সঞ্চার সাথী অ্যাপ: সরকারি নজরদারির নতুন অস্ত্র?

Sanchaar Saathi app: আগামীদিনে প্রতিটি স্মার্টফোনে ‘সঞ্চার সাথী’ মোবাইল অ্যাপলিকেশন আগে থেকে ইন্সটল করা থাকবে। সিম ভরে ফোন চালু করার সঙ্গে সঙ্গে এই অ্যাপ কাজ করা শুরু করবে।

দেশের সরকার সুরক্ষা দেওয়ার নাম করে, এমন একটি মোবাইল অ্যাপলিকেশন তাঁর নিজের নাগরিকদের মোবাইল ফোনে আগে থেকে ঢুকিয়ে দিতে চলেছে যে আগামীদিনে প্রতিটি ব্যক্তির উপর সরকারের নজরদারি করা এখন অত্যন্ত সোজা বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এই ‘সঞ্চার সাথী’ মোবাইল অ্যাপলিকেশনের খবর কিন্তু সরকার প্রাথমিক ভাবে দেয়নি। এই খবরটি করেছে রয়টার্স। জানা গিয়েছে, আগামীদিনে প্রতিটি স্মার্টফোনে এই ‘সঞ্চার সাথী’ মোবাইল অ্যাপলিকেশন আগে থেকে ইন্সটল করা থাকবে। সিম ভরে ফোন চালু করার সঙ্গে সঙ্গে এই অ্যাপ কাজ করা শুরু করবে।

প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো এবং সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে, কোনো ফোন হারিয়ে গেলে তা খুঁজে পাওয়ার সুবিধার জন্য এই মোবাইল অ্যাপলিকেশন দেওয়া হবে। প্রতিটি ফোনের একটি নিজস্ব পরিচিতি থাকে যাকে IMEI নম্বর বলে। এই IMEI নম্বর প্রতিটি ফোনের জন্য আলাদা। সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে, ডুপ্লিকেট বা জালি IMEI নম্বর থেকে ভারতের সাইবার নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে ভারতের সুরক্ষা নষ্ট করা হচ্ছে, তাই সেটা চেনার জন্যেই এই ‘সঞ্চার সাথী’ মোবাইল অ্যাপলিকেশন চালু করা হবে। অনেকটা অনুপ্রবেশকারী রুখতে ভারতের সমস্ত নাগরিকদের অনুপ্রবেশকারী হিসেবে সন্দেহ করার মতো বিষয়।

এখন শোনা যাচ্ছে, গত ২৮ নভেম্বর, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া ইতোমধ্যেই নাকি আগামী ৩ মাস পরে যে ফোনগুলি আসবে, সে গুলিতে এই মোবাইল অ্যাপলিকেশন যাতে থাকে সেই নির্দেশ দিয়েছিল বিভিন্ন মোবাইল প্রস্তুতকারক সংস্থাকে। বলা হয়েছে, যে ফোনগুলো ইতোমধ্যেই নাকি বাজারে আছে, সেগুলোতেও এই ‘সঞ্চার সাথী’ মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন যাতে আপডেট করার সঙ্গে সঙ্গে লাগু হয়, তার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়েছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কোনো ব্যক্তি যদি নিজের মোবাইল ফোনের সুরক্ষার জন্য অ্যাপ্লিকশনটি চান তিনি নিজেই তা ফোনে নামিয়ে নেবেন, বাধ্যতামূলক করা হলো কেন? 

আরও পড়ুন

রাষ্ট্র সব দেখছে! কীভাবে রাষ্ট্রের নজরদারির সামনে প্রতিনিয়ত নগ্ন হচ্ছেন ভারতের নাগরিকরা

ইন্টারমেন্ট ফ্রিডম ফাউন্ডেশন, যারা আমাদের দেশে মানুষের গোপনীয়তা এবং ব্যক্তিগত পরিসরে সরকারের নজরদারি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কাজ করে, তাঁরা এই মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এই খবরটি বাইরে আসার পরে বিভিন্ন সাংবাদিকেরা এবং ওই সংস্থার পক্ষ থেকে নীতিগত কিছু প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁদের বক্তব্য, এই মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনটি আমাদের ব্যক্তিগত পরিসরের মধ্যে ঢুকে আসবে। নতুন ফোন যা অ্যান্ডরয়েড কিংবা প্রচলিত কিছু অপারেটিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে, সেই ফোনগুলি সিম ঢুকিয়ে চালু করা মাত্র সেই ফোন যাতে আমাদের সমস্ত কল, সমস্ত মেসেজ, সমস্ত হোয়াটস অ্যাপের মেসেজ পড়তে পারে, তার জন্য প্রথমেই অনুমতি দিতে হবে। শুধু তাই নয়, এই মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনটি প্রতিটি ফোনের অবস্থান এবং ক্যামেরায় যা ছবি তোলা হবে, তাও দেখতে পাবে।

IMEI জালিয়াতি রোধ এবং টেলিকম নিরাপত্তা উন্নত করার ঘোষিত লক্ষ্য, হয়ত আপাতদৃষ্টিতে, একটি বৈধ রাষ্ট্রীয় লক্ষ্য। কিন্তু যে পদ্ধতি নেওয়া হচ্ছে তা একেবারেই অসামঞ্জস্যপূর্ণ, আইনত ভঙ্গুর এবং কাঠামোগতভাবে ব্যবহারকারীর গোপনীয়তা এবং স্বায়ত্তশাসনের প্রতিকূল। সরকারি নির্দেশিকার ৭(খ) ধারাটি পড়লে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে সরকারের উদ্দেশ্য সুরক্ষা দেওয়া নয়, আসলে নজরদারি করা। সেই জন্যেই আগে থেকে ইনস্টল করা ‘সঞ্চার সাথী’ মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনটি যাতে 'সহজেই দৃশ্যমান' হয় এবং এই প্রযুক্তির কার্যকারিতা যাতে 'অক্ষম' না করা যায়, তা বলা হয়েছে। যে প্রযুক্তিকে পছন্দ করা হয়েছে, সেই প্রযুক্তি অন্য মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনের তথ্য যাতে পড়তে পারে, সেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সাধারণত একটি মোবাইল অ্যাপলিকেশন অন্য অ্যাপের তথ্যতে নজরদারি করতে পারে না কিন্তু ‘সঞ্চার সাথী’ প্রতিটি ভারতীয় স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর অপারেটিং সিস্টেমের ভেতরে একটি স্থায়ী, অসম্মতিমূলক অ্যাক্সেস পয়েন্টে পরিণত করে।

২০১৭ সালের কে.এস.পুট্টুস্বামী মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায়ের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, যা গোপনীয়তার মৌলিক অধিকারকে সুর্নিশ্চিত করেছিল, এই ‘সঞ্চার সাথী’ আনুপাতিকতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারবে না, অর্থাৎ কোন কাজের জন্য এই প্রযুক্তি আর কীসের জন্য তা ব্যবহার হবে, তা ভাবার প্রয়োজন আছে। ওই রায়ে বলা হয়েছিল, গোপনীয়তার অধিকারে যে কোনো অনুপ্রবেশ অবশ্যই আইনি বৈধতা, প্রয়োজনীয়তা এবং আনুপাতিকতার মান পূরণ করে তা দেখতে হবে। এমনকি নির্দিষ্ট মোবাইলের IMEI নম্বরের সত্যতা যাচাইয়ের সীমিত উদ্দেশ্যের আইনি বৈধতা এবং প্রয়োজনীয়তা আছে ধরে নিলেও, তবুও আদেশটি স্পষ্টতই আনুপাতিকতার প্রশ্নে আটকে যাওয়া উচিৎ। যেখানে আমাদের দেশে তথ্য সুরক্ষার কোনো নির্দিষ্ট রূপরেখা নেই, যেখানে মাঝেমধ্যেই শোনা যায় নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য, ডার্ক ওয়েবে বিক্রি হয়ে গিয়েছে, সেখানে সরকার আগে সেই সব বিষয়ে সুরক্ষা না দিয়ে কেন ঘুরপথে তার নাগরিকদের উপর নজর রাখতে চাইছে? বাস্তবে, ভারতের প্রতিটি স্মার্টফোন ব্যবহারকারীকে তাদের প্রাথমিক ব্যক্তিগত মোবাইলে একটি উন্মুক্ত, আপডেট যোগ্য নজরদারি ক্ষমতা আছে এমন একটি মোবাইল অ্যাপলিকেশন কেন গ্রহণ করতে বলছে তা জানা জরুরি। তাই প্রশ্ন উঠছে, সাংবিধানিক গণতন্ত্রের অবশ্য কর্তব্য যে একজন ব্যক্তি নাগরিকের সমস্ত তথ্য যাতে সুরক্ষিত থাকে, সেদিকে যখন জোর দেওয়া উচিত তা ছাড়াই তা কেন করতে বলছে।

যে প্রযুক্তি মোবাইলের অন্য তথ্য পড়তে পারে, সেই প্রযুক্তি যে ওই নির্দিষ্ট মোবাইলে অন্য কিছু তথ্য যে ঢোকাবে না, তার নিশ্চয়তা দেওয়া যায় কি? কয়েকবছর আগে ইজরায়েলের একটি সংস্থা এনএসও-র থেকে পেগাসাস বলে একটি ম্যালওয়ার ভারত সরকারের পক্ষ থেকে কেনা হয়েছিল বলে খুব শোরগোল পড়েছিল। শোনা গিয়েছিল বিভিন্ন বিরোধী রাজনৈতিক নেতা, মন্ত্রী, কিছু সাংবাদিক এবং দেশের কিছু বিচারপতির ফোন এবং ব্যক্তিগত মেলে ওই ম্যালওয়ার পাঠানো হয়। উদ্দেশ্য খুব পরিষ্কার। ওই মানুষেরা কার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন, সরকার বিরোধী কোনো ফন্দি আটছেন কি না, এমনকি সরকার ফেলার কোনো ষড়যন্ত্র করছেন কি না, তা জানা। বাংলার অন্যতম একজন বিজ্ঞানী এবং সমাজকর্মী পার্থ সারথি রায় থেকে শুরু করে স্বাধীন সাংবাদিক পরঞ্জয় গুহঠাকুরতা, এই রকম বহু মানুষ বিষয়টি প্রকাশ্যে আনেন। এই নিয়ে জোর চর্চা হয়েছিল, সরকার কি ভয় পাচ্ছে তাঁর নিজের নাগরিকদের? বিষয়টি দেশের সর্বোচ্চ আদালত অবধি গড়ায়। আমাদের আদালত তো, সুতরাং তার থেকে সরকার বিরোধী রায় কি আশা করা যায়? যথারীতি রায় প্রকাশ হওয়ার পরে জানা যায়, সরকারই এ কাজ করেছে কিনা তা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না এবং একটি সফটওয়্যার ঢোকানো হয়েছিল সেটা সত্যি হলেও তা যে পেগাসাস তা বলা যায় না। অভিযোগ উঠলেও তাই ছাড় পেয়ে যায় সরকার।

সেদিন ছাড় পেয়ে গেলেও, আমাদের দেশের সচেতন সমস্ত নাগরিক কিন্তু সেদিনই আন্দাজ করে ফেলেছিল, এই সরকার তাঁর নাগরিকদের বিশ্বাস করে না। যার অন্যতম প্রমাণ সরকার আধারকে একটি সার্বজনীন নজরদারির উপকরণ বানিয়ে ফেলেছে। ২০০৯ সালে যে আধারকে আনা হয়েছিল, খুব কম অংশের মানুষের একটি পরিচয়পত্র হিসেবে, সেই আধারকে ব্যাঙ্ক, মোবাইল, গ্যাসের সংযোগ এবং সাম্প্রতিক সময়ে ভোটার কার্ডের সঙ্গে ঘুর পথে সংযোগ করানোটাও ওই নজরদারিরই প্রক্রিয়া। আইন আনা হয়েছে, যাতে আধারকে সমস্ত ব্যক্তিগত পরিসরের সঙ্গে সংযোগ করানো যায়।

আরও পড়ুন

ভারতীয় সাংবাদিকরাই লক্ষ্য! মোবাইলে পেগাসাস ঢুকিয়ে নজরদারি চালাচ্ছে কারা?

তথ্য প্রযুক্তি (আইটি) আইন এবং ভারতীয় টেলিগ্রাফ আইনের মতো আইনগুলিকে এমনভাবে সংশোধন করা হয়েছে যে সরকারি সংস্থাগুলো ইচ্ছে করলেই যে কোনো যোগাযোগ আটকে দিতে পারে, পর্যবেক্ষণ করতে পারে এবং ডিক্রিপ্ট করতে পারে। ডিজিটাল ইন্ডিয়ার গুণগান গেয়ে দেশ জুড়ে নজরদারি ক্যামেরা বসানো, মুখ দেখে চিনে ফেলার প্রযুক্তি বিভিন্ন জায়গায় লাগু হয়ে গিয়েছে। বিমানবন্দর গুলিতে যাত্রী সুবিধা দেওয়ার নামে ডিজি অ্যাপ চালু করেছে, যাতে প্রতিটি যাত্রীকে মুখ চিনিয়ে ঢোকার অনুমতি দেওয়া হবে বলে জানা গিয়েছে, কিন্তু এই প্রযুক্তি কি সবার জন্য লাগু করা যায় না উচিৎ? এটাই আনুমানিকতার সমস্যা, একজন অপরাধীকে চিহ্নিত করার জন্য সবাইকে অপরাধী সাব্যস্ত করা যায় না। কোভিডের সময়েও কো উইন নামের একটি মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন আনা হয়েছিল। সেটাও এক ধরনের নজরদারির উপকরণ ছাড়া কিছু নয়। ‘নেত্র’ বলে একটি প্রযুক্তি আনা হয়েছে যাতে ইমেল এবং ব্লগে টেক্সট-ভিত্তিক বার্তা-সহ অনলাইন কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করা, ফিল্টার এবং কীওয়ার্ড ব্যবহার করে এনক্রিপ্ট করা বার্তাগুলিতেও নির্দিষ্ট শব্দ শনাক্ত করা সম্ভব হবে।

গত ১০ বছর ধরে ভারত এই নজরদারিতে চিনের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে। চিন ও তাঁর নাগরিকদের উপর বিভিন্ন ডিজিটাল প্রক্রিয়ায় এই ভাবেই নজরদারি চালায়। আসলে রাষ্ট্র যখন বুঝতে পারে তাঁর অবস্থা টলমল, এবং তাঁর বিরুদ্ধে নানান প্রান্তে ক্ষোভ জন্মাচ্ছে, সেই ক্ষোভকে অঙ্কুরে বিনাশ করতে সে উদ্যোগী হয়। ‘সঞ্চার সাথী’ সেই জন্যেই ভাবা হয়েছে। আজকে হয়ত কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া বিরোধীদের ক্ষোভের মুখে পরে বলেছেন এই মোবাইল অ্যাপলিকেশন বাধ্যতামূলক নয়, কিন্তু সার্কুলার যা প্রকাশিত হয়েছিল, তাতে কিন্তু বিষয়টা বাধ্যতামূলকই বলা আছে। জর্জ ওরওয়েল একটি উপন্যাস লিখেছিলেন ‘১৯৮৪’, তাতে এরকমই একটি সময়ের কথা বলা হয়েছিল, যেখানে রাষ্ট্র বা তারও উপরে কেউ মানুষের উপর নজর রাখছে। ভারতের বর্তমান সরকার কি গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ত্যাগ করে সেইরকম একটি সময়ের দিকে নিয়ে যেতে চাইছে?

 

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

More Articles