( প্রস্থ/ দৈর্ঘ্য)।
ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞেরা কীভাবে রক্তের দাগকে (blood stain) ব্যাখ্যা করেন তা বোঝার জন্য প্রথমে আমাদের রক্তের মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলি বুঝতে হবে। রক্তে তরল (প্লাজমা এবং সিরাম) এবং কঠিন (লোহিত রক্তকণিকা, শ্বেত রক্তকণিকা, প্লেটলেট এবং প্রোটিন) উভয়ই বিদ্যমান। যতক্ষণ শরীরের ভেতরে থাকে, ততক্ষণ এটি তরল এবং যখন এটি শরীর থেকে বেরিয়ে যায়, তখন এটি ধীরে ধীরে জমাট বাঁধতে শুরু করে; কয়েক মিনিটের মধ্যে এটি গাঢ়, চকচকে জেলের মতো পদার্থে রূপান্তরিত হয়, আরও সময় গড়ালে কঠিন হয়ে যায়। হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রে ব্যাপার আলাদা। রক্তের দাগের মধ্যে রক্ত জমাট বাঁধার চিহ্ন পাওয়ার মানে হচ্ছে যে, আক্রমণটি দীর্ঘ সময় ধরে চলেছিল বা আহত হওয়ার পরে কিছু সময়ের জন্য রক্তক্ষরণ হচ্ছিল।

আঘাতের ধরনের ওপর নির্ভর করে রক্ত বিভিন্নভাবে শরীর থেকে বেরিয়ে যেতে পারে। এটি ক্ষতস্থান থেকে প্রবাহিত হতে পারে, ফোঁটা ফোঁটা করে বেরোতে পারে, স্প্রের মতো ছিটকে বেরোতে পারে, অথবা ক্ষতস্থান থেকে চুঁয়ে চুঁয়েও বেরোতে পারে।
ক্ষতস্থান থেকে রক্ত বেরোনোর সময়, রক্তের ফোঁটাগুলি বাতাসের ভিতর দিয়ে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। সেসময় ফোঁটাগুলি যখন কোনও পৃষ্ঠে আঘাত করে, তখন রক্তের ফোঁটাগুলির বেগ, পার্শ্ববর্তী দেওয়ালে কী কোণে রক্ত ধাক্কা খেয়েছে, বায়ু মাধ্যমে সেটি কতটা দূরত্ব অতিক্রম করল— এসবের ওপর নির্ভর করে রক্তের দাগের আকার পরিবর্তিত হয়। সাধারণত, এই দাগ বৃত্তাকার বা উপবৃত্তাকার হতে পারে। দাগের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ পরিমাপ করে, রক্তের ফোঁটা কত কোণে ছিটকাবে তার একটা ধারণা বিশেষজ্ঞরা পেতে পারেন। যেমন, ৯০° কোণে একটি মসৃণ পৃষ্ঠে আঘাত করা একটি রক্তের ফোঁটার জন্য বৃত্তাকার দাগ দেখা যায়। কোণের মান কমতে থাকলে রক্তের দাগটি দু'পাশে আরও বিস্তৃত হয়ে উপবৃত্তাকার আকার ধারণ করে। খুব কম কোণে একটি দাগের ভিতরে দ্বিতীয় একটি দাগ তৈরি হতে পারে। এই সমস্ত বিশ্লেষণ পৃথিবীতে বসেই করেছেন বিশেষজ্ঞরা; এসবের পেছনে মহাকর্ষের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু মহাশূন্যে তো আর মহাকর্ষ নেই!
মাইক্রো গ্র্যাভিটিতে রক্তের দাগের চেহারা কেমন হতে পারে, সেজন্য কোয়ালসকে ও প্যান্টালস সম্মিলিতভাবে ল্যুইভিল বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গবেষণা করেন। তাঁরা ভমিট কমেট নামক একটি পরাবৃত্তাকার উড়ান (parabolic flight) ব্যবহার করেন, যেখানে স্বল্প সময়ের জন্য ভারহীনতার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। অবাধে পতনের সময় প্যান্টালস একটি সিরিঞ্জে করে কৃত্রিম রক্ত কাগজের টুকরোর উপর স্প্রে করেন। তিনি দেখেন মহাকর্ষের অনুপস্থিতিতে রক্তের ফোঁটাগুলো ছড়িয়ে পড়তে পারছে না, অর্থাৎ যেই মহাকর্ষ দুর্বল হয়ে পড়েছে, অমনি পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে পৃষ্ঠটান। ফলে রক্তের দাগ খুবই কম, যেটা দেখে অনুমান করা কঠিন যে মহাকাশচারীকে কোপানো হয়েছে নাকি অন্য কিছু।

মাইক্রো গ্রাভিটিতে রক্তের দাগ সৃষ্টি, কৃতজ্ঞতা: https://doi.org/10.1016/j.fsir.2024.100358
শুনতে সোজা লাগলেও পরাবৃত্তাকার উড়ানের ছোট্ট ইনকিউবেশন চেম্বারে (গ্লোভ বক্স) এই গবেষণা করা রীতিমতো কঠিন, কারণ প্রথমত, খুব স্বল্প সময়ে (১৫-২০ সেকেন্ড) এয়ারক্রাফ্টের ভিতরে মাইক্রো গ্র্যাভিটি অবস্থা বজায় থাকে। দ্বিতীয়ত, উড়ানটি পৃথিবীতে ফেরত আসার সময়, মাইক্রোগ্রাভিটি থেকে বেরিয়ে শক্তিশালী মহাকর্ষের টানে পড়ে। সেসময় সেই স্বল্প দাগ প্রায় নষ্ট হয়ে যায়। আর তাছাড়া ছোট্ট জায়গায় এই পরীক্ষা করার ফলে কাগজের টুকরোর ২০ সেন্টিমিটার জায়গা জুড়ে কোয়ালসকদের এই পরীক্ষাটি করতে হয়।
আরও পড়ুন- মহাকাশে কীসের হৃদস্পন্দন? কোন রহস্যের সন্ধান পেলেন বিজ্ঞানীরা?
পৃথিবীতে কাজ করার সময় ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞরা দেখেন, রক্তের ফোঁটাগুলি সবসময় বাঁকা পথে পরিভ্রমণ করে, কিন্তু শূন্য মহাকর্ষে, দেওয়ালে ধাক্কা খাওয়ার আগে পর্যন্ত সেটি সরলরৈখিক পথ অনুসরণ করে। মাইক্রো গ্র্যাভিটিতে, প্রায় ভারহীন অবস্থায় ওড়ার সময় পৃষ্ঠটান তরল বিন্দুগুলিকে গোলাকার আকার দেয়। মাধ্যাকর্ষণের অভাবে রক্তের কণাগুলো উড়ানের গা বেয়ে নীচের দিকে নামতে পারে না, পরিবর্তে পৃষ্ঠটান রক্তের ফোঁটাগুলির আকৃতি, আকার ধরে রাখে।
ধারালো অস্ত্রের পরিবর্তে যদি বন্দুক ব্যবহার করা হয় স্পেস স্টেশনে? সেক্ষেত্রে ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞদের কাজ কিছুটা কমবে আশা করা যায়। কারণ ফায়ারিংয়ের সময় পোড়া এবং অপূর্ণ বারুদের ক্ষুদ্র কণা, প্রাইমার উপাদান এবং কার্তুজ বা বন্দুক থেকে নির্গত কিছু ধাতব টুকরো মিশে গান শট রেসিডিউ (GSR) বা বন্দুকের গুলির অবশিষ্টাংশ তৈরি করে। আর সৌভাগ্যবশত পৃথিবীর মতো নভোস্টেশনেও এই জিএসআর একইরকম পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। আসলে এটি খুনে ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্র, আততায়ী, নিহত বা আহত ব্যক্তি, অকুস্থল, সর্বত্র পরিব্যপ্ত থাকে — ফলে আততায়ী এর ছাপ কোনওভাবেই মুছতে পারে না; এটি স্পেস স্টেশনের ভেন্টিলেটর, বিভিন্ন ফিল্টারের ভিতর গিয়ে জমে যায়। নভোস্টেশনে তো এই ছাপ মোছা আরও কষ্টসাধ্য, কারণ তাঁদের ব্যক্তিগত প্রয়োজনে মহাকাশচারীরা শাওয়ারের পরিবর্তে স্পঞ্জ ও সাবান ব্যবহার করেন। ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞরা সেই সব জমে থাকা অবশিষ্টাংশ বিশ্লেষণ করে কোন ধরনের অ্যামুনেশন ব্যবহার করা হয়েছে, তাও বার করতে সিদ্ধহস্ত।
পৃথিবীতে গুলি করার পর মহাকর্ষের জন্য সেটি সর্বদা বৃত্তাকার পথ অনুসরণ করে, কিন্তু স্পেস স্টেশনের মাইক্রো গ্রাভিটিতে সেটি সরলরৈখিক পথে পরিভ্রমণ করে। ফলে, হয় এটি স্টেশনের দেওয়ালে গেঁথে যায়, নতুবা বারবার এ দেওয়াল-ও দেওয়াল ধাক্কা খেয়ে অবশেষে কেবিনের ভিতরে শূন্যে ভাসমান অবস্থায় থাকে, যেটা একজন ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞের কাজকে সহজ করে দেয়। সেজন্য বিশেষজ্ঞের অভিমত হলো, স্পেস স্টেশনে খুনের জন্য আগ্নেয়াস্ত্র নৈব নৈব চ!
মাইক্রো গ্রাভিটিতে একজন ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞের ভূমিকা কী হওয়া উচিত, তার দিশা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন কোয়ালসকরা। কিন্তু কিছু প্রশ্নের উত্তর এখনও অধরা। বদ্ধ এয়ারক্রাফ্টের ভিতরে অক্সিজেন সরবরাহের জন্য যে বায়ুর স্রোত রয়েছে, সেটির কোনও প্রভাব রক্তের কণাগুলোতে পড়ছে কি? মাইক্রো গ্র্যাভিটিতে রক্ত শুকোচ্ছে কী করে? এয়ারক্রাফ্টের অধিকাংশ যন্ত্রাংশই জল প্রতিরোধক, সেক্ষেত্রে তার গায়ে রক্তের ফোঁটা এসে পড়ার পর দাগের কি কোনও পরিবর্তন হচ্ছে না? বর্তমান মহাকাশ দখলের ঠান্ডা লড়াই যেভাবে বাড়ছে, অদূর ভবিষ্যতে বহির্জাগতিক ফরেন্সিক বিজ্ঞান পরীক্ষাগার (Extraterrestrial Forensic Science Laboratory) যে গড়ে উঠবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তখন নিশ্চিত এরকম আরও প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে।

Whatsapp
